somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাগরে ভয়ঙ্কর কয়েকটি দিন কয়েক টি রাত

২১ শে আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি পেশায় একজন শিক্ষানবিস মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশের একটা বেসরকারী ইন্সিটিউট থেকে direct entry cadet (ENGINE) হিসেবে এ বছর ৬ জানুয়ারি যোগ দেই সিঙ্গাপুর এর পতাকাবাহী বিদেশগামি জাহাজ MT.LENA তে। এটি একটি ১০১ মি. লম্বা ট্যাংকার। এটি সাধারণত HFO ( Heavy Fuel Oil ) পরিবহন করে। আমি যোগ দেয়ার সময় জাহাজ এর ক্যাপ্টেন ছিল বাংলাদেশ মেরিন একাডমি র ক্যাপ্টেন মুঞ্জুর উল ইসলাম। নৈতিকতা পেশাদারিত্ব, নেতৃত্ব বিচক্ষনতা সব দিক থেকে স্যার অনেক উঁচু মাপের মানুষ। স্যার আমার অনেক সিনিয়র হলেও আমার সাথে বন্ধুর মত মিশতেন। আমাকে জাহাজ এর অনেক খুটিনাটি বিষয় শিখতে সাহায্য করতেন।
৬ জানুয়ারি যোগ দেয়ার পরে দেখি জাহাজের ৩টি জেনারেটার এর ২ নম্বর টি overhaul হচ্ছে। চাইনিজ দুজন টেকনিশিয়ান আমাদের জাহাজ এর 3rd ENGINEER আরও আর অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার oiler রাও তাদের নির্ধারিত কাজ শেষ করে এ কাজে টুকটাক সাহায্য করত। আমি একেবারেই নতুন তা ছাড়া ক্যাডেট দের দায়িত্ব পূর্ন কাজ দেয়া হয় না তাই আমার কাজ ছিল সাহায্য কারীর মত। যা হোক সব কিছু ঠিকঠাক করে ১২ জানুয়ারি সন্ধায় আমরা terminal jetty তে যাই loading এর জন্য। সেখান থেকে loading শেষ করে ১৩ জানুয়ারি বিকালে মালয়শিয়ার তাওয়াও বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করি। এটা ছিল আমার প্রথম সমুদ্র যাত্রা। বাড়ি থেকে এসে বিদেশে নতুন পরিবেশ এ মন খারাপ হচ্ছিল খুব। যাহোক আমরা দক্ষিন চীন সাগর হয়ে মালয়ারি ক্যানেল হয়ে ১৮ জানুয়ারি দুপুর এ মালয়শিয়ার তাওয়াও বন্দরে পৌছাই। এখানে কার্গো দিসচার্জ করে ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আবার সিঙ্গাপুর এর দিকে রাওনা দেই। ২৪ ঘন্টা মোটামুটি 11.5 knots গতিতে চলার পর ২৯ তারিখ ভোরে 2nd ইঞ্জিনিয়ার আমাকে কেবিনে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে ইঞ্জিন রুম এ আসতে বলে। আমি পরিমরি করে উনিফর্ম পরে চেঞ্জ রুম এ এসে বয়লার সুট পরে ইঞ্জিন রুম এ এর দরজা খুলতেই প্রচন্ড ধোঁয়া দেখতে পাই। ধোঁয়ার জন্য ভালকরে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তখনও কোন অ্যালার্ম শুনতে না পাওয়ায় আমার সন্দেহ হয় হয়ত আগুন হয়ত এখন কেউ দেখেনি। হঠাত করে বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। তবে মাথা কাজ করছিল। মেরিন একাডেমিতে FIRE FIGHTING এর প্রশিক্ষন এর বিষয় গুল মাথায় রেখে ইঞ্জিন রুম এ ঢুকতেই যে সমস্ত মেশিনারিজ ছিল সেগুল পরিক্ষা করে দেখি। সেগুলো ঠিকই ছিল।
এরপর নেমে এসে মেইন ইঞ্জিন এর ফ্লোরে নামার জন্য লোহার সিঁড়ি তে পা রাখতেই দেখতে পাই GEAR BOX এর ভেতর থেকে লকলকে আগুনের শিখা উপর দিকে উঠছে প্রায় ৩ ,৪ মিটার। এর সামনেই 4th ইঞ্জিনিয়ার আর এক জন oiler কাজ করছিল। oiler সোয়ার্দিন দক্ষতার সাথে ফোম fire extinguisher দিয়ে আগুন কে নিভিয়ে দেয় কিন্তু ভেতরের আগুন একটু একটু দেখা যাচ্ছিল। আমিও ততক্ষনে অন্য একটি fire extinguisher দিয়ে আগুনের দিকে নিক্ষেপ শুরু করেছি। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল ইঞ্জিন তখন চলছিল। 8MG28HL . 3030 KW মডেলের NIGATA কোম্পানির ইঞ্জিন। 2nd ইঞ্জিনিয়ার কন্ট্রোল রুম থেকে তখনই ইমার্জেন্সি সুইচ এর মাধ্যমে ইঞ্জিন বন্ধ করে। আর আমরা GEAR BOX এর উপর পানি স্প্রে করতে শুরু করি যাতে ভেতরের আগুন বাড়তে না পারে। এর আগের রাতে gear box এর LO তাপমাত্রা কিছু বেশি ছিল কিন্তু সেখান থেকে এমন ঘটনা কেউ আশা করেনি। জাহাজ এর gear box টি একটি TATA NANO গাড়ির সমান বা তার থেকে কিছু বেশিই হতে পারে। আমাদের জাহাজ তখন এমন যায়গায় সেখানে আসে পাশে কয়েকটি দ্বীপ দৃষ্টি সীমার মাঝে ছিল। আমরা ভেবেছিলাম হয়ত gear box ঠান্ডা হওয়ার পর lube oil drain করে cooler, filter পরিস্কার করে সামান্য কিছু মেরামত করলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু lube oil filter খুলে এর মাঝে প্রচুর লৌহ বস্তু পাওয়া যায় তখন সন্দেহ হয় যে সম্ভবত বিয়ারিং ভেঙ্গেছে। fly wheel এর পাশের gear box এর ডাকনা খুলে দেখা যায় যে সেটি ঠিক আছে কিন্তু প্রপেলার সাফট এর দিকের ঢাকনা টি যেদিক দিয়ে আগুনের শিখা বেরিয়েছিল সেটি কোন ভাবেই খোলা যাচ্ছিল না। ৩ টনের ৩ টা চেইন ব্লক দিয়েও একটুও নড়ান যাচ্ছিল না। অবশ্য ওটা খোলার জন্য যায়গাও পর্যাপ্ত পরিমান ছিল না। অফিস থেকে technical superintendent ফোন করে চিফ ইঞ্জিনিয়ার কে নানা রকম নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনুকুলে নয়। তারপরও ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট এর সবাই আমরা প্রানপন চেষ্টা করছি। অনেক এর জীবন মরন এর প্রশ্ন তখন আমাদের কাজের উপর নির্ভর করছে।
এদিকে আমরা যেখানে আছি সেটা জলদস্যু প্রবন এলাকা। আমাদের gear box কাজ করছে না অর্থাৎ আমরা অচল। যদি এমন কিছু আক্রমণ করেই বসে আমরা কিছুই করতে পারব না। রাতে CAPTAIN জরুরি মিটিং ডাকলেন। চিফ ইঞ্জিনিয়ার জানিয়ে দিল যে আমরা যথা সাধ্য চেষ্টা করছি কিন্তু আমরা এটা চলার সক্ষম করতে পারবনা কারন আমাদের কাছে অতিরিক্ত বিয়ারিং নেই আর এটা থাকেও না কোন জাহাজ এ এটা শিপ ইয়ার্ড এ নিয়ে ঠিক করতে হবে। ক্যাপ্টেন স্যার তখন নিরাপত্যার জন্য পাইরেসি ওয়াচ ব্যাবস্থা করলেন। খাবার রেশনিং শুরু করলেন। বিশুদ্ধ পানি খুব সাবধানে ব্যাবহার এর নির্দেশ দিলেন। কারন আমাদের সব মিলিয়ে ১৮ দিনের মত খাবার রিজার্ভ ছিল। সেটা কে বারিয়ে হয়ত আর কয়েক দিন নেয়া যাবে। কিন্তু আমরা সাম্নের দিন গুল সম্পর্কে কিছুই জানি না। রাত কাটে উৎকণ্ঠায়। আসেপাশে কোন মাছ ধরার নৌকা আসলেও ভয় করে কারন এ এলাকার দস্যু রা এভাবেই বেশির ভাগ আক্রমন করে থাকে। আমিও কয়েক রাত পাইরেসি অয়াচ এ ছিলাম। চার দিকে সতর্ক নজর রাখতে হয়, কিছুক্ষন পরপর আপডেট জানাতে হয় ব্রিজ এ অবস্থান রত ডিউটি অফিসার কে। আসে পাশের নৌ জান গুলোর আলো গুলর দিকে সতর্ক নজর রাখে তাদের গতিবিধির দিকে পর্যবেক্ষন করতে হয়। মাঝে মাঝে সার্চ লাইট ফেলে জাহাজ এর কাছের কোন কিছুর সন্দেহ জনক নড়াচড়া খেয়াল করতে হয়। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে দস্যুর মুখমুখি হতে হয়নি।
কিন্তু এদিকে খাবার কমে আসছে। বিশুদ্ধ পানির স্তর ও নিচের দিকে যাচ্ছে। আমরা জাহাজ এর খালি ড্রাম গুল বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানিতে ভর্তি করতাম। এ পানি দিয়ে ধোয়া মোছা সহ টয়লেটে ম্যানুয়েলি ব্যাবহার করা হত। tag boat ছাড়া এখন আমাদের কোন উপায় নেই। ইতোমধ্যে ৭ দিন পেরিয়ে গেছে। কোম্পানি এখন সিদ্ধান্ত নেয়নি টাগ বোট পাঠানোর। সেটা আসতেও কমপক্ষে ৪ দিন সময় লাগবে সিঙ্গাপুর থেকে। তারপর কোথায় যাওয়া হবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। এর পর দিন অফিস জানাল যে তারা ২ দিনের মাঝে বোট পাঠাবে আর দুটি বন্দরে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানাল। একটা হল লাবুয়ান মালয়শিয়া আর একটি হল কোটাকিনাবালু মালয়শিয়া। ক্যাপ্টেন স্যার আমাদের প্রভিসন, বিশুদ্ধ পানি এসব হিসাব করে লাবুয়ান এ যাওয়াই সুবিধাজনক বলে অফিস কে জানালেন।এটি মালয়শিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা ছোট একটি দ্বীপ। লাবুয়ান এ চীনা অর্থায়নে একটি শিপইয়ার্ড আছে। আমাদের অবস্থান থেকে টাগ বোট এ টেনে অখানে যেতে কমপক্ষে ৫ দিন সময় লাগবে।
রাত গুল এক অজানা আতঙ্কে কাটায় সবাই। ফন এ নেট নাই, কথা বলার কোন ব্যাবস্থা নাই। জাহাজ এর ফোন থেকে শুধু জরুরী প্রয়োজনে ফোন করা হয়। অবশেষ এ ১০ দিন এর মাথায় সিঙ্গাপুর থেকে টাগ বোট আমাদের অবস্থানে আসল। ১১ ই ফেব্রুয়ারি আমাদের জাহাজ তেনে নিয়ে রওনা দিল লাবুয়ান এর উদ্দেশ্যে। এর ৫ দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি আমরা লাবুয়ান এ পৌঁছলাম। দুশ্চিন্তার অবসান হল। মনে হল যাক এ যাত্রা বেচে গেলাম।
পরে gear box খুলে দেখা গিয়েছিল সেটার ভিতর ট্রান্সফার(ahead ) শাফট এর দুটি দুটি বিয়ারিং সম্পুর্ন পুরে গলে গেছে। ক্লাচ প্লেট গুল একটা আর একটার সাথে লেগে গেছে। আর মাঝের মেইন ট্রান্সফার সাফট এর বড় পিনিয়ন টি একটু নড়ে গিয়ে upper housing, middle housing এর বডি তে লেগে সেটা কে প্রায় ১০ মি.মি. গ্রাইন্ড করেছে। যে টেকনিশিয়ানরা এটা খুলেছিল তারা আমাদের দিকে কিছুক্ষন অপলক ভাবে তাকিয়ে ছিল তারপর বলেছিল “ ভাগ্যই বলতে হবে আপনাদের আপনারা সহ জাহাজ যে এখন অক্ষত আছে এটাই অনেক বেশি।“
আমরা আর কি বলব লাবুয়ান এ এসে প্রায় সবাই শুকরিয়া নামাজ পরেছে।
১৮টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×