তখন বয়স আর কত হবে। মুখে গোফের অস্পষ্ট রেখাটি কেবল দিন দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। মনে আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। কিন্তু কি এক অজানা তৃষ্ণায় তা সকালের কুয়াশার ন্যায় ক্রমাগত অদৃশ্য হচ্ছে, পড়াশুনা মলাট দেওয়া নতুন বইয়ের মধ্যেই সঞ্চিত থাকে। আমার কোন অবসর নাই, কোন কাজ নাই, কোন কিছু নাই, কিছু নাই। অবশেষে বৃষ্টি ভেজা বিড়ালের ন্যায় গা ঝাড়া দিয়া উঠিলাম উদ্দেশ্য এক অবিনশ্বর শাশ্বত চিরন্তন আমাকে প্রেম করিতে হইবে।
যাহা হোক তখন আমার শুধু একটি ধ্যান জ্ঞান কর্তব্য কি করিয়া প্রেম করা যায়। কাহার সহিত হইলে ভাল হয়। কোন খানে বিপদ। কোন খানটি নিরাপদ। এই যোগ বিয়োগের হিসাবের ফাঁকে আমার গোফের রেখা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আজ আর তাহাকে ঢাকিবার দরকার হয় না বরং কাটিবার দরকার।
অনেক সরল সমীকরণ শেষ করে পাশের বাসার নবাগত তপুর খালাতো বোনকে ভাল লাগিল। তাহাকেই প্রথম ভালবাসা জানাইতে চাইলাম।এবার প্রেম নিবেদন পর্ব তখন চিঠির মৌসুম। সারা রাত্রি জাগিয়া পিতার পকেট কাটা টাকায় কেনা বাহারি রঙিন আকর্ষণীয় প্যাডের কাগজে শুধু লিখিলাম আর ছিড়িলাম, লিখিলাম আর ছিড়িলাম। গলা ভাঙা মৌলবির তাঁর স্বরে চিৎকার দেওয়া পিলে চমকানো শব্দে ফজরের আজান শেষ হইলো কিন্তু আমার চিঠি শেষ হইলো না। যাহা হোক সকালে রক্তচক্ষু লইয়া স্বপনের ডানায় ভর দিয়া, হাজার পীর ফকিরের দোহায় দিয়া আল্লাহর আরশ কাপাইয়া সব পুরুষের সাহস একত্র করিয়া তাহাকে প্রেম নিবেদন করিলাম। ও আমার মুখের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে শুধু মিষ্টি করিয়া হাসিল।আমি যে কি সুখ পাইয়াছিলাম তা বোঝায়তে পারিব না। এত সুখের চোটে বার বার মনে হইতে ছিল এখন মৃত্যু ও ভাল। তখন বুঝি নাই আসলে মৃত্যুই ভাল ছিল। সারাদিন সুখের রাজ্যে ঘুরিলাম। রাত্রে খাইতে বসেছি দু,গাল মুখে নিতেই হঠাৎ যেন বজ্রপাত হইলো এবং তা আমার মুখে। ভাবিলাম মশা বসেছে হইতো। কিন্তু ভাবনা শেষ হওয়ার পূর্বেই মুখের বিপরীত পাশটায় সমান গতি ও ওজন সম্পন্ন আর একটি। তাহার পর শ্রদ্ধেয় আম্মাজান হাল আমলের mp3 রক মেটাল উপদেশ প্রদান শুরু করিলেন মাঝে মাঝে ছিঃ ছিঃ নির্লজ্জ বেহায়া কুলাঙ্গার কোরাস চলিতে লাগিল। আমার মুখে কোন খাদ্য যায় না। কর্ণ দিয়া হিতোপদেশ প্রবেশ করিয়া পেটের ক্ষুধা তো দূর হইলোই বরং বদহজমের আশংকা দেখা দিল। কোন মত খাইয়া পৃথিবীর সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া আহত ইদুরের ন্যায় আম্মাজানের সামনে থেকে পালাইয়া নিজের ঘরে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলাম। বালিশ বুকে জড়াইয়া অনেক কাঁদলাম আর ভাবলাম। গলা ভাঙা মৌলবির আজান শেষ হল। আমার সিদ্ধান্ত ঠিক করলাম নয় প্রেম, নয় অবাধ্যতা। এবার হবে পড়াশুনা। সকালে প্রস্তুত হয়ে স্কুলে যেতে পথে ওর সাথে দেখা। এক পলক তাকাইয়া দেখিলাম মুখে সেই হাসি যা আমাকে পাগল করিয়াছিল। এখন এই হাসিই আমার শরীরের প্রতিটি কোষ এর সাথে রক্ত হয়ে মিশে কুইনাইন খাওয়ানো রোগীর মত ইহধাম ত্যাগ করার আবশ্যকতা জানাইয়া দিল। মুখে কিছুই বলিলাম না। কিন্তু বুঝিলাম হাসিই সুখের প্রতীক। তার হাসিতে আমার যে ভালবাসার সূচনা তার হাসিতেই সেই ভালবাসার সমাধি রচনা করিলাম।
ইহার বছর খানেক পরে শুনিলাম বিবাহ স্থির হইয়াছে। আমাদের ও দাওয়াত হইলো। তপুর সাথে বিবাহের আগের দিনই উপস্থিত হইলাম। আমাকে নিভৃতে ডাকিয়া বলে ভালবাসি। আজ তার মুখে সেই হাসি নাই, যে হাসিকে আমি ভালবেসে ছিলাম। বরং তার বদলে মুক্তোর মত অশ্রু চোখের দুকুল ছাপিয়ে শ্রাবনের বারিধারার মত টপটপ করে ঝরে পড়ছে। আমার হৃদয়কে কে যেন পরম অযত্নে দোলে মুচড়ে একাকার করে দিচ্ছে সেখানে আমি ওর চোখের পানির অস্তিত্ব পেলাম। ফাঁসীর আসামী যেমন মৃত্যুর আগে মুখে হাসির ভাব তুলে সমস্ত পৃথিবীকে কাচকলা দেখায় তেমনি আমার মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম আজ নয় কাল। আর আমাকে নয় তোমার স্বামীকে। আমাদের জন্য হইতো সেইটাই মঙ্গল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। কি দেখলো হইতো অশ্রু ছিল কি না জানি না। তারপর সে চলে গেল এই জন্মের তরে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৩:১২