somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেমা কালেঙ্গা : আর্তনাদ ও কান্নার শব্দ শুনতে পাই

২৯ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত ১ টা ২০, শায়েস্তাগঞ্জ। কিছুক্ষণ হল বাস থেকে নেমেছি। অদ্ভুত নিরবতা গ্রাস করে আছে সবকিছু। তারপরও রাত জাগা কিছু মানুষ জেগে আছে। আমাকে যেতে হবে চুনারুঘাট। রাতও অনেক, যাব কি যাব না, ভাবতে ভাবতে চত্ত্বর পার হয়ে সারিবদ্ধ সিএনজি গুলোর কাছে এসে দাড়াঁতেই হাঁক দিল একজন, আফনেরা চুনারুঘাট যাইবাইন ? শায়েস্তাগঞ্জ থেকে চুনারুঘাট ১৫/২০ মিনিটের পথ। আমি ও আমার সঙ্গী চেপে বসলাম সিএনজিতে। আমাদের যায়গা হল চালকের দু পাশে। পিছনে আরও যাত্রী আছেন। তাদের মাঝে একজন মহিলা। রাতের আধাঁর ভেঙে এগিয়ে চলে যান্ত্রিক ত্রি-চক্র যানটি। অল্প দূর যেতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। চৈত্র মাসের বৃষ্টি গরমে একটু স্বস্তিই দিল বটে


বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চুনারুঘাট আসলাম। থানার উল্টোদিকে একটা মাত্র দোকান খোলা। সেখানেই নেমে পরলাম। বৃষ্টির হাত থেকে তো বাঁচা চাই। আশপাশে মানুষ তো দূরের কথা রাত জাগা প্রাণিরও কোন চিহ্ন নাই। কিছুক্ষণ হল বৃষ্টিতে একটা বিরাম পরেছে। দোকানির সাথে ভাব করার জন্য, ওনার কাছ থেকে পান খেয়ে কিছু তথ্য জানতে চাইব এ রকম ভাবছি, যে রকম ভাবা সেই রকম কাজ। পানের খিলি মুখে দিতেই চাচা জিজ্ঞাসা করলেন। কোথায় যাব। বললাম কালেঙ্গা। ঘড়িতে তখন রাত ১. ৪০ মিনিট। বেশ রাত আর ভোর হতেও অনেকটা সময়। দূরে একটা ছায়ামূর্তির সাথে আলো আধাঁরিত চোখাচোখি হয়ে গেল। চাচাও দোকান বন্ধের তোড়জোর শুরু করেছেন। বৃষ্টি আবার বেড়েছে। মিনিট ১৫ ঝুম (মুষলধারা) বৃষ্টি পরার পর কিছুটা কমে আসে। দূরের সেই ছায়া মূর্তিটি ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে, জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাব। আমি উত্তর দিলাম। তারপর চলল বিশ্বাস অর্জনের একটা খেলা। পরিশেষে সিদ্বান্ত নিলাম ছুটে চলা কালেঙ্গার উদ্দেশ্যে।
রাতের রাস্তায় ঘটতে পারে যে কোন ঘটনা। একে তো বৃষ্টি স্নাত গভীর রাত তার উপর আমরা ক্রমেই লোকজনহীন বন্ধুর অচেনা একটা পথে ছুটে চলেছি কালেঙ্গার উদ্দেশ্যে।
রাস্তা ভালই, খোয়াই নদীর উপর এখন পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর থেকেই মাটির রাস্তা। বৃষ্টির জল জমে আছে যার জন্য আসাদ (সিএসজি চালক) দ্রুত চালাতে পারছে না। যা হউক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি, ঝামেলা ছাড়াই শেষ হয়। শুধু মাঝ পথে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা। যাক সে কথা, শুধু একটা কথাই বলি, দাড়োগা বাবু বললেন, আপনি কি ভাবে সাহস করলেন? এত বড় রিস্ক নিলেন কেন ভাই? আমি বললাম আমার কথা, বন ভোর বেলাতে নয়, তাকে দেখতে হলে তার জেগে ওঠাটাও দেখা চাই।

[img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/mirzarussel/mirzarussel-
রেমা কালেঙ্গা সম্পর্কে তথ্য খুব সহজেই ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা যায়। তাই তথ্যগত গদগদ আলাপে না যাই। সত্যি বলতে যারা প্রথমবার বন দেখতে যাবেন তাদের কাছে মনে হতে পারে আসাটাই বৃথা। কিছু তো নেই। যা বলা হয় তার বেশির ভাগ প্রাণির অস্তিত্ত্ব এখনও আছে। শুধু তাদের দেখার জন্য ধৈর্য আর বনে চলার কৌশল জানা চাই। সব প্রাণি সব সময় দেখা যায় না। বসন্তের শেষ পরশ তার উপর বাড়তি পাওনা ছিল বৃষ্টি তাই শাখাচারি প্রাণিগুলো যে সহজেই চোখে ধরা দেবে তা জানাইছিল। পোনে ছটা নাগাদ শহীদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীর উত্তমের কবর পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি । আব্দুল মান্নান তিন নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাক হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে এখানেই শহীদ হন। কিছুটা অযত্নেই আছে তাঁর সমাধিটি। আমি প্রথমেই ঘন বন পার হয়ে করাঙ্গিছড়ার পাশ দিয়ে পাহাড়ি উচূঁ এলাকার দিকে চলে যাই। এখান থেকে বনমোরগ দেখবো বলে নেমে যাই ধান খেতে। তারপর তাদের দেখা মেলে। কালেঙ্গাতে প্রচুর বন মোরগ দেখতে পাবেন তবে সেক্ষেত্রে যায়গা মত আর সময় দুটোই হতে হবে সঠিক। মথুরার সন্ধান করে করে যখন প্রায় ব্যার্থ তখন ডাক শুনতে পেলাম কিন্তু তার দেখা পেলাম না। সূর্য যখন তার অস্তিত্ত্বের আওয়াজ দেয়া শুরু করল তখন ফিরে আসি আবার মূল ট্রেইলে। এবার দেবরা বাড়ি যাব তবে মাঝে মাঝে অফ ট্রেকেও ঢু মারতে হবে। রেসিস বানর ছাড়া আর কিছু চোখে পরল না। বোনাস হিসেবে মালয়ান কাঠবিড়ালির দেখা পেলাম। মালয়ান কাঠবিড়ালি কেবল রেমা-কালেঙ্গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। কাঠবিড়ালি আছে প্রচুর আমি তিন প্রজাতির দেখতে পেয়েছি। তথ্যানুসারে পাচঁ প্রজাতির কাঠবিড়ালি এখানে পাওয়া যায়। দেবরা বাড়ি থেকে রেমা হয়ে ঘুরে এসে ঝিরি পথে ঘুরাঘুরি শেষ করে বিকেল নাগাদ ফিরে আসি কটেজে। রেমাতে শকুনদের অভয়ারণ্য আছে। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর রেমা কালেঙ্গা এর রেমা বিটের ময়নার বিল এলাকায় আর সুন্দরবনে নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করে সেখানে শকুন সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, যেখানে শকুন নিরাপদে প্রজনন ও বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের বন বিভাগ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে শকুন সংরক্ষণের কাজটি বেশ আশাজাগানিয়া। ময়নার বিল এলাকার উচুঁ গাছ গুলোতেই শকুনের বসবাস। এখানকার ২০০টি উচুঁ গাছকে শকুনদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
গোসল খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইচ্ছে ছিল বিকেল বেলা মূল অভয়ারণ্যের বাহিরে বেতবাগানের দিকে যাব হরিণ দেখার আসায়। ক্লান্ত শরীর কখন ঘুমিয়ে গেল টেরই পেলাম না। অল্পকিছুক্ষণ পর আমার ঘুম ভেঙে গেল কিন্তু আমার সঙ্গী তখনও গভীর ঘুমে। কি আর করা বিকালটাকে উপভোগ করার জন্য চলে আসলাম বাজারে। চা খেতে খেতে লোকজনের সঙ্গে কথা হল অনেক।
আমার জানা নেই বিশ্বের অন্য কোথাও অভয়ারণ্যের মাঝে ধানক্ষেত আছে কিনা। বন উজার করার পুরো দস্তুর আয়োজন চলছে। বিকট শব্দে পাওয়ারটিলার দিয়ে চাষ হচ্ছে জমি আর যে ঝিরিটি আছে সেখানে সেলোমেশিন লাগিয়ে পানি সেঁচে চলছে মাছ ধরা। এত হট্টগুল আর আওয়াজে বন্য প্রাণি বেচেঁ থাকবে কিভাবে? লোকজনের অবাধ বিচরণ আর ধানক্ষেত ও লেবুবাগানে অবাধে কিটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার এখানকার জীববৈচিত্রের জন্য শুধু হুমকি স্বরূপ না, রীতিমত ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বনের ভিতরের নির্দেশনা গুলোও ভাঙাচোরা রঙচটে গিয়ে ভঙ্গুর অবস্থা। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তো নয় মরণ ফাঁদ। সিঁড়ির রেলিংগুলো জং ধরে ক্ষয়ে গেছে আর ফাটল ধরেছে আস্তরনে। লেকটা ভালই আছে ঢাহুক আর পানকৌড়ি খুব সহজেই চোখে পরবে।
রাতে আবদুর রহমান ভাইয়ের স্ত্রীর অসাধারণ রান্না (যার গল্প আগেই শুনেছিলাম) খেয়ে দ্রুতই ঘুমিয়ে পরি। ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠেই ছুটে যাই বেত বাগানের দিকে। এ রাস্তাটিই আপনাকে নিয়ে যাবে শ্রীমঙ্গল। বেত বাগানের অল্প ভিতরের দিকে ঢুকতেই প্রথমে আমার চোখে পরে হরিণ। চোখে চোখ পরতেই দৌড়, ছবিও তুলতে পারলাম না। হুড়মুড় করে ঘন বেতের ঝোপের ওপাশে চলে গেল। তিনটি কি চারটি হবে। সকাল আটটা নাগাদ হরিণের সন্ধান করে ফিরার পথে দেখতে পাই মুখ পোড়া হুনুমান আর চশমা পড়া হুনুমানের দুটো দল। হুনুমান আর বানারও পাবেন প্রচুর তবে বিখ্যাত লজ্জাবতী বানর দেখতে হলে রাতের আশ্রয় নিতে হবে। তথ্যমতে তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর বাস এ বনে। এছাড়াও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। বনের ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমার সঙ্গী বেশ লম্বা একটা সাপ দেখতে পায় কিন্তু আমার চোখ এড়িয়ে। ফেরার পথে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ছোট একটা টিলার উপর মাচাং ঘরে বসে জলখাবার গ্রহণ করি। পাখির ডাকে আপনি পাগলপারা হয়ে ওঠবেন এটা নিশ্চিত। নানা রকম পাখির সাথে আপনার দেখা হবে। এখনও এরা টিকে আছে। তবে আর কতদিন? আমি শুনতে পেলাম রেমা কালেঙ্গার আর্তনাদ ও কান্না এবং বেচেঁ থাকার আকুতি।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে হাঁটা শুরু করি শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমি জাম্বুরাছড়ি পাড়া হয়ে হুগলিছেড়া চা বাগানের ভিতর দিয়ে গাজিপুরা এসে সিএনজি নিয়ে চলে আসি শ্রীমঙ্গল। অসাধারণ মনভোলানো একটা পথ। সে গল্প অন্য কোন দিন।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:০৪
১৬টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×