১...
প্রজাপতি ফুলে বসে থাকে।এই প্রজাপতি নিয়ম ভেঙে একটা কাঁচা পেঁপের উপর বসে আছে! ঠিক বসেও নেই, অবিরাম রঙিন পাখা ঝাপটাচ্ছে! একনাগাড়ে ঝাপটিয়েই যাচ্ছে। কেন?
একটু পরেই এটা উড়ে গেল। আমি লিখায় মনোযোগ দিলাম।আমি সাধারণত হেঁটে লিখি, রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা।
ফিরে এসেই দেখি, পেঁপেটা কাঁচা না, পাকা। একটা লাল ঝুটি বুলবুলি ঠুকরে ঠুকরে পেপে খাচ্ছে। আমি পাত্তা না দিয়ে লিখতে থাকলাম।
আশ্চর্য! একটু পরেই দেখি পেঁপেটার উপর যেখানে বুলবুলি খেয়ে গিয়েছে সেখানে প্রজাপতি বসে আছে।
তবে কি, পেঁপেটা পেকেছে সেটা প্রজাপতি আগেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পাকা পেঁপের স্বাদ পুরু খোসার জন্য নিতে পারছিল না। তাই পেঁপের উপর বসে ডানা ঝাপটিয়ে যাচ্ছিল! আসলে এটা ছিল একটা সিগনাল?
বুলবুলি বুঝতে পেরেছে সবুজ পেঁপেটা আসলে পাকা। সে ঠুকরে খেয়ে চলে যাবার পরই প্রজাপতিটার ফিরে আসা কি তাই প্রমাণ করে না?
২...
মিঠুন ডাক্তার অষুধের তাকে কিছু একটা খুজছেন, পাচ্ছেন না।
আসলে কিন্তু তিনি ডাক্তার নন, একটা কোর্স করে ফার্মেসি দিয়েছেন।সৃষ্টিকর্তা তাকে সফলতা দিয়েছেন। তার ব্যবসা ভালো, তার দিন ফিরেছে।তিনি ঢাকায় বাড়ি করেছেন। উনি মানুষ ভালো, মানুষকে ব্যবস্থাপনা ছাড়া অষুধ দিলেও নিজের পরিবারকে ডাক্তার না দেখিয়ে অষুধ খাইয়েছেন, আমি শুনিনি!
ছেলের স্কুল টিচার উনার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন," মিঠুন দা, আপনার ছেলে শোভনের প্রধান কাজ ক্লাসে জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকা। আমি আজ ওকে সরিয়ে দিয়েছি। মনোযোগী না হলে, আর যাইহোক পড়াশোনা হবে না।" তিনি হাসতে লাগলেন।
মিঠুন দেবনাথ বললেন,"স্যার, জানালার কাছে কি কেউ বসবে না? কেউ না কেই তো বসবেই! আপনি কি সব ছেলেদের এমন যত্ন নেন?"
শিক্ষক হকচকিয়ে গেলেন, তবে দমলেন না। তিনি বললেন,"দেখুন আপনার ছেলেটা বেশ অমনোযোগী,মিথ্যাও বলে খুব। আমি ভাবলাম....."
"আচ্ছা, আমার ছেলের কি ভালো কোন গুণ নেই? ক্লাসে কি কখনো সে পড়া পারে না? আমি খেয়াল করেছি আপনি সব সময় আমার কাছে শোভনের দোষ বলেন। দু'একটা ভালো গুণও বলবেন, আমার ভালো লাগবে।"
শিক্ষক মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
"দেখুন স্যার, আমি জানি আমার ছেলেটা অত্যন্ত অমনোযোগী, পড়াশোনা করে না, একটু দুষ্টও। ক্লাসে বকাঝকা করে শাস্তি দিলে লজ্জা কেটে যাবে। একটু বুঝিয়ে বলবেন, দেখবেন ও কত ভালো! এই বয়সটাই এমন, মিথ্যা বলবে, ফাকি দিবে, তর্ক করবে, বিব্রতকর প্রশ্ন করবে, নিজের মতামত জোরে বলবে, একদৃষ্টে কোন দিকে তাকিয়ে থাকবে, আরও কত কি! আমরা ভূলটা বুঝিয়ে ঠিক করে দিব, আপনারা ঠিক করে দিবেন। এজন্যই তো আমরা আছি, আপনারা আছেন।"
৩...
বেলা ১২ টা। ঝাঝা রোদে আমি মাজারের বাধানো পুকুর ঘাটে বসে আছি। এই সময় রোদ থাকে বলেই ঘাটে কেউ থাকে না। ঘাঁট ফাঁকা পাওয়া যায়।
আমি প্রায় সব কিছুর উপরই ত্যক্ত,বিরক্ত। বিরক্তি চরম সীমায় পৌঁছালেই এখানে বসে থাকি। আজও বসে আছি।
আমার থেকে একটু দূরেই একজন লোক বসে আছেন। পানিতে পা ডুবিয়ে, মাথা ভাজ করে দু'হাটুর ভিতরে প্রায় পুরে দিয়েছেন। একটু পরপর নাক টানছেন, ঐতো আমরা কান্নার সময় যেমন টানি আরকি।
দুপুর দুটো, উনি সেভাবেই আছেন। আমি এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
:আপনি কাঁদছেন? আপনার কি খুব মন খারাপ? আমার সাথে কথা বলুন, ভালো লাগবে।
:আমাকে একা ছেড়ে দিন। আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। আর কথা বলার কিছু নেইও!
শ্যামলা রঙ, বেশ বড় একটা চশমা পড়া, সদ্য শেভ করা চকচকে মুখটায় চোখদুটো টলমল করছে।
:আপনি কোন কারণে বিরক্ত? কার উপর বিরক্ত? বলুন, মন হালকা হবে।
:আমি নিজের উপর বিরক্ত।
আমি আস্তে আস্তে উনার কাছ থেকে সরে এলাম। পাড় পেলাম কই, সাথে নিয়ে এলাম নিজের প্রতি বিরক্ত হবার ভয়ানক রোগ!
৪...
আমি আর ও পাশাপাশি বসে আছি। এইতো সেদিন এতটুকু ছিল! রাতে আমাদের সাথে ঘুমাতে আসতো, গল্প বলতে হত সাপের, বাঘ-সিংহ-শিয়ালের, ভূত, রাজকন্যা আর কত কিছুর! মাঝরাতে কান্না জুড়ে দিত, ও মায়ের কাছে যাবে।
এখন বড় হয়ে গেছে, উচ্চতা আমার সমান!
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"গেন্দা, আব্বুর কথা মনে হয় না?"
"হয় মাঝেমধ্যে! যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, বা কোন বান্ধবীকে ওর বাবা স্কুলে নিয়ে আসে।এখন আর মনে হয় না।"
আমার মন ভেঙে যায়, কত সহজে তারা মানিয়ে নিয়েছে। কাকার সাথে ওদের কথা নেই, দেখা নেই প্রায় ৩ বছর।
অথচ বাবু, গেন্দা, বেবির সাথে একদিন কথা না হলে আমার বেশ অস্বস্তি লাগে। তিনজনই মায়াভরা গলায় "ভাইয়া" ডাকে। এটা শুনে ভীষণ মন খারাপ থাকলেও মন ভালো হয়ে যায়!
কাকা কিভাবে থাকতে পারেন, কে জানে?
"ভাইয়া, ভাই আর আব্বুর মাঝে পার্থক্য জানো?"
"নাতো!"
"ভাই তুচ্ছ কারণে ছেড়ে যায় না, আব্বু চলে যায়। কথাও বলে না। আব্বুর সাথে কথা হয় না, খারাপ লাগে না। তোমাদের সাথে কথা না হলে, মন খারাপ লাগে। জানো, নিহান বেবিও বলে," আম্মু, ভাইয়ারে একটা ভিডিও কল দেও। ভাইয়ার জন্য আর পেট কেমন করে।"