রাজনীতির নামে হত্যা করে বুকের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস থেকে শুরু করে ধর্মের নামে বিনা বিচারে পিটিয়ে হত্যা, এরপর আবার লাশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া - আমি দুটোকেই মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।
সম্প্রতি কয়েকদিন আগে লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সারা বাংলাদেশের সকল মানুষ। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নে এক ব্যক্তিকে কোরআন অবমাননা তথা ধর্মীয় স্বার্থে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে একদল লোক একত্রিত হয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং সবশেষে তার লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাটি ভাবলেই নিঃসন্দেহে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
ভদ্রলোকের নাম শহীদুন্নবী জুয়েল, বয়স ৩৭, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ৯৪ ব্যাচের সাবেক ছাত্র। দুই সন্তানের জনক এই ব্যক্তি মূলত রংপুর জেলার মানুষ। সেই জেলারই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের লাইব্রেরীয়ান পদে চাকুরীরত ছিলেন তিনি। কিন্তু চাকুরীরত অবস্থায় তার মানসিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে তার চাকরি চলে যায়।
কয়েকদিন আগে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার সেই মানসিক অবস্থার বিপর্যয়ের কারণেই ঘটেছে (অর্থাৎ মসজিদে ঢুকে নিজেকে র্যাব পরিচয় দিয়ে মসজিদে অস্ত্র লুকানো আছে বলে খুজাখুজি শুরু করেন, এই সময় অসাবধানতাবশত মসজিদের র্যাকে থাকা পবিত্র কোরআন শরিফ নিচে পড়ে যায়, এতে এই মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে তার বাকবিতন্ডা শুরু হয়, পরে উত্তেজনা মুসল্লিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জুয়েল ও জুবায়ের নামক দুইজনকে নিজ হেফাজতে নিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করলেও উত্তেজিত হাজারো জনতার কাছে ব্যর্থ হয় এবং উত্তেজিত জনতা জুয়েলকে টেনে হিচড়ে নিয়ে লাঠি, ইট ইত্যাদি যে যা পেরেছে তাই দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং তাতেও যেন তাদের ক্ষোভ মেটেনি, পরে সেই লাশে তারা আগুন ধরিয়ে দেয় - কথাসূত্র - ঐ মসজিদের খাদেম সাহেব ও ঐ এলাকায় দায়িত্বরত ওসি সাহেব)। এরকম জঘন্য কর্মকান্ডের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লেও এই পোস্টের সাথে শেয়ার করার কোন ইচ্ছে নেই আমার।
এই ঘটনার পর যেন পুরো অনলাইন দুনিয়া উত্তাল হয়ে পড়েছিল। ফেসবুকেও বিভিন্ন মানুষ এই ঘটনার জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অনেককেই দেখলাম জুয়েল এর পিছনে দায়ী জনতাকে চিহ্নিত করে তাদেরকেও বিনা বিচারে মেরে ফেলার বা ক্রসফায়ার করার কথা বলছে!! এটা বড়ই অদ্ভুত দাবী। কারণ কোন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই সমর্থনযোগ্য নয়। এই নির্মম ঘটনার জন্য দেশে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষমূলক কর্মকান্ড ও বক্তব্যের জন্য আইনের শক্ত প্রয়োগে শিথিলতা এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের অনাস্থাই অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে কিছু নিউজ মিডিয়া আর ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তি, এই ঘটনা নিয়ে নানারকম পোস্ট করে জাতীকে বিভ্রান্ত করে চলেছিল। যেমনঃ কেউ বলছিল রংপুরের ছেলে জুয়েল কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়, এরপর তাকে লালমনিরহাটে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়, আরেক নিউজ মিডিয়া বলছিল, সে নাকি রংপুর থেকে লালমনিরহাটে বেড়াতে গিয়েছিল। আবার তার সাথে রংপুর থেকে যে বন্ধু লালমনিরহাট যায় তার নাম সুমন, অথচ বুড়িমারী ইউনিয়নের ঐ মসজিদে তাকে হত্যায় সময় তার সাথে যে ছিল তার নাম জুবায়ের, তাহলে সুমন মানে তার বন্ধু ঐ সময় কই ছিল? আর জুবায়েরকে পুলিশ উদ্ধার করে হেফাজতে নিতে পারলেও এই ব্যক্তির জবানবন্দি কেন পাবলিক করা হচ্ছে না? যেখানে স্বয়ং পুলিশ বলছে ঘটনার প্রকৃত কারণ তদন্ত করে বলা যাবে, সেখানে সবাই দেদারছে লিখেই চলেছিল আসলে কোরআন অবমাননা নয় বরং মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে জুয়েল না বুঝেই কোরআনে পা দিয়েছিল (যদিও কোরআনে পা দেওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটেনি, এটা স্বয়ং ঐ মসজিদের খাদেম সাহেবই বলেছেন)। এরকম নানারকম সংবাদ ছড়িয়ে ঘটনাকে অন্যখাতে সরিয়ে দেওয়ারও অপচেষ্টা হতে পারে।
তবে খারাপ লেগেছে কিছু ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তিবর্গের পোস্ট কিংবা কমেন্ট দেখে। আমি নাস্তিক শব্দটা ব্যবহার করবো না এক্ষেত্রে, এটা নাস্তিকতা না, পরিস্কার ইসলাম বিদ্বেষ। তারা বলছিল, ফ্রান্স নবীকে নিয়ে যে কঠোর অবস্থান নিয়ে মুসলমানদের প্রিয় নবীর ব্যাংগচিত্র প্রদর্শন করছে, সেটা আদৌ অযৌক্তিক নয় কারণ প্রকৃতপক্ষে ইসলাম তো এমনই। ধর্মীয় শিক্ষার কারণেই তো মুসলিমদের এত অধঃপতন। তাদের জন্য নিচে কোরআনের আয়াতের একটা ছবি দিয়েছি।
আল্লাহ বলেছেন, কেউ যদি অহেতুক কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করলো (সে যে ধর্মেরই হোক না কেন), সে যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করলো। জী, হ্যা, এটাই ইসলামের শিক্ষা। আপনি আমার বা মুসলমান একজন ব্যক্তির অনর্থক আচরণ দেখে ইসলামকে যাচাই করতে পারেন না, ইসলামকে যাচাই করুন আল্লাহ ও রাসূলের কথা ও শিক্ষা দ্বারাই। পারতপক্ষে কোন ধর্মই হিংসা ও বিদ্বেষের শিক্ষা আদৌ দেয়না।
তাই অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানাচ্ছি, যাতে এমন ঘটনা পুনরায় আর কখনোই না ঘটতে পারে। পাশাপাশি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার আদ্যোপান্ত জাতির সামনে দ্রুততার সহিত উন্মুক্ত করারও দাবী জানাচ্ছি
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৩০