somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীরূপে জানাই অভিশাপ ?

০৬ ই জুন, ২০১০ রাত ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অদ্য একত্রিশ পাঁচ দুইহাজার দশ হইতে সিগ্রারেট খাওয়া ছাড়িতেছি। গতকল্য ত্রিশ তারিখটিকেই ধরিতেছি শেষ ধূমপান দিবস হিসেবে । ইহা আমার জন্য পুরাতন কোন ঘটনা নহে। আগে দুই দুইবার সিগারেট ছাড়িয়াছি। ধূমপানের মতো বদঅভ্যাস ছাড়িয়া থাকিতে পারিলে তাহা এক বীরত্বের কাজ হইবে এমনও ভাবিয়াছি। কিন্তু অবশেষে ব্যর্থ হইয়াছি। একবার সাতমাস, অন্যবার একমাস। সিগারেট ছাড়িয়া পূত পবিত্র হইয়াছিলাম। সিগারেটের গন্ধ বিশ্রি লাগিত। ধূমপায়ীদিগকে কাপালিক মনে হইতো। ধরিতাম উহারা অপ্রকিতিস্থ ও নরকগামী। আমি ওই দোষে আর দুষ্ট নই। প্রথমবার সিগারেট ছাড়িবার বেলায় অন্তর্জাল ঘাটিয়া বহু মাল মশলা বাহির করিয়াছিলাম ধূমপানের বিপক্ষে। বিশেষত তাহা আমার নিজের মনকে বশ করিবার নিমিত্তে। সিগারেট খাইলে কীভাবে ক্যান্সার আক্রমণ করে, কীভাবে গ্যাস্ট্রিক হইতে আলসার হয়, কিংবা সিগারেট কিরূপে রক্তসঞ্চালন ক্রিয়ার মধ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখিয়া নিজেকে অপরিহার্য করিয়া তুলিতেছেÑ তথ্য বাহির করিয়া নিকটতম ধূমপায়ীদের মাঝেও বিস্তারের প্রয়াস লইয়াছিলাম। ওইবার মন বেশ শক্ত হইয়াছিল। ধূমপান করিতেছি না ইহা নানাভাবে ব্যাখ্যা করিতাম বন্ধু মহলে। উহারা বিশ্বাস করিত এবং মজা করিয়া সিগারেটে টান মারিত। আমি একজন অধূমপায়ী হিসেবে দোটানায় পড়িয়া উস্খুস্ করিতাম আবার অটল থাকিবার জন্য দৃঢ়সংকল্পও হইতাম। কেহ একজন বলিয়াছিল, ধূমপান ছাড়িয়া প্রথম ছয়মাস পার করিতে পারিলেই জয়ী হওয়া যাইবে। আর ধূমপান ধরিবার ইচ্ছা ও সম্ভাবনা থাকিবে না। ইহা বিশ্বাস করিয়া ছয়মাস পার করিলাম। মন হইতে সিগারেট তখন লক্ষ যোজন দূরত্বে। একেবারেই সিগারেটের স্বাদ ভূলিয়াছি। স্মৃতিতে সিগারেট দুর্গন্ধময় এক ক্ষতিকারক হিসাবে রহিয়াছে। এক বাউল বন্ধু চায়ের দোকানে বসিয়া দুধ চা শেষে সিগারেট অফার করিল। আমি সহজে, বলিলাম বহুদিন হয় ছাড়িয়া দিয়াছি। বন্ধুটি খুব বেশি অনুরোধ না করিয়া বলিল, একটি খাইলে কী এমন ক্ষতি হইবে ? আকস্মিকই যেন একমত হইয়া গেলাম। এমন শক্ত মন সহজেই সিগারেটের পক্ষে বশে আসিবে ইহা আমি কস্মিনকালেও ভাবি নাই। বহুদিন পর সিগারেটটিতে টান মারিয়া দারুণ অপরাধবোধে পড়িলাম, মুখ দুর্গন্ধে ভরিয়া গেল, গলাও ধরিল কিছুটা। ডান হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে গন্ধ ঢুকিয়া পড়িল। ওই দিন আমার ধূমপান ত্যাগ করিবার সাত মাস চলিতেছিল। মধ্যখানের সাতমাস যেন মুহূর্তে জোড়া লাগিয়া গেল। ওইখানেই বসিয়া দ্বিতীয় সিগারেট ধরাইলাম। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার ভালো স্বাদ পাইলাম। একেবারে স্বাভাবিক স্বাদে ফিরিয়া আসিলাম কয়েক ঘন্টা পর বন্ধুমহলে চা খাইতে বসিয়া। আমি সিগারেট ছাড়িয়াছিলামÑ বিষয়টি প্রসঙ্গেই আনিলাম না। একদিনের জন্য কুষ্টিয়া গিয়া এই দুর্ঘটনা ঘটিল। ঢাকায় ফিরিয়া বিষয়টিকে সুখকর ঘটনায় পরিণত করিলাম।
অফিসের এডিট প্যানেলের ছোট্ট বারান্দায় সিগারেটে টান মারিয়া অদ্ভুত মজা আস্বাদন আবার শুরু হইলো। বাসা হইতে বাহির হই। রিক্সায় চাপিয়া আয়েশ করিয়া সিগারেট জ্বালি। মুখ ভরিয়া ধোঁয়া গ্রহণ করি, তাহা আবার দেহের ভেতর দিয়া ঘুরাইয়া আনিয়া নাক মুখ দিয়া ছাড়ি। ইহা দারুণ এক বিজ্ঞান। দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরে এক ভিন্ন কারখানা চালু করিবার ন্যায়। উহা যেন পুতুল নাচের নামে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শনী। যাহা দেখিয়া ছেলেবুড়ো সবাই মজা পাইলেও মনে মনে ক্ষতির কথা ভাবিতে থাকে। আমরা মজা পাইতে থাকি। দেহে গ্যাস্ট্রিকসহ নানাবিধ সমস্যার দরুণ দুধ চা খাইলে পরে ক্ষতি হয় জানিয়াও শুধু সিগারেটটি শরীরের ভেতর চালু করিবার জন্য চা খাই, দুধ দিয়া গাঢ় করিয়া কফি খাই। পরে সিগারেট খাইয়া অমৃতের মজা পাই। সিগারেটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ২৩ বছর। ১৯৮৭ হইতে নিয়মিত সিগারেটের ফিল্টার ঠোঁটে ধরিয়া দারুণ মমতায় টান মরিতেছি। শুরুতে বিড়ি, বস, ক্যানন, রেড এ- হোয়াইট, কীং স্টর্ক, ক্যাপস্টান খাইয়াছিল। গোল্ডলীফ খাইয়াছি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। ঢাকায় আসিয়া গোল্ডলীফকেই জীবনের একমাত্র ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গ বানাইয়াছি। আহা, সে কী বন্ধুতা। অভাবে পড়িয়া নেভি খাইতেছি...একটির আগুন দিয়া আরেকটি জ্বালাইতেছি। কী অপূর্ব স্বাদ। প্রচ- ক্ষুধায় অথবা খাইবার পর, ঘুম হইতে জাগিয়া অথবা ঘুমাইতে যাইবার সময়, কঠিন কোন দুঃসংবাদ শুনিয়া, অথবা সুসংবাদ শুনিয়া, কোন কাজ শুরু করিবার পূর্বে, করিতে করিতে ও কাজ শেষ হইবার পর, মেজাজ খারাপ করিয়া অথবা দারুণ স্বস্তি পাইয়া, কিছুই যখন ভালো লাগিতেছে না তখন ভালো লাগিতেছে সিগারেট। যখন বেশি আনন্দে আপ্লুত হইতেছি তখন সিগারেট ধরাইতেছি। কোথায় নাই সিগারেট ? চীন-জাপান-ভিয়েতনামে সকালের নাশতা, মধ্যাহ্নভোজ অথবা নৈশভোজে খাদ্য সামগ্রির সঙ্গে সিগারেট দারুণ মিশিয়া থাকে। এক টান সিগারেট, একটু ভাত, সুপ, সবজি অথবা মাছ। আর সিগারেট ছাড়া তো পানশালা অন্ধকার। চীনের হুনান প্রদেশে ধান গবেষণা বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়া মজার অভিজ্ঞতা হইয়াছে। সেখানে কোন অনুষ্ঠানেই সিগারেট তো কোন সমস্যা নয়ই বরং উহা অনুষ্ঠানটির অলংকার বৃদ্ধি করিয়া থাকে। আমরা ঢাকা থেকে যাহারা গিয়াছিলাম গোল টেবিলে বসিয়া গেলাম। আলোচনা শুরুর আগে আপ্যায়ন শুরু হইল। শুরুতেই ধূম্র শলাকার বাক্স, বা সিগ্রেটের প্যাকেট সবার সামনে বিতরণ করা হইলো। কী নোট স্পীকার প্যাকেট খুলিয়া একখানি সিগারেট্ জ্বালাইলেন। আমরাও তৎক্ষণাৎ তৃষ্ণার্ত হইয়া ধরাইয়া ফেলিলাম। আলোচনার টেবিলে ধোঁয়ার ঝড় চলিতে লাগিল। ব্যাপারটি ছিল বেশ উপভোগ্য।
নরওয়ের ইবসেন থিয়েটার হইতে শুরু করিয়া, সুইডেনের এরিকসনের রাজপ্রাসাদ, মিশরের গিজা পিরামিড, ওমানে ভূমধ্যসাগরের তীর, অপরূপা সৌন্দর্যময় ইন্দোনেশিয়ার বালি বিচ, মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার, সিঙ্গাপুরের মোস্তাফা মার্কেটের সামনের চত্বর, চীনের হুনান প্রদেশর চাংষায় মাও জে দং এর বাস্তুভিটা কিংবা ভিয়েতনামের ক্যান থো শহরে হো চি মিনের বিশালাকার মূর্তির নীচে সিগারেট খাইয়া ধের্ঁায়া ছাড়িয়াছি। ফিল্টার জুতার তলায় ফেলিয়া পিষিয়াছি। সিগারেটের মজার নিকট অনেক কিছই মেকি হইয়া পড়িয়াছে। সম্ভবত সে কারণেই কিশোর কুমার গান বাঁধিয়াছিলেন ‘সিগারেট নও তুমি স্বেতপরী।’ সুমন চট্টোপাধ্যায় গাহিয়াছেন ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই... শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।’ ‘ডানে ও বায়ে আমি তোমাকে চাই, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।’ এই ‘তুমি’ মানে ‘সিগারেট’। আহা সিগারেট। আহা ! অদ্ভুত ধোঁয়ার মায়া। আহা ! অস্থি মজ্জায় মিশে যাওয়া এক মগ্ন প্রেমিকা আমার। তোর সঙ্গে যে সম্পর্ক তাহাকে শুধু শারিরীক বলিয়া ছোট করিতে পারিব না, এই সম্পর্ককে বলা যাইবে দেহজ, মনজ ও আত্মিক। কারণ, স্পষ্টতই দেখিলাম, শত প্রচেষ্টা করিয়াও তোর সঙ্গ ত্যাগ করা সম্ভবপর নহে। ভাই গীরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কোরআন অনুবাদ করিবার সময়ও নাকি বিড়ি, তামাক, সিগারেট হরদম সেবন করিয়াছেন। গীরিশ চন্দ্রের ছিল ছোটবেলা হইতে গাঁজা সেবনের অভ্যাস। প্রাকৃতিক তৃণলতার ধুম্র সত্যিকারের সিদ্ধি। আমাদের কুষ্টিয়াতেও ছোটবেলায় দেখিয়াছি রিক্সাঅলা কিংবা মজুর পরিবারগুলোতে গাঁজা সেবনের বিষয়টি নিছক ছিল সিদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। সিগারেট সেখানে মামুলি এক ধের্ঁায়ার উপলক্ষ, ইহা আর ক্ষতি বা অপরাধের কি ?
আমার বাবা সোজাসাপ্টা একজন নিয়ামানুবর্তি মানুষ ছিলেন। কৈশর পেরুতে না পেরুতেই তাহার সঙ্গে বৈশিষ্টগত এক বৈপরিত্য গড়িয়াছিলাম। তফাৎটা হইতেছে বিড়ি সিগারেট। বাবা খান না, আমি খাই। মায়ের আষ্কারা, বড় দুবোনের প্রশ্রয় এবং এক পর্যায়ে বড় ভাইয়ের প্রশ্রয় ধূমপান প্রেমের প্রশ্নে সোনায় সোহাগা হইয়া ওঠে। ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় শুইয়া সিগারেট টানিবার মধ্যে আভিজাত্য অনুভব করিতে লাগিলাম। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়া সিগারেটের প্রেমময় হাতছানি একেবারে তাগড়া হইয়া উঠিত। নিজস্ব জিনিস বলতেই সিগারেট। কাউকে নিজের সংকটকালীন উদাহরণ হিসেবে বলা শুরু করিলাম সিগারেট খাইবার টাকাটি পর্যন্ত নাই, তাহলে হিসাব করিয়া দেখ, কি পরিস্থিতি ? বাবা জানিতেন তাহার প্রিয় পুত্র সিগারেট খাইতেছে। কোন রাগারাগি করেন নাই। একদিন আপোষে ডাকিয়া বলিলেন, সিগারেট ছাড়িয়া দেওয়া কঠিন কিছু নহে। যদি তোমার একটু আধটু অভ্যাস থাকিয়া থাকে তাহা হইলে, মনের জোরেই ছাড়িয়া দিতে পারো। এখনই পণ করিয়া দেখ, আর কখনো খাইতে ইচ্ছা করিতেছে না। আমি এক কানে শুনিয়া আরেক কানে বাহির করিয়া দিলাম বাবার এই পরামর্শ। তবে ঘটনাটি মনে রাখিয়া বন্ধু মহলে সিগারেট টানিতে টানিতে আলাপ করিলাম।
সিগারেট পরিত্যাগ করা কাহার সমান ? স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা পরিত্যাগের সমান ? কেহ কেহ একমত হইবেন, কাহারো কাহারো মতে ধর্মান্তরিত হইবার মত। কোন কিছু ছাড়িতে হইলে বিকল্প অবলম্বন দরকার হয়। ক্ষতিকর স্ত্রী কিংবা ক্ষতিকর প্রেমিকা ছাড়িয়া দিয়া স্বস্তিদায়ক খোঁজ করিতে পারে, কিন্তু এমন তিতাকড়ামিঠা সিগারেট ছাড়িয়া দিলে তাহার বিকল্প কি হইবে মাথায় আসে না। সিগারেটের বিকল্প সিগারেটই হইতে পারে। গাঁজা কস্মিনকালেও সিগারেট হইতে পারিবে না, উহার আসন ভিন্ন। আর সিগারেটের আসনটি ধূম্রপায়ীদের নিকট প্রাত্যহিক পোষাক পরিবার ন্যায় অপরিহার্য। আমার এক আফগান বান্ধব শোয়াইব আহমেদজাই। সে গাজীপুরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। তাহার সঙ্গে প্রথম দেখা বছরখানিক পূর্বে। আমাদের অফিসে আসিয়াছিল আফগানী পোষাক পরিয়া। বেশ পবিত্র ও নূরানী চেহারা তাহার। যাহার রোশনাই বলিয়া দিল, সে কখনো সিগারেটের ‘সি’ পর্যন্ত ছুঁইয়া দেখে নাই। তাহারপরও জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি স্মোকার ? সে সহাস্যে জবাব দিল, ‘না। তবে অসুবিধা নাই। তোমরাই চালাইতে পারো।’ কিছুটা সংকুচিত হইলাম, তবে তাহার সামনে সিগারেট টানিতে কুণ্ঠা করিলাম না। পরে ভাবিলাম শোয়াইবের মত শুরু হইতে এমন সিগারেটমুক্ত থাকিতে পারিলে দারুণ সুস্থবোধ হইতো। এমন অনেকই দেখিয়াছি সিগারেটমুক্ত জীবন। অবশ্য তাহাদের জীবনের মূল বিনোদন কখনোই খুঁজিয়া পাই নাই। বছর খানেক পর সেদিন আফগান যুবক শোয়াইব আবার দেখা করিতে আসিয়াছিল। করদর্মন করিতেই তাহার মুখ হইতে সিগারেটের গন্ধ পাইয়া অবাক হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি সিগারেট খাইতেছ ? জবাব দিল, ‘না খাইয়া উপায় নাই। পরিবার পরিজন ছাড়িয়া একা একা থাকি, কত চিন্তাভাবনা। সিগারেট ছাড়া উপায় নাই। দিনে এক প্যাকেট খাই।’ ইসলামিক রাষ্ট্রসমুহের সংগঠন ও আই সি হইতে মাসে পকেট খরচ বাবদ ৫০ মার্কিন ডলার বৃত্তি পায় শোয়াইবসহ তাহার মতো বিদেশী শিক্ষার্থীরা। ওই টাকায় মাসিক সিগারেট খরচ চলিয়া যাইতেছে। এক প্যাকেট বেনসন এ- হেজেজ প্রতিদিন পরিবার পরিজনের দূরত্ব ভুলাইতে সাহায্য করিতেছে ? সিগারেটের এই নিদারুন অবদান ও ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চয়ই সবারই ধারণা থাকিবে। একদা গ্যাস্ট্রিকসহ শারিরীক বিভিন্ন সমস্যা লইয়া বিশিষ্ট একজন চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করিতে গেলাম। বলিলাম নানা বিষয়। সেই সঙ্গে বলিলাম, প্রতিদিনই সিগারেট খাই। তবে সারাদিন। রাতে খাই না। কারণ স্ত্রীর অনুমোদন নাই। দিনশেষে ঘরে ফিরিবার সময় গালমুখ ভালোমত ঘষিয়া ধুইয়া বিশুদ্ধ নিশ্বাস নিশ্চিত করিয়া থাকি। কদাচিৎও ভুল হয় নাই। কথা শুনিয়া ডাক্তার অবাক হইলেন, বলিলেন, ব্যাপারটি মজার তো ! আরে ভাই আমি তো মিন্ট লজেন্স খাইয়া বাসায় ঢুকি। তাহার পরও ধরা পড়িয়া যাই। আমি উৎসাহ বোধ করিলাম। উচ্চকণ্ঠে হাসিলাম।
যে কথা বলিতে গিয়া এইসব প্রসঙ্গ আসিল তাহা হইতেছে সঙ্গী। প্রিয় সঙ্গ ত্যাগ করিলে তাহার বিকল্প লাগিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। চকবার পাল্টাইয়া কোন হইতে পারে, ইলিশ পাল্টাইয়া রুই হইতে পারে, শার্টপ্যান্ট পাল্টাইয়া পাঞ্জাবী ট্রাউজার হইতে পারে, ডেস্কটপ পাল্টাইয়া ল্যাপটপ হইতে পারে, কাঁচাবাড়ি পাল্টাইয়া পাকাবাড়ি হইতে পারে, সাদাকালো পাল্টাইয়া রঙিন হইতে পারে, বিরক্তিকর বন্ধু পাল্টাইয়া মনমত বন্ধু পাওয়া যাইতে পারে কিন্তু সিগারেটের বেলায় তাহা কী সম্ভব? বড়জোর ব্রা- বদলাইয়া গোল্ডলিফ ছাড়িয়া বেনসন হইতে পারে। হইতে পারে বেনসন লাইট অথবা মাইল্ড সেভেন। সিগারেটের তৃষ্ণা কী চ্ইুং জিঞ্জার কিংবা চুইং গাম মেটাইতে পারিবে ? কিছু মাদক বিরোধী বটিকা রহিয়াছে তাহা খাইলে নাকি সিগারেটে বিতৃষ্ণা আসিয়া থাকে। কিন্তু সিগারেটের তৃষ্ণার মত এম মধুর উপলব্ধি আর কিসে থাকিতে পারে ? কেহ কি সাধ করিয়া সিগারেটের প্রশ্নে বিতৃষ্ণা আনিতে পারিবেন ? সিগারেটের সহিত দীর্ঘ সম্বন্ধহেতু এইরূপ পক্ষপাত। ইহা কাহারো গাত্রদাহের কারণ হইতে পারে। তাহাদের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখিয়া বলিতেছি, বিড়ি তামাক এই দেশের তৃনমূল মানুষের নিজস্ব বিনোদনের উপলক্ষ। ইহা আবহমান কালের সহিত সংযুক্ত। খোদ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যের একটি রূপকল্প হিসাবে তামাকের বিবরণ দিয়াছেন। তাহার সাহিত্যে বহু জায়গায় রহিয়াছে তামাক সেবনের মজার তথ্য সেই দিকে যাইবো না। শুধু শুনুন তাহার কয়েকছত্র উপমা।
“জঠর-তত্ত্বের যে পরিচ্ছেদে এই তামাকের কথা আছে, তাহার নাম ধূমায়ন। বুদ্ধির ভোজে নভেলকে তামাক বলে। বুদ্ধিজীবীগণ ইহাকে বুদ্ধিগত শরীরের পক্ষে অপরিহার্য আবশ্যক বলিয়া বিবেচনা করেন না। তাঁহাদের অনেকে ইহাকে মৌতাতের স্বরূপে দেখেন। বড়ো বড়ো আহারের পর এক ছিলিম তামাক বড়ো ভালো লাগে, পরিশ্রম করিয়া আসিয়া এক ছিলিম তামাক বিশেষ আবশ্যক। নিতান্ত একলা বসিয়া আছি, হাতে কিছু কাজ নাই। বসিয়া বসিয়া তামাক টানিতেছি। ইহার মাদকতা শক্তি কিয়ৎ পরিমাণে আছে। কিন্তু ইহার ফল উপরি-উল্লিখিত ভোজ্যসমূহের অপেক্ষা অনেকটা ক্ষণস্থায়ী ও লঘু, খানিকটা ধোঁয়া টানিলাম, উড়িয়া গেল, তামাক পুড়িয়া গেল, আগুন নিভিয়া গেল, লঘু ধোঁয়ার উপর চড়িয়া সময়টাকে আকাশের দিকে চলিয়া গেল। তামাকে আবার নানাবিধ শ্রেণী আছে। অনেক আষাঢ়ে আছে, যাহাকে গাঁজা বলা যায়। বঙ্কিমবাবু ডাবা হুঁকায় আমাদের যে তামাক খাওয়ান এমন তামাক সচরাচর খাওয়া যায় না। ইহার গুণ এই, ধোঁয়া অনেকটা জলের মধ্য দিয়া ঠা-া হইয়া আসে। বঙ্কিমবাবুর হুঁকার খোলে অনেকটা কবিতার জল থাকে। এক-এক জন লোক আছে, তাহারা হুঁকার জল ফিরায় না; দশ দিন দশ ছিলিম তামাক সাজিয়া দেয়, একই জল থাকে। এক-একজন পাঠক আছে, তাহাদের চুরট না হইলে চলে না। তাহারা বর্ণনা চায় না, কবিত্বপূর্ণ ভাব চায় না, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভাবের লীলাখেলা দেখিতে চায় না; তাহারা মাথায়-আকাশ-ভাঙা, গা-শিওরনো, চমক-লাগা ঘটনার দশ-বারোটা গরম গরম টান টানিয়া একেবারে সমস্তটাই ছাই করিতে চায়। কোনো কোনো নবন্যাসবর্দার আমাদের গুড়গুড়িতে তামাক দেন। তাহার দশ হাত লম্বা, দশ পাক পেঁচানো নলের মধ্য দিয়া ধোঁয়া মুখের মধ্যে আসিতে অনেকটা দেরি করে। কিন্তু একবার আসিলেই অবিশ্রাম আসিতে থাকে। কোনো কোনো হুঁকায় আগুন নিভিয়া যায়। কোনো কোনো কলিকায় পাঠক যদি শ্রম স্বীকারপূর্বক প্রথম প্রথম খানিকটা ফুঁ দিয়া দিয়া আগুন জাগাইয়া রাখিতে পারেন, তবে শেষাশেষি অনেকটা ধোঁয়া পান।”
একটি গ্রহণযোগ্য হিসাব করিয়া দেখিলাম ২৩ বছরে মাত্র ৬ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকার সিগারেট খাইয়াছি। এই লেখাটির এতদূর আসিয়া একখানি যাদুর কথা বলিতেই হইবে। লেখাটি শুরু করিয়াছিলাম সিগারেটের প্রতি টান, ইহার প্রতিটি টান, কিংবা ইহাতে টানটান যুক্ত থাকিবার দিনগুলি তুলিয়া ধরিয়া শেষে আসিয়া হাটে হাড়ি ভাঙিবার ন্যায় কঠিন নিন্দা করিয়া ছাড়িব। কিন্তু এতদূর আসিয়া যেন ব্যর্থ হইয়া যাইতেছি, ইহার বিপক্ষে শক্ত কথা বলিবার ভাষা আপাতত খুজিয়া পাইতেছি না। অভ্যাস থাকিলে ধূমাইয়া কয়েকটি টান মরিয়া আসিয়া বসিতাম। মাথা হয়তো খুলিত, কিন্তু তাহা আর হইতেছে না, কারণ উহা গত কয়েকদিন খাইতেছি না। উহা এখন তালাকি ঘরনীর মতো ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে পড়িতেছে। তবে ইচ্ছা থাকিতেছে। সিগারেটকে অভিশাপ জানাইতেই যেহেতু এই লেখনীর উদ্ভব, উহা জানাইবই।
(অসমাপ্ত)
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×