পহেলা জুন। অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি ঘটনার মুখোমুখি হলাম আমি। সাথে ছিলো গভীরতর আনন্দানুভূতি এবং আবেগভরা কৃতজ্ঞতাবোধ। এমনটি ভাবিনি, যেমনটি ঘটেছে। মূল উদ্যোক্তা বন্ধু মাখন এবং সায়লা, সাথে ক্যালগেরিবাসী এদিন যা করেছে তা আমাকে বড় বেশী ঋণী করে রেখে দিলো। দিনটি ছিলো আমার জন্মদিন। সাতচল্লিশতম। আর এবারের এ দিনটি তারা সকলেই আমাকে যেভাবে চমকপ্রদ মোড়কে উপহার দিয়েছে সেটা শুধু আমি কেনো, যে কারো জন্যই সুখপ্রদ।
নিজের জন্মদিন নিয়ে আমার তেমন একটা আগ্রহ কখনোই ছিলো না। এক সময় কর্মক্ষেত্রে এতো্টাই ব্যস্ততম মানুষ ছিলাম যে, তেমনটি ভাবার ফুরসৎও ছিলো না। টানা সুদীর্ঘ সতেরো বছর ইত্তেফাক ভবনের কর্মময় জীবনে দিন এসেছে দিন চলে গেছে কাজ, কাজ আর কাজের স্রোতের টানে। ভবনটিতে সকালে ঢোকার পর কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতো, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, এরপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত; তা টেরও পেতাম না। তৎকালীন সময়ে দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা রোববার এবং দেশের প্রধানতম জনপ্রিয় ও সর্বাধিক প্রচারিত ক্রীড়া পত্রিকা পাক্ষিক ক্রীড়ালোকের শীর্ষ পদে থেকে পত্রিকা দুটো পরিচালনার পাশাপাশি নিজের মৌলিক লেখালেখি চালিয়ে যারার পর 'জন্মদিন' নিয়ে ভাবার মতো সময় বের করা ছিলো বড্ড কঠিন। দিনে দিনে কর্মক্ষেত্র যতোই প্রসারিত হয়েছে, ততোই নিজের জন্য সময় ব্যয় করার পরিধি কমে এসেছে। রোববার ও ক্রীড়ালোকের পাশাপাশি এক সময় দৈনিক ইত্তেফাকের অনেকগুলো পাতার দায়িত্বও কাঁধে এসে চাপলো। অন্যদিকে একই সাথে দুঃসাহসী মনটা আবার পা বাড়ালো ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার আঙ্গিনায়। সব মিলিয়ে পরিণত হয়ে গেলাম রীতিমতো এক যন্ত্র-মানবে। আমার এই কর্মব্যস্ত জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কবি প্রয়াত শামসুল ইসলামের একটি মন্তব্য বেশ মনে পড়ে। তিনি তখন বাংলার বাণী পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর পত্রিকার প্রকাশিতব্য একটি বিশেষ সংখ্যার জন্য চেয়েছিলেন একটি ছোট গল্প। সময় মতো দিতে পারিনি। একদিন নিজেই আমার অফিসে এসে হাজির। গল্পটি সময় মতো না পাবার জন্য একটু আক্ষেপ করে নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, 'আঁর লগে বাইচালি করিছ না। আঁই জানি তর দূর্গার মতোন দশখান হাত, একখান হাত লাগাইলেই কাইলকার মধ্যে লেখাডা দিতে হারবি।' এ সময় অফিসে বসা রোববার-এর সহকারী সম্পাদক গোলাম আম্বিয়া ভাই ইসলাম ভাইকে বলেছিলেন, 'নীরু ভাইয়ের দশটা হাত সব সময় এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে, একটা হাতেরও অবসর মেলা মুস্কিল। তার ওপর চলছে রোববার এবং ক্রীড়ালোকেরও বিশেষ সংখ্যার কাজ'।
'আঁই অত-শত বুঝিনা, কাইলকার মইধ্যে লেখা ছাই, ব্যস।' ইসলাম ভাইয়ের স্বভাবসুলভ সোজা-সাপ্টা উচ্চারণ। উপেক্ষা করা ছিলো অসম্ভব। বাংলাদেশের আর কেউ পেরেছে কি না আমার জানা নেই। পরিদিন ঠিকই লেখা দিয়েছিলাম ইসলাম ভাইকে তবে সারারাত জাগতে হয়েছিলো সে জন্য।
বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে তেমনিতর ব্যস্তময় কর্মজীবনে জন্মদিন আসতো, যেতো কখনো সরবে, কখনো নীরবে। কোনোটা পালন করা হতো, কোনোটা হতো না। পরিবার বা সহকর্মীদের পক্ষ থেকে আয়োজন হতো, কিন্তু দিনটি যদি হতো রোববার বা ক্রীড়ালোকের পেষ্টিংয়ের দিন তবে সেখানেও সময় দেয়া দুস্কর হতো।
দেশ ছেড়ে কানাডা চলে আসার পর ঘরোয়াভাবে বছর দুয়েক জন্মদিনের আয়োজন হয়েছে। এরপর ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়-ঝাপ্টার কারণে জন্মটাকেই যখন অসহ্য মনে হতে লাগলো তখন জন্মদিনের প্রতি তিলপরিমান আগ্রহও আর আমার অবশিষ্ট রইলো না। এরই মাঝে আমার এক সময়ের একজন কাছের মানুষ ঠিক এ দিনটিতেই ঘটিয়ে বসলো সভ্যতাকে হতবাক করে দেবার মতো এমন একটি অমানবিক ঘটনা, যা আমাকে যারপর নাই আহত করলো। 'জন্মদিন' আমার জীবনে পরিণত হলো 'যন্ত্রণাময় দিন'-এ। তার ওপর প্রাণপ্রিয় সন্তানটি আমার কাছে নেই। যে শিশুটি আমার এবং নিজের জন্মদিন এলে সব চাইতে বেশী খুশী হতো। যা হোক, এরপর মন্ট্রিয়লে থাকাকালীন জীবনে নেমে এলো অসুস্থতার কালো থাবা। লাগাতার অসুস্থ। বন্ধু মাখন ও সায়লার আমন্ত্রণে অসুস্থ শরীর নিয়েই মন্ট্রিয়ল ছেড়ে ক্যালগেরিতে আসা। বর্তমানে তাদের সাথেই বসবাস। সেটাই আমার নিবাস।
যা বলছিলাম, আমার আগ্রহ থাক বা না থাক, প্রতিবারের মতো এবারের পহেলা জুনেও রাত বারোটার পর থেকে দেশ-বিদেশের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভান্যুধ্যায়ীদের নিকট থেকে যথারীতি ফেসবুক, ই-মেইল, টেলিফোনে পাচ্ছিলাম 'শুভকামনা'। অন্যদিকে বন্ধু সায়লা এবং মাখন দিনটি নিয়ে তেমন একটা উচ্চ-বাচ্য করছিলো না। তারা জানতো জন্মদিনটির প্রতি আমার অনিহার কথা। তবে দিনটি উপলক্ষ্যে সায়লা আমাকে চমৎকার একটি সার্ট ও মাখন একটি টি-সার্ট ও প্যান্ট কিনে দিলো এবং অনেকটা আবদারের সুরে সায়লা বললো, 'আপনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ আমরা বাইরে ডিনার করবো।'
আমি রাজি হলাম। দিনটি ছিলো কানাডায় ছুটির দিন। সায়লার কিনে দেয়া সার্ট আর মাখনের দেয়া প্যান্ট পরে ওদের সাথে সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ বেরুলাম। সাথে ওদের দুই সন্তান আঁচল ও আবেশ। ওরা আমাকে নিয়ে হাজির হলো ক্যালগেরি শহরের নর্থ-ইস্টের একটি পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট আল-মুনির-এ। আমি বেশ অবাক হলাম! কেননা, ক্যালগেরিতে আসার পর থেকে আমরা প্রায় প্রতি সপ্তাহের একটি বন্ধের দিন বাইরে ডিনার করি। অসুস্থতার কারণে আমি স্পাইসি ফুড খেতে পারি না বলে ওরা আমাকে নিয়ে ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে কখনোই যায় না। চায়নিজ-এর মধ্যেই আমাদের ঘোরাঘুরি। কিন্তু আজ পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট!
প্রশ্নটা সায়লাকে করতেই ও বললো, এখানে একটা স্যুপ খেয়ে আমরা 'এশিয়ান চায়নিজ' রেস্টুরেন্টে যাবো। যা ক্যালগেরির অন্যতম সেরা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। আমি মেনে নিলাম ওর কথা।
তবে আল-মুনির রেস্টুরেন্টটিতে ঢোকার পর সব টেবিলে 'রিজার্ভ' সাইন দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। দেখলাম লম্বা একটা টেবিলের শেষ মাথার একটি চেয়ারের সাথে আঁটা 'HAPPY BIRTHDAY' লেখা একটা বিশাল বেলুন। আরো অবাক হলাম, সায়লা যখন আমাকে সেই চেয়ারটাতেই বসতে বললো। আমি জানতে চাইলাম, আসলে ব্যাপারটা কি?
সায়লা অনেকটা ভয়ে ভয়ে বললো, আপনার বার্থডে উপলক্ষ্যে এখানে একটা আয়োজন করেছি। এ রেস্টুরেন্টটা আজকের জন্য আমরাই রিজার্ভ করেছি। সায়লার কথায় আমি হতবাক! এরপরই শুরু হলো ক্যালগেরির বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের আগমনের পালা। একে একে স্বপরিবারে এলেন ক্যালগেরিস্থ বাংলাদেশ সোসাইটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল্রাহ রফিক চৌধুরী, সাবেক সভাপতি আলম খন্দকার, বিশিষ্ট সংগঠক ও সমাজসেবক কয়েস মিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক সময়ের সাড়া জাগানো ফুটবলার রকিব হোসেন, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কর্মকর্তা জুবায়ের সিদ্দিকী ও ব্যবসায়ী মাহামুদ হাসান ফারুক প্রমূখ। সবাই আমার শুভান্যুধ্যায়ি। আমি আরো অবাক হলাম, এদের কারো কারো সাথে একদিন আগে টেলিফোনে আমার কথা হলেও কেউই আমাকে কিছুই জানতে বা বুঝতে দেননি। আসরে আমাকে জানতে না দেয়াটা ছিলো মাখন ও সায়লার পরামর্শে সকলেরই সম্মিলিত একটা পরিকল্পনা।
আল-মুনির রেস্টুরেন্টটি খানিকবাদেই ভরে উঠলো ক্যালগেরিবাসীর পদচারণা আর তাদের সন্তানদের কলকাকলিতে। আগতদের আন্তরিক ফুলেল শুভেচ্ছা, উপহার আর ভালোবাসাসিক্ত উচ্চারণ আমাকে সত্যিই আবেগাপ্লুত করে তুললো। আমি ভুলে গেলাম আমার 'জন্মদিন'-এর যন্ত্রণাময় অধ্যায়কে। মিশে গেলাম এক চমকপ্রদ সুন্দর সময়ে উৎসবমুখর উচ্ছ্বসিত হৃদয়গুলোর মাঝে। যদিও শরীরটা তেমন একটা ভালো ছিলো না, তারপরও মেতে উঠলাম হাসি, আনন্দ আর আড্ডায়। আগত সকলেই আমার আশু সুস্থতার জন্য দোয়া করলেন। এটা তারা সব সময়ই করছেন। এদিকে, আমি একটা বিষয় ভেবে অবাক হলাম যে, একই পরিবারের সদস্য হয়ে, এতো কাছে থেকেও আমি মাখন ও সায়লার এতোবড় আয়োজনের কিছুই টের পেলাম না! আগের রাতে সায়লা মিষ্টি বানিয়েছে। সেও জন্মদিনের জন্য! ও খুব ভালো মিষ্টি বানায়। আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে সেফওয়েতে বিরাট কেকটার অর্ডারও দিয়ে এসেছে। যদিও কেক নির্বাচন এবং অর্ডারের সময় আমাকে সে পাশে রাখেনি। আমি সত্যিই বিস্মিত এবং একই সাথে অভিভূত! এ জন্য শ্রদ্ধাপূর্ণ কৃতজ্ঞতা বন্ধু মাখন ও সায়লার প্রতি। যারা আমাকে অসুস্থ জানা সত্বেও অনেক দূর থেকে কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। যাদের প্রতি আমার ঋণের বোঝা প্রতিদিনই ভারি হচ্ছে। এ দিনটিতে আমি আরো বিশেষ কৃতজ্ঞ ওয়েষ্ট উইন্ডের সকল স্টাফদের প্রতি। যাদের সাথে আমার গড়ে উঠেছে একটা চমৎকার সম্পর্ক। যারা প্রতিনিয়ত আমার অসুস্থতার খোঁজ-খবর নেন। আমার জন্য দোয়া করেন। এদের অধিকাংশই ইন্ডিয়ান এবং কয়েকজন ফিলিপিনো। এবং দু'জন ছাড়া সবাই মহিলা। এ টিমহর্টন্সে আমি প্রতিদিন সকালে বসি এবং গ্রিণ-টি'র কাপে চুমুক দিতে দিতে লেখালেখি করি। অপরদিকে সায়লার বন্ধুও ওরা। সেসূত্রে আমার জন্মদিনের কথাটাও তাদের জানা ছিলো। পহেলা জুন আমি কফিশপটিতে ঢোকার সাথে সাথে তাদের বিশ জনের সবাই একে একে যেভাবে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো তাতে আমার কাছে মনে হলো, আমি যেনো তাদের কতো যুগের আপনজন!' পরিশেষে আবরো কানাডাসহ দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভান্যুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ ফেসবুক, ই-মেইল, টেলিফোনে যারা আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমি সকলের দোয়া চাই; যতোদিন বেঁচে আছি এভাবেই সকলের মনে বসত চাই। সবার জন্য 'শুভকামনা'।
-৬ জুন, ২০১৩
মাহাবুবুল হাসান নীরু
[email protected]
৭৪, মার্টিনরিজ ক্রীসেন্ট, ক্যালগেরি, কানাডা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৩ ভোর ৪:১৬