অনেকদিন থেকেই দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছিলো । ভাবলাম ইন্ডিয়া , ভূটান ও নেপাল ট্যুর দিব । যেমন ভাবা তেমন কাজ। দৌড়াদৌড়ি করে ইন্ডিয়া ও নেপাল এর ভিসা ও যাবতীয় কাজ শেষ করলাম । শুধুমাত্র বাকি থাকল বউ এর এনওসি । আর এইখানেই খেলাম ধরা । অনুমতির/ অবগতির জন্য বৌকে ফোন করতেই বেঁকে বসলো , একা একা দেশের বাহিরে ঘুরতে যাওয়া যাবে না । না ত না-ই , কিছুতেই মানানো গেল না । কি আর করা , ইন্ডিয়া নেপাল ভূটান ভ্রমন আপাতত ক্যানসেল ।
হঠাৎ করে ২১ শে ফেব্রুয়ারী হাসানকে বললাম চল কোথাও ঘুরতে যাই, ঠিক করলাম নিঝুম দ্বীপ যাব , ভাগ্নে রাসেল শুনেই বলল , সেও যাবে , দুপুরে আমি একাই চলে গেলাম সদরঘাট লঞ্চ ঘাট , সদরঘাট যেয়ে মাথা নষ্ট , চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ , কি করব বুঝতে পারছি না, একটু পরেই হাসান আর রাসেল ও চলে আসল , যা করে আল্লাহ এই ভেবে উঠে পরলাম লঞ্চ এ । ঢাকা হাতিয়া রুটে চলাচল করা লঞ্চ এম ভি পানামা -৫ । কেবিন তো নেই-ই , ডেকেও তিল ধারণের ঠাই নেই। চলে গেলাম লঞ্চ এর তিন তলার ছাদে, চাদর বিছিয়ে জায়গা দখল করলাম, একটু পড়ে সেখানেও মানুষ ভরপুর। আপাতত সেখানেই বসলাম এবং ঠিক করলাম রাতে ৪ তলার ছাদে উঠে যাব ।
যথাসময়ে বিকাল সারে ৫ টায় লঞ্চ ছাড়ল । বুড়িগঙ্গা পার হয়ে লঞ্চ ছুটে চলছে , নদীর চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে কিভাবে যে সময় কেটে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। সন্ধার পর উঠে পড়লাম চার তলার ছাদে , এখানে মানুষ নেই বললেই চলে। খোলা ছাদ আর প্রচণ্ড বাতাসে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিলো। আমরা আমাদের সাথে থাকা তাবু খাটালাম । তাবুর ভিতরে বাতাস ঢুকে না , তাই ঠাণ্ডা বা বাতাসের প্রকোপ নেই। রাত ৮ টায় হাসান বলল তারাতারি ডিনার করে নিতে , যে পরিমান মানুষ পড়ে গেলে খাবার নাও পাওয়া যেতে পারে। লঞ্চ এর রেস্টুরেন্টে যেয়ে দেখি ইয়া বড় পাঙ্গাস মাছের মাথা। রাসেল বলল মামা, মাছের মাথা খাব, আমি মাছ বেশি পছন্দ করি না কিন্তু এত বড় মাথা দেখে আমারও লোভ হচ্ছিল । আহ – কাওকে বলে বুঝানো যাবে তার স্বাদ । খেয়েদেয়ে আবার উঠলাম ছাঁদে । আকাশে বেশ বড় চাঁদ, ৩/৪ দিন পর পূর্ণিমা, চারদিকে অপরূপ জোসনা । রাত ১১ টা পর্যন্ত আড্ডা মেরে তাবুতে ঢুকে দিলাম ঘুম । ভোর সারে ৪ টায় প্রচণ্ড বাতাস আর শব্দে ঘুম ভাঙ্গল । তাবুর বাহিরে মাথা বের করে দেখি প্রচণ্ড শব্দে বাতাস বইছে, যেন আমাদের তাবু উড়িয়ে নিয়ে যাবে । তারাতারি তাবু গুছিয়ে নিচে নেমে আসলাম । ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে , নদীর মাঝে লঞ্চে অসাধারণ লাগছিলো । এর মাঝে দেখি হাসান আর রাসেল একটা ফ্যামিলির সাথে ভালই খাতির জমিয়ে ফেলছে। ওনারা হাতিয়া যাচ্ছিলেন । মজার ব্যাপার হোল , ফিরত আসার দিন আবার তাদের সাথে দেখা হয়। যাই হোক , ভোর ৬ টায় পৌঁছলাম মনপুরা তে । এখানে প্রায় ২০ মিনিট লঞ্চ থামল । আমারা নেমে মনপুরাতে হাঁটাহাঁটি করলাম । ঠিক করলাম ফেরার পথে মনপুরাতে নামব । লঞ্চ আবার ছাড়ল। হাতিয়া পৌঁছলাম সকাল সারে ৮ টায়।
হাতিয়া নামতেই লঞ্চে পরিচয় হওয়া রনি ভাই বলললেন, এখানে নাস্তা না করে জাহাজমারা বাজারে চলে যেতে, ওনার কথামত উঠলাম লেগুনা টাইপ এর মিনি বাস এ । ৩০/৪০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম জাহাজমারা বাজার। রনি ভাই এর পছন্দ মত হোটেল এ নাস্তা করলাম । উনি ঢাকার ছেলে, চাকরি সুত্রে হাতিয়া থাকেন, নাস্তা খাবার পর স্পেশাল জিলাপি খাওয়ালেন। সত্যি আসাধারন তার সাধ। এখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মুক্তারপুর ঘাট। যাবার একমাত্র উপায় মটর সাইকেল বা পায়ে হাটা। রনি ভাই এর ঠিক করে দেয়া মটর সাইকেল এ চললাম মুক্তারপুর ঘাট এর দিকে। এক হোন্ডাতে আমি আর হাসান আরেকটাতে রাসেল স্থানীয় এক লোকের সাথে। মাঝপথে যেয়ে আমার আর হাসানের মোটর সাইকেল এর চাকা পাংচার হল , কি আর করা হাটা আরাম্ভ করলাম । ১৫/২০ মিনিট হাটার পর পৌঁছলাম মুক্তারপুর ঘাট। এখান থেকে নৌকাতে চ্যানেল পার হলেই নিঝুম দ্বীপ। আমি আর হাসান যেয়ে দেখি রাসেল আগেই উপস্থিত। এখানে পরিচয় হলো , ঢাকা থেকে আসা ৪ জনের আরেক গ্রুপ এর সাথে । এরা কুয়েট থেকে পাস করে বর্তমানে চাকরিজীবী । একসাথেই নৌকায় পার হলাম হাতিয়া চ্যানেল। ২০/২৫ মিনিট লাগলো চ্যানেল পার হতে। ওপারে যেয়ে আবার মোটর সাইকেল এ করে মুল গন্তব্য নামার বাজার এ পৌছতে বেজে গেল ১২ টা। নামার বাজার হল , নিজুম দ্বীপ এর ৩ টি বাজারের মধ্যে অন্যতম। একমাত্র এখানেই ট্যুরিস্ট থাকার মতো একটি রিসোর্ট আছে । রিসোর্ট এর নাম নিঝুম রিসোর্ট। আমাদের আগে থেকে বুকিং ছিল না । যেয়ে দেখি, রিসোর্ট এ কোনও রুম খালি নেই। একমাত্র বিকল্প মসজিদ বোডিং এ রুম নেই। কি করব ভাবছি, এমন সময় সদ্য পরিচয় হওয়া কুয়েট গ্রুপ বলল তাদের তিনটা রুম বুকিং করা ছিল। ৭ জন আসার কথা ছিল কিন্তু উনারা আসছে ৪ জন। আমরা চাইলে একটা রুম নিতে পারি। এমন সুজগ কি কেউ হেলায় ফেলে ? কৃতজ্ঞ চিত্তে রুম দখল করলাম । তখন বাজে সারে ১২ টা। সবাইকে অফার করলাম চলেন আশেপাশে একটু ঘুরে দেখি । এর মাঝে ৭/৮ বছর বয়সী স্থানীয় ছেলে এসে ঘোষণা করল সে আমাদের গাইড । ভাল নাম জিল্লুর রহমান , আমার দেয়া নাম মেশিনগান । আমার জীবনে একসাথে এত কথা বলতে আর কাউকে দেখি নাই । যাই হোক আমাদের গাইড জিল্লুর এর দেখানো পথে বের হলাম আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে, সে আমাদের বন বিভাগের অফিস, নামার খাল দেখিয়ে নিয়ে গেল নদীর পারে। ২ টা পর্যন্ত ঘুরাঘুরি করে বাজারে আসলাম লাঞ্চ করতে। এই পর্যন্ত যার সাথেই দেখা সবাই বলল আলতাফ ভাই এর হোটেল এ খেতে। আমাদের গাইড জিল্লুর ও বলল আলতাফ ভাই এর হোটেল এ খেতে। সবাই মিলে গেলাম আলতাফ ভাই এর হোটেল এ। নিঝুম দ্বীপ এর সবচেয়ে ভাল খাবার হোটেল। লাঞ্চ করলাম কোরাল মাছ দিয়ে । রান্না বেশ ভাল, সবচেয়ে ভাল লাগলো আলতাফ ভাইকে। পরবর্তী তিন দিন ওনার হোটেলেই খাওয়া দাওয়া করেছি। খাবার খেয়ে চলে গেলাম মসজিদ বোর্ডিং এর রুম এ । আধাঘণ্টা রেস্ট নেয়ার পর সবাই বের হলাম গোসল করতে। মসজিদ এর পুকুরে গোসল করলাম। পানি বেশ ঠাণ্ডা, শরীর জুড়িয়ে গেল। গোসল করে উঠতেই দেখি গাইড জিল্লুর হাজির। বারবার তাড়া দিচ্ছিল হরিন দেখতে যাওয়ার জন্য । আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। নিঝুম দ্বীপ আসার আসল উদ্দেশ্যই হল , হরিন দেখা। বন বিভাগের হিসাব মতে প্রায় ৪০০০০+ হরিন আছে নিঝুম দ্বীপ এ। নিঝুম দ্বীপ হরিনের অভয়ারণ্য । গুগল ম্যাপ ও গুগল আর্থ এ দেখে দেখে নিঝুম দ্বীপ এর একটা ম্যাপ মাথায় গেথে আছে। আমরা ৭ জন ও মেশিনগান জিল্লুর নামার খাল পার হয়ে বনের পথ ধরে হেঁটে চললাম চৌধুরী খাল এর দিকে । নিঝুম দ্বীপ জুড়েই হরিনের ছড়াছড়ি, মানুষের বাড়িতে ফসলের ক্ষেতে হরিন চলে আসে সকাল বিকাল। সব কৃষি ক্ষেত এ মাটির দেয়াল ও নেট দিয়ে ঘেরাও করা যেন, হরিন ফসল খেয়ে না যায়, তারপর মাঝে মাঝে হরিন এসে ফসল খেয়ে যায়। বনের ভিতর একটু ঢুকতেই টের পেলাম হরিনের আনাগোনা। সারা বন জুড়ে হরিনের হাটা চলার চিহ্হ । হরিন হাটার পথ ধরে গাছের ফাক দিয়ে ছুটে চলা হরিন দেখতে দেখতে ঘণ্টা খানেক হেঁটে পৌঁছলাম , চৌধুরী খাল এর পাশে বৃস্তিন তৃণভুমিতে । এখানে বসে সাথে আনা, বিস্কিট, চিপস , পানি ইত্যাদি দিয়ে নাস্তা করলাম । সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছিলো , সাথে থাকা কুয়েট এর মন্টি, সোহেল ভাই তাড়া দিলেন ফিরে যাওয়ার জন্য। আবার বন এর ভিতর দিয়ে হেঁটে চলা। অন্ধকার নেমে এসেছে, সাথে কোনও লাইট ও নেই, একমাত্র আলোর উৎস মোবাইল এর লাইট। আর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে আছে শ্বাসমূল। যারা ম্যানগ্রোভে বনে হেঁটেছেন তারা জানেন, ম্যানগ্রোভে ফরেস্ট এ হাটা কতো কঠিন। কুয়েট গ্রুপ এর সবাইকে চিন্তিত মনে হচ্ছিল, ওনারা ভাবছিলেন পথ চিনে এই অন্ধকারে ফিরতে পারব কিনা। বনের ভিতর সব একরকমই লাগে। যখন মনে হচ্ছিল আরা কতদূর ঠিক তখনি নামার খালের পাসে পৌঁছলাম । খাল পানিতে ভর্তি অপেক্ষা করছিলাম নৌকার জন্য । কিছুক্ষণ পর একটা জেলে নৌকা আমাদের খাল পার করে দিলে চলে গেলাম রুম এ ।
রাতে আলতাফ ভাই এর হোটেলে , হাঁস এর মাংস , আর চিংড়ী ফ্রাই দিয়ে ডিনার শেষে ঘুরতে গেলাম সাগরের পারে। নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত । দক্ষিন পাসটা খোলা সাগর। ৯ টায় জোয়ার শুরু হয়েছে, সাগরের কাছাকাছি জেতেই সুনতে পেলাম সাগরের গর্জন । এক দের ঘণ্টা বসে আড্ডা মারলাম। সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে সবাই বেশ টায়ার্ড । তাই ১২ টার দিকে ফিরে আসলাম । আমি হাসান রাসেল তাবু খাটিয়ে তাবুতে ঘুমালাম , অন্যরা মসজিদ বোডিং এর রুমে।
আজকের মতো এখানেই শেষ , পরবর্তী দিনের ছবি ও বর্ণনা পড়ে লিখব।
ছবির লিঙ্ক -
Click This Link
2nd Part -
Click This Link