কিছু একটা লিখার জন্য মাথায় একটা প্লট ঘুরছিল অনেকদিন ধরেই। ঠিক একটা না, আসলে কয়েকটা। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা বেশ বড়সড় একটা উপন্যাস লিখব, একটা বড় কাব্য, কিছু ছোটগল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ করে মাথায় ভূত চাপে কিছু একটা ছাঁইপাশ লিখার জন্য, তারপর ঘুমে-স্বপ্নে, পথে-ঘাটে সবখানেই শুরু হয় প্লট খোঁজা। কিন্তু নানা কারণে লিখার সময়টুকু আর হয়ে উঠে না। আজও সকাল থেকেই মাথায় ঘুরছিল ব্যাপারটা। তারপর দৈনন্দিন নিত্যকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, অলস ঘোরাঘুরি, স্ব-প্রতিভার জোরপূর্বক বিকাশের কষ্টব্যর্থ প্রচেষ্টা...। এক জায়গায় এসে সুযোগ মিলল কিছু বিশ্রামের- আর সাথে সাথেই মাথায় এসে ভিড় করে প্লট। এবার কাহিনী আরো পরিষ্কার হতে শুরু করে। শুরুটা কোন লাইন থেকে কোথায় কখন কিভাবে হবে সবকিছু মাথার মধ্যে। দরকার শুধু তখন একটা খাতা আর একটা কলমের। কিন্তু আশেপাশে সে সুযোগ নেই। তারপর মেঠো পথ দিয়ে হাঁটা, রাস্তায় এসে বাসে ওঠা। বাসের জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মস্তিষ্কের ভেতর চলে কল্পসাহিত্য। গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত ছিল এভাবেই।
হটাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ভেসে আসে একটা মৃতুসংবাদ। একদিক দিয়ে খুব কাছের, আবার অন্যদিক দিয়ে দেখলে হয়তো অনেক দূরের কেউ। হয়তোবা হলেও হতে পারতো অতি ঘনিষ্ঠ কেউ। তারপর ব্যস্ত ছোটাছুটি। একসাথে গম্ভীরমুখো অনেকগুলো মানুষ। কেউ কেউ বেদনায় কাতর। যথারীতি কাফন-দাফন, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান। মাটির নিচে চাপা পড়ে আরো একটি জীবদেহ। সবকিছুই ঠিকমত আছে, দেহ ছেড়ে উড়ে গেছে শুধু প্রাণপাখি। যে মুখ একটু আগেও কথা বলত, যে হাত একটু আগেও নড়ত, যে পা একটু আগেই হয়ত পথ চলেছে- এখন তারা নিথর, স্পন্দনহীন। যে মানুষটি একটু আগেই ছিল অনেকের অতি প্রিয়জন, অতি প্রয়োজনীয়- তেমনিই অপ্রয়োজনীয় তার প্রাণহীন দেহ।
যাইহোক, ফিরে আসি আবার আপনার জগতে। মাথার মধ্যে আগের মতই প্লটের পর প্লট খেলে যাচ্ছে। পার্থক্য শুধু এবারে সাথে আছে খাতা-কলম। আর পাশে মুঠোফোনে হালকা আওয়াজে বেজে চলেছে অর্ণবের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত-
“ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
তোমার হাওয়ায় করেছি যে দান।
আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ... ...”
কেন জানি ঘুরেফিরে মাথায় বারবার মৃত্যু বিষয়ক চিন্তাই আসছে। হয়তোবা খুব তাড়াতাড়িই আশেপাশে বেশকিছু মৃত্যু ঘটে গিয়েছে বলে। একটা সময় পদ্য বেশি খেলত মাথায়। কিন্তু আজকাল গদ্যভাবনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। ঠিক যেন কবি সুকান্তের মতো-
“...কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি।
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”
কিছুদিন আগে একভাই ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এরকম- “মানুষ পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় দশমাস, কিন্তু চলে যেতে কয়েক সেকেন্ডেরও বেশি লাগে না।” ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। সেই এক কৌতুকাবৃত কঠিন সত্যের মতো। প্রশ্নটা এমন – ‘সব মানুষই স্বর্গে যেতে চায় কিন্তু কেউ মরতে চায় না কেন?’ শুনতে কিছুটা রুঢ় হলেও আমরা সবাই ক্ষুধার রাজ্যে প্রয়োজনের শৃংখলে বাঁধা। চাওয়া-পাওয়ার তাগিদে তাই এই সত্য যখন আমরা হরহামেশাই ভুলে থাকি তখন আমাদের কাছে মৃত্যু ব্যাপারটা কয়েক সেকেন্ডের বলেই মনে হয়। আমরা বিস্ময়াবিভূত হই। অথচ জন্মের পর থেকেই মৃত্যু বিষয়টা সর্বক্ষণ ঝুলে আছে ছায়ার মতো। যেকোন মুহূর্তের নোটিশেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। তাই- ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’ এর মতো সত্যকে প্রবাদবাক্য হিসেবে মেনে নিলেও এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকি।
দিনের শুরুতে লেখাটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। মনটা নানা কারণে বিক্ষিপ্ত আর এলোমেলো হয়ে আছে। এলোমেলো চিন্তার ফসল- অগোছালো প্রলাপ। নিজের অস্থিরতার আবেগে পাঠককেও গম্ভীর করে তোলা সবসময় অমার্জনীয় অপরাধ বলেই মনে হয়। তাই যখনি কোন লেখা পড়ি, তখন ভাবি- লেখক মনে হয় এতটা কঠোর না হলেও পারত। কি দরকার ছিল এতগুলো প্রাণ নষ্ট করার। কিন্তু না, হয়ে যায়। তাকে আর ধরে রাখা যায় না।
ব্যাপারটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। ব্যাপারগুলো এমন তো নাও হতে পারত। সব কিছুই কেমন যেন, গোলমেলে। এলোমেলো আর এলোমেলো। একগোছা এলোমেলো।
২৮.১০.২০১২