somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিমালয়ের দেশে (র্পব-৩০)

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নাগরকোট এবং ভক্তপুর
ভ্যাট ভ্যাটানি ভিজিট শেষে আমরা ছুটলাম নাগরকোটের উদ্দেশ্যে। কাঠমন্ডু শহর থেকে পূর্বদিকে ৭ হাজার ১৩৩ ফুট উঁচু স্থান হচ্ছে এই নাগরকোট। প্রাইভেট কার চলছে সা সা গতিতে। পাহাড়ের গা ঘেষে আমাদেরকে নিয়ে গাড়ি ক্রমেই উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার দিকে। উঁচু পাহাড়ের শীর্ষদেশে এরকম পাকা রাস্তা ভাবাই যায় না। পরে জেনেছি, এ পথেরই একটি শাখা চলে গেছে চীন পর্যন্ত। কাঠমুন্ডুর কেন্দ্রস্থল থেকে নাগরকোটের দূরত্ব প্রায় ৩১ কিলোমিটার। নাগরকোট পৌছতে আমাদের প্রায় পৌনে ৩ টা বেজে গেল। আমরা নাগরকোট ভিউ পয়েন্টে উঠলাম। আসার পথে ড্রাইভার আমাদেরকে জানিয়েছিল, নাগরকোট ভিউ পয়েন্ট থেকে দূরে কাঠমুন্ডু শহর দেখা যায়।

(কাঠমুন্ডু টু নাগরকোট)
বৃষ্টির পর আকাশ পরিস্কার থাকলে এখান থেকে পুরো হিমালয় এবং বরফাচ্ছাদিত এভারেস্ট চূড়া দেখা যায়। কপাল আমাদের মন্দ। আকাশ পরিস্কার না থাকায় বলতে গেলে তেমন কিছুই দেখা গেল না। দুধের সাধ গুলে মিটিয়ে আমরা নেমে এলাম। বেলা তিনটা পেরিয়ে গেছে। যোহরের নামায পড়া হয়নি। তাই আমরা অযু করার জন্য পানি খোঁজাখোজি শুরু করলাম। এটাতো আর বাংলাদেশ নয় যে আশেপাশে মসজিদ পাওয়া যাবে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেও পানির কোন উৎস পাওয়া গেল না। শেষে সিদ্ধান্ত হল মিনারেল ওয়াটার কিনে অযু করে নামায পড়ব। এর মধ্যে নজরে এল নিচে আরেকটি পাহাড়ে উপর সমতল জায়গায় একদল ছেলে-মেয়ে হৈ চৈ করছে। খেয়াল করে দেখলাম পিকনিক পার্টি। ভাবলাম সেখানে নিশ্চয়ই পানির কোন ব্যবস্থা থাকতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। দেখলাম, সত্যিই সেখানে পানির একটি হাউজ আছে। চৌবাচ্চার পানি এখানকার হিন্দুরা ব্যবহার করে। এই পানিতে অযু করব কি করব না-এই যখন ভাবছি। তখন দেখলাম পিকনিকে আসা দুটি স্কুল বয় নিকটস্থ পাহাড়ের গর্ত থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল ভর্তি করে পানি আনছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। সোবহানাল্লাহ্! একেবারে টলটলে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা। আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ রইলো না। হাতের মিনারেল ওয়াটারের বোতলে থাকা পানি টুকু গলায় ঢেলে দিয়ে ঝর্ণার পানিতে তা পূর্ণ করে নিয়ে দুজনে অযু সেরে নিলাম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের ভাষা নেই। সমতল থেকে ৭ হাজার ফুটেরও বেশি উপরে এই পাহাড়ের হৃদয় থেকে কিভাবে নিংড়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি! সোবহানাল্লাহ্।

নাগরকোট যাওয়া ও আসার পথে কাঠমন্ডুর পার্শ্ববর্তী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর ভক্তপুর। সেখানে আছে অনেক মন্দির ও প্রাচীন রাজবাড়ি। সেগুলো বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সংরণ করা হয়েছে। ভক্তপুর রাজবাড়ির একটি মন্দিরে আছে বিখ্যাত কামসূত্রের ভাস্কর্য সিরিজ। রাজবাড়ির ভেতরে বড় বড় দীঘি। সেগুলোতে ছাতার মতো ফণা তুলে আছে পিতলের সাপ। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্যাগোডার একটি নয়াটোপলা মন্দির। এ সবই এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ।

নেপাল জামে মসজিদ: ক্যাম্পাসে গুমড়ে মরে আযানের ধ্বনী
কাঠমুন্ডুর বাঘ বাজার এলাকায় শহরের বড় বড় দুটি মসজিদ অবস্থিত। প্রথম দিন আমরা মসজিদ কমপ্লেক্স ঘুরে গেছি কিন্তু নামাযের ওয়াক্ত না হওয়ায় আযান শ্রবণ কিংবা সালাত আদায়ের সুযোগ হয় নি। তাই নিজের মাঝে যেন কিছুটা অতৃপ্তি কাজ করছিল। বছর দুয়েক আগে কুয়ালালামপুরের বিখ্যাত মসজিদে জামেক আমরা ভিজিট করেছিলাম কিন্তু সেখানে জামাআতে সালাত আদায় না করার একটা অতৃপ্তি এখনও মনে বাজে। তাই ফিরে আসার আগের দিন আমরা পরিকল্পনা করলাম কাঠমুন্ডুর জামে মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায়ের। পরিকল্পনামতে, আমরা সন্ধ্যা ৭টার আগেই মসজিদে পৌছে গেলাম। মসজিদের নিচতলায় অযু সেরে উপরের তলায় নামাযের জন্য উঠলাম। জুন মাস, দিন এখন বেশ লম্বা। মাগরিবের ওয়াক্ত হতে বেশ দেরি হয়। আমরা মসজিদ কমপ্লেক্সে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। ছবি তুললাম। মসজিদ কমপ্লেক্সটি বেশ বড়। সাথে রয়েছে তিনতলা মাদ্রাসা। এখানে এসে নিজেকে বেশ নিরাপদ এবং নির্ভার মনে হল। এ পরিবেশ আমাদের কাছে চিরচেনা। অযু সেরে সিক্ত হাত পা, জুতা হাতে মুসুল্লিরা ঢুকছে, সু রেকে জুতা রেখে হাত পায়ের পানি মুছতে মুছতে মসজিদে ঢুকছে। এখনও আযান হয়নি বলে কেউ কেউ মসজিদের সামনে খোলা জায়গায় পায়চারি করছে। পরিচিত জনেরা কোথাও কোথাও ২/৪ মিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা-বার্তা বলছে। সত্যি কি, মসজিদ কমপ্লেক্সে ঢুকার পর আমার কাছে আর বিদেশ বিদেশ লাগছে না। যেন আমি আমার চিরচেনা পরিবেশেই আছি। স্থানীয় একজন হুযুরমত লোককে জিজ্ঞেস করলাম মাইকে আযান হয় কিনা। সে জানাল আযান মাইকেই হয় তবে তার শব্দ যেন বাইরে না যায় সে ব্যাপারে রয়েছে কড়া নির্দেশনা। এতক্ষণে আমাদের কাছে ক্লিয়ার হল মসজিদের সুউচ্চ মিনার আছে কিন্তু তাতে মাইকের কোন হর্ণ সেট করা হয়নি কেন। লোকটি আমাদের কাছে জানতে চাইল আমরা কোত্থেকে এসেছি। জানালাম বাংলাদেশ। সে এবার জিজ্ঞেস করল আমরা জামায়াতে (অর্থাৎ তাবলিগ জামায়াত) এসেছি কিনা। আমরা নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সংক্ষেপে বললাম, No; for visit। আযান হল ৭ টা ৪-এ। মাদ্রাসার ওয়ালের সাথে লাগানো এবং মসজিদ চত্বরের দিকে মুখ করা ছোট্ট হর্ন দিয়ে ভেসে আসছিল মাগরিবের আযান। সেই চিরচেনা শব্দমালা। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে ইতিহাসে সর্ব প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন সাইয়্যেদুনা হযরত বেলাল ইবনে রবিহ্ (রা.)। অবাক ব্যাপার! মানুষে মানুষে বংশ, গোত্র আর বর্ণের ভেদাভেদ মুছে ফেলতে রাহমাতুল্লিল আলামীন (সা.) অসংখ্য সুন্দর চেহারার অভিজাত বংশের সাহাবীকে বাদ দিয়ে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিনের গৌরব মাল্য পড়ালেন এক কালো হাবসী গোলামের গলায়। তারপর পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর। কিন্তু আযান সেই একই। কবি কায়কোবাদের ‘আযান’ কবিতায় কী চমৎকার কথা বলা হয়েছে:
কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!

আমরা জামায়াতের সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। ইমাম সাহেব প্রথম রাকাআতে সম্ভবত সূরা তাকাসুর পড়লেন। এক আল্লাহ, এক নবী, একই জীবন বিধানের অনুসারী সারা বিশ্বের মুসলমান। সালাতে দাঁড়িয়ে ছোট-বড়, সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন, চাকর-ভৃত্য, দেশী-বিদেশী সব এক কাতারে লীন। কবির ভাষায়,

একহি সফমে খারে হুয়ে মাহমুদ আয়াজ
নাকুই বান্দা আপনা নাকুই বান্দা নাওয়াজ

সুলতান মাহমুদ গজনভী ছিলেন একাদশ শতাব্দিতে পারস্য, আফগানিস্থান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলের পরাক্রমশালী শাসক ও বিজেতা। সুলতান মাহমুদের এক গোলামের নাম ছিল আয়াজ। সে ছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। পার্থিব দিক থেকে তাদের মধ্যে ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল। কিন্তু সালাতের জামাতে উভয়ে যখন মুসল্লি তখন তারা দুজনই একই কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করেন। এখানে গোলাম আর মনিবে কোন পার্থক্য থাকল না।

(চলবে)
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×