somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

[b]বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট[/b]

২৮ শে এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৩:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট বিষয়ে সম্প্রতি উভয় দেশের সরকার এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। এ প্রেক্ষাপটে ট্রানজিটের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি লেখা প্রকাশ করা হলো।

আমি উন্মুক্ত বিশ্বের পক্ষে। আমি চাই, সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত থাকুক, সারা বিশ্বও বাংলাদেশের কাছে উন্মুক্ত হোক। ভারত, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের শক্তিশালী ও ক্ষমতাবানদের জন্য দরজা-জানালা আমরা খুলে দিলাম, আর এসব দেশে বাংলাদেশের পণ্য ও মানুষের প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিতই থাকল—এটা উন্মুক্ত হওয়া নয়। উন্মুক্ত হওয়া আর আত্মসমর্পণ কিংবা অধীনস্থ হওয়া এক কথা নয়। এই দুইয়ের পার্থক্য বোঝার মতো আত্মসম্মানবোধ আমাদের মধ্যে তৈরি হওয়া দরকার।
ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ অনেক উন্মুক্ত, অনেক উদার। আইনি পথে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়, বেআইনি পথে হয় আরও বেশি। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য, বিনিয়োগ, শ্রম, পরিষেবা, প্রতিষ্ঠান আসায় কোনো বাধা নেই, বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেল দেখতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্য থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল পর্যন্ত সবকিছুতেই নানাবিধ বাধা আছে। নৌপথে ভারত ট্রানজিট-সুবিধা অনেক আগে থেকেই পাচ্ছে, এখন পেতে যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ নেপাল বা ভুটানে যাওয়ার জন্য ভারতের ৩০-৪০ কিলোমিটার ব্যবহার শুরু করতে পারেনি। সীমান্তে কখনো ভারতীয় নিহত হয় না, নিয়মিতভাবে নিহত ও জখম হয় বাংলাদেশের কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের গরিব মানুষ।
ভারতের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যে ধরনের ‘ট্রানজিট’ প্রস্তুতি চলছে, এর কোনো তুল্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। একমাত্র কাছাকাছি হলো দক্ষিণ আফ্রিকা ঘেরাও হয়ে থাকা লেসোথো। কিন্তু এটিও তুলনীয় নয়। কারণ, সোনার খনি নিয়েও লেসোথো রাষ্ট্র হিসেবে প্রায় ভেঙে পড়েছে, আয়ুসীমা ৩৪ বছর। মারিজুয়ানা চাষের ওপর নির্ভর অনেক কর্মসংস্থান, আর লেসোথোর মানুষ নিজেরাই দক্ষিণ আফ্রিকার দশম প্রদেশ হওয়ার আবেদন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও এর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না দুটো কারণে; প্রথমত, দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এতটা অসমতা নেই, যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আছে। দ্বিতীয়ত, সেখানে কোনো দেশই অন্য দেশের ভূমি বা নৌপথ ব্যবহার করে নিজ দেশেরই অন্য প্রান্তে যায় না, যায় তৃতীয় দেশে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অবাধ যোগাযোগ ভারতের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যদি ভারতকে এই সুবিধা দেয়, তাহলে ভারতের পরিবহন-ব্যয় কমে যাবে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি, অর্থাৎ আগে যে পণ্য পরিবহনে খরচ হতো ১০০ টাকা, এখন এর খরচ দাঁড়াবে ৩০ টাকারও কম। এ ছাড়া সময় লাগবে আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ, বা চার ভাগের এক ভাগ। এই সময় ও অর্থসাশ্রয় বহু গুণে তাদের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে কাজে লাগবে। ভারতের এত লাভ যেখানে, বাংলাদেশের সেখানে প্রাপ্তি কী? আমাদের সার্ভিস ও অবকাঠামোর সুযোগ-ব্যয় কত? কী কী লাভ, আর কী কী ক্ষতি বা সমস্যা? কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি?
‘ট্রানজিট’-এর লাভ-ক্ষতি নিয়ে সরকার থেকে কোনো হিসাব-নিকাশ আমাদের জানানো হয়নি। অথচ মন্ত্রী কিংবা বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে, ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য খুব লাভজনক, দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার লাভের অঙ্ক। কীভাবে ট্রানজিট বিষয়ে দুই দেশের সরকারের বিস্তারিত সিদ্ধান্তের আগে এ বিষয়ে অঙ্ক দেওয়া যায়, তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে যাঁদের দর-কষাকষি করার কথা, তাঁরাই যদি আগে থেকে বলতে থাকেন, এতে বাংলাদেশেরই লাভ হবে, তাহলে দর-কষাকষির আর কী সুযোগ থাকে? যখন ট্রানজিট কার্যকর হওয়ার মুখে, তখন আবার শোনা গেল অন্য যুক্তি, অন্য হিসাব। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান এত দূর বললেন যে সভ্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি চাইতেই পারে না। আবার ফি নির্ধারণের জন্য কমিটিও করা হয়েছে।
শুধু গাড়িভাড়া হিসাব করলেও তো হবে না। বাংলাদেশের জন্য আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জমি সীমিত, আবাদি জমি নষ্ট করা তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের ক্রমবর্ধমান পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে যে সড়ক সম্প্রসারণ ও সংযোজন করতে হবে, তা কত কৃষিজমি-জলাভূমি বিনাশ করবে? এর ফলে খাদ্যসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন, জীববৈচিত্র্য কত বিনষ্ট হবে? কত পরিবেশ দূষণ হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজের পণ্য পরিবহন ভবিষ্যতে অনেক বাড়বে। এখনই বিভিন্ন রাস্তায় জটের কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, পচনশীল দ্রব্য বিনষ্ট হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়ে। ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমাদের পণ্যপ্রবাহে কী রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে? তৃতীয়ত, যে রাজ্যগুলোতে ভারত পণ্য নিয়ে যাবে, সেসব রাজ্য এত দিন ছিল বাংলাদেশের বহু শিল্পপণ্যের বাজার। সেই বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে, সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। এর ক্ষতি কত? চতুর্থত, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে তিন দিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে রাখে, সেখানে বাংলাদেশ ভেদ করে তার পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তাব্যবস্থা কে করবে? কী পণ্য ভারত নিয়ে যাচ্ছে, এর তদারকির ব্যবস্থা কী থাকবে? পঞ্চমত, নদী, কাঁটাতার, অসম প্রবেশাধিকার, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আগে সমাধান কেন নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ভারতের কাছ থেকে কঠোর শর্তযুক্ত ঋণ নেওয়ার চুক্তি হয়েছে তাদেরই কাঙ্ক্ষিত পণ্য পরিবহনব্যবস্থা দাঁড় করার জন্য!
লাভের কাল্পনিক হিসাব দিতে ব্যস্ত না থেকে নীতিনির্ধারকেরা নানা সমাধান খুঁজতে পারতেন। ভারতের প্রয়োজন ও বাংলাদেশের জটিলতায় না পড়ার মতো একটা সমাধান হতে পারত ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের বাংলাদেশ অংশজুড়ে বিশাল শিল্প বেল্ট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া। কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকারে ভারত যদি অনুকূল অবস্থান নেয়, তাহলে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কিংবা যৌথ উদ্যোগে এই রাজ্যগুলোর চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের বিস্তার খুবই সম্ভব। বর্তমানে এসব রাজ্যে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য সরবরাহের সাফল্যে এই সক্ষমতার ইঙ্গিত আছে। ভারতকে তাহলে এত দূর পণ্য টেনে আনার কষ্ট করতে হতো না, বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি শক্তিশালী হতো, আবার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অর্থনীতিও চাঙা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থ দেখবে কে?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×