দিনটা ষোলই ডিসেম্বর। অন্যদিন যেমনই হোক, এই একটা দিন যেন আমাদের দেশপ্রেমটা জেগে উঠে। তো এই ষোলই ডিসেম্বরে আমার এক ছাত্রী আমাকে ফোন করছে...
-আচ্ছা ভাইয়া, যদি একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় আপনি থাকতেন আপনি যুদ্ধে যাইতেন না?
-শুনো উপমা! তোমাকে হতাশ করতেছি! আমি যুদ্ধে যাইতাম না!
-কী বলেন, ভাইয়া! ছিঃ! কেন যাইতেন না?
-আমি ভাব দেখাতে চাইলে বলতে পারতাম যুদ্ধে যেতাম, কিন্তু সেইটা সত্যি হইত না। আমি জানি সেই সময়টাতে আমার যুদ্ধে যাওয়া হত না।
-ধুর, ভাইয়া!
-এইটাই বাস্তবতা। যা সত্যি তাই বলতেসি। আমি যুদ্ধে যাওয়া টাইপ ছেলে না।
-তাহলে ঐ সময়ে কী করতেন?
-এইটা বলা কঠিন। হয়ত অনেকের মত ইন্ডিয়া পালাইতাম। হয়ত পালানোর সাহসও করতাম না।
-আপনি ভীতু।
-হা হা হা! বলতে পার। কী জানি, আসলে ঐ সময়ে কী করতাম বলা খুব কঠিন। আচ্ছা, হূমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল- উনাদের কথা বলি। যুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তরতাজা যুবক। উনারা সরাসরি যুদ্ধে যায়নি। উনাদের বাবা যুদ্ধে শহীদ হইছেন। সবাই কি আর যুদ্ধ করেছে? তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছ এই কথা-যুদ্ধের সময় উনি কোথায় ছিলেন?
-বাবা না কি ক্লাস থ্রীতে।
-হুম। আমার বাবা তখন করাচীতে। ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছিলেন ওখান থেকে। আমার বড় ফুফুর সাথে থাকতেন। ফুফার চাকরীর পোষ্টিং ছিল করাচীতে।
-উনাদের কোন সমস্যা হয়নাই সেখানে? যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে...
-আমার বাবা যুদ্ধের সময় দুইবার দেশে আসতে গিয়ে পারেন নাই। আর ফুফুরা কিভাবে আসবে? বাবা চলে আসছিল যুদ্ধের পরপরই। কিন্তু ফুফুদের আসতে দেরি হইছে। ফুফুদের মত এরকম আরো অনেক বাঙ্গালী পরিবার আটকে পড়েছিল। পাকিস্তানী যেসব যুদ্ধবন্ধীদের, মনে হয় ১৯৫ জন ছিল, তাদেরকে যে শেখ মুজিবের সরকার ছেড়ে দিছে তার একটা কারণ ছিল এইসব আতকে পড়া বাঙ্গালীরা।
-ও! জানতাম না। যাই হোক, বুজছেন ভাইয়া- আমার ছোট বোনের সাথে বাজী ধরছিলাম-আপনি যুদ্ধে যাবেন এইটা নিয়ে। আপনার জন্য হেরে গেছি। ;(
-হা হা হা! আমার পরিচিত আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আমার নানা তখন চিটাগাং-এ চাকরি করতেন। জানো, উনি টানা তিনদিন হেঁটে হেঁটে চাঁদপুর গেছেন সেই যুদ্ধের সময়! আমার নানুর কাছে শুনছিলাম। কী যে একটা আতংকজনক সময় কাটাইছে তখন মানুষ! আচ্ছা, তুমি জাহানারা ইমামকে চিনো? একাত্তরের দিনগুলি পড়েছ?
-চিনি। কিন্তু পড়া হয় নাই।
-তুমি যুদ্ধে যাওয়ার গল্প শুনতে চাইছ তাই তোমাকে একটা গল্প বলি। রুমী ছিল জাহানারা ইমামের ছেলে। যুদ্ধের সময় উনার বয়স কত? এই তোমার এখন যেমন। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। পড়ুয়া, বিতার্কিক, তবে কোন মতেই রাজনিতির সাথে ছিল না। উনার এমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। উনার মত ছেলে যুদ্ধের সময় পুরা ক্যারিয়ার ফেলে দিয়ে যুদ্ধে চলে গেছেন। উনি আর উনার বন্ধুরা ঢাকার গেরিলে বাহিনীতে ছিলেন। উনার বন্ধু ছিলেন আজাদ। অবশ্য বয়সে সিনিয়র ছিলেন। আজাদের বাবা ছিলেন ঢাকা শহরের সবচেয়ে ধনী লোক। উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন দেখে আজাদের মা সব প্রাচুর্য ছেড়ে আজাদকে সাথে নিয়ে একেবারে আক্ষরিক অর্থে কুঁড়েঘরে থাকা শুরু করলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আজাদ মাস্টার্স শেষ করতে পারছিল, বোধহয়। যাই হোক, যুদ্ধে উনারা ঢাকার গেরিলা বাহিনীতে ছিলেন। ভয়ংকর সব অপারেশন চালাইছেন। ২৯ আগস্ট রাতে উনাদের একটা বিশাল বাহিনী পাকিস্তানীদের হাতে ধরে পড়ে। আজাদের মা খবর পেয়ে আজাদকে দেখতে থানায় থানায় ছুটতে থাকেন। দেখেন, আজাদকে খেতে দেয়া হচ্ছে না। উনি সেই সময় আজাদকে বলছেন-বাবা, সব মুখ বুজে সহ্য করবা। কোন ভাবেই তোমার সঙ্গীদের খবর কাউরে বলবা না। পরদিন আজাদের মা আবারো আজাদের জন্য আজাদের ভাত রান্না করে নিয়ে যান। কিন্তু আজাদকে আর পাওয়া যায় না। সেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এরপরও আজাদের মা আরো চৌদ্দ বছর বেঁচে ছিলেন। উনি জীবনে আর ভাত খাননি, উনি আর কখনো নরম বিছানায় ঘুমাননি। বুঝছো উপমা, এইসবই হচ্ছে আমাদের যুদ্ধের গল্প!