------------------------একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে------------------------
চাঁদপুর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে গাছ পালা ও নদী বেষ্টিত বাঘাদী গ্রামে পারুলদের বাড়ী। পারুল ৭ বছর বয়সের নিষ্পাপ এক অবুঝ শিশু। পারুলদের সম্পত্তির সীমানা নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। পারুলদের বাড়ির সীমানায় একটি পুরনো নারিকেল গাছ আছে। প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী ১১ জন মিলে একদিন ঐ নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল পাড়ছিল। পার
ুল তাদের নারিকেল পাড়তে বাধা দেয়; এই বাধা দেয়ার কারনে প্রতিপক্ষরা পারুলকে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরন করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পারুলের পিতা লালু মিয়া (ছদ্মনাম) চাঁদপুর সদর মডেল থানায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরন মামলা করেন।
থানার অফিসার ইন-চার্জ মামালাটির তদন্তভার আমার উপর অর্পর করেন। আমি তদন্তের দায়িত্ব অত্যান্ত গুরুত্বের সহিত গ্রহন করি; কারন পাচারের জন্য শিশু অপহরনের ঘটনাটি স্পর্শকাতর বিধায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারি থাকবে। আমি মামলার ঘটনাস্থলে গিয়ে এজাহারে বর্নিত সীমানার নারিকেল গাছটি অত্যন্ত সূক্ষ ভাবে পর্যবেক্ষন করি। পারুলদের সীমানায় আর কোন নারিকেল গাছ আছে কি-না তাও সতর্কতার সহিত অবলোকন করি। সীমানার নারিকেল গাছটির আগা চিকন মৃত প্রায়; পারুলের পিতা এই নারিকেল গাছটি-কে নিয়ে মামলার সূত্রপাত বলে ঘটনাস্থলে আমাকে বর্ননা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী কোন সাক্ষী পারুলের পিতা হাজির করতে পারেন নাই, আমিও ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাই নাই। নারিকেল গাছটিতে বিগত ১০-১৫ বছরের মধ্যে নারিকেল ধরেছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় নিরপেক্ষ স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম এবং অন্যান্য মুরুব্বী স্থানীয় বহু লোকজনকে প্রকাশ্যে ও গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাদের কেহই উক্ত নারিকেল গাছে কখনোই নারিকেল তো দূরে থাক ডাবও ধরতে দেখে নাই। এই পর্যায়ে পারুল অপহরন নিয়ে আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
এগারো জন আসামীদের মধ্যে একজন কবর খননকারী; এলাকার কোন মুসলমান মারা গেলে ঐ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কবর খনন করে থাকেন। মৃতের আত্মীয়-স্বজন যদি কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন তবে তা দিয়েই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনজন নদীতে মাছ ধরে জীবিকা চালায়, তিনজন রিক্সাচালক, দুইজন কৃষি কামলা এবং অপর দুইজন গৃহিণী। অপর দিকে মামলার বাদী পারুলের পিতা লালু মিয়া একজন রিক্সা চালক কিন্তু মুলত সে একজন দাঁদন ব্যবসায়ী। উক্ত আসামীরা পারুলকে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরন করতে পারে আমি কিছুতেই এর হিসেব মেলাতে পারছিলাম না।
ইতোপুর্বে পারুলের বাবা এই লোক গুলোর বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে আরো তিনটি মামলা দায়ের করেছিল। ঐ মামলা থেকে জামিন নিতে একজন গৃহিণী তার উকিলের ফি জোগাড় করার জন্য সর্বশেষ মাথা গোঁজার ঠাই তার ঘরের চালের টিন বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছিল। এই ব্যপারটি আমি সরেজমিনে তদন্তকালে দৃশ্যমান পাই।
সীমানার নারিকেল গাছে নারিকেল ধরতে দেখেছে এমন কোন সাক্ষী ও পারুল অপহরণের কোন তথ্য প্রমান না পাওয়ায় আমি আসামী গ্রেফতার করা থেকে আপাতত বিরত থাকি। অপরদিকে পারুলের পিতা লালু মিয়া তার মেয়েকে উদ্ধার করার চেয়ে আসামী গ্রেফতার করার জন্য আমার উপর বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এতে করে প্রকৃতপক্ষে পারুল অপহরন হয়েছে কি না আমার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। আমি আসামী গ্রেফতার না করায় পারুলের পিতা কতিপয় হলুদ সাংবাদিকের সহয়তায় স্থানীয় কিছু অখ্যাত পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে। এরপরেও আমি আসামী গ্রেফতার করতে উদ্যোগ না নেওয়ায় পারুলের পিতা তৎকালীন পুলিশ সুপার চাঁদপুর, ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ, সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টার দফতর সহ বিভিন্ন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন যে, আমি আসামীদের নিকট থেকে ৩০,০০০/= টাকা ঘুষ গ্রহন করে তার মামলার আসামী গ্রেফতার থেকে বিরত থাকি। সব নালিশি দফতরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও সৃষ্টিকর্তার বাহক হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর দফতরে কোন অভিযোগ দায়ের করেন নাই। কারন মহান সৃষ্টিকর্তার দফতরে মিথ্যা অভিযোগ গ্রহন করা হয় না, বোধ করি এই কথাটা লালু মিয়ার ভালোই জানা ছিল।
আমি পারুলকে উদ্ধারের জন্য সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা সহ তদন্তের সকল কৌশল অবলম্বন করেও কোন সন্তোষজনক ফল পাচ্ছিলাম না। অপর দিকে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত বিভিন্ন দফতর থেকে শুরু হয়েছে। তখন আমার অবস্থা এমন যে “একা ভোলা কয়দিক সামলাবো”। এই পর্যায়ে আমার বিরুদ্ধে একটি তদন্তের বিবরন তুলে ধরছি।
পুলিশ সদর দফতরে সিকিউরিটি সেল নামে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করার জন্য একটি সেল রয়েছে। আমাকে উক্ত মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সহ ঐ দফতরে তলব করেন। আমি যথারীতি নির্দিষ্ট তারিখে হাজির হলাম। তদন্তকারী অফিসার এএসপি র্যাঙ্কের, বয়স অনুমান ৫০ বছর; উনাকে আমার বেশ অভিজ্ঞ মনে হল। তিনি আমার বক্তব্য মনযোগ সহকারে শুনলেন। নারিকেল গাছের ছবি সহ আমার উপস্থাপিত সকল কাগজপত্র নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলেন। সব দেখে-শুনে তাঁকে খুব গম্ভীর এবং চিন্তিত দেখালো। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন চাকরি কত দিন ধরে করছি। আমি বললাম “স্যার প্রায় তিন বছর”। তিনি আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন, “ইয়াংম্যান তোমার চাকরি বেশি দিন হয় নাই, যদি পারুলকে উদ্ধার করতে পার তবে ভালো। খোদা না করুক যদি মেয়েটির লাশ পাওয়া যায় তবে তোমার চাকরি তো যাবেই জেলও খাটতে হবে”। উনার এই কথা শুনে আমার শরীর হিম শীতল হয়ে গেল আমার গায়ের সব পশম খাড়া হয়ে গেল। তিনি আমার চেহারার মলিনতা দেখে আরো বললেন, “যাও আমি তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট আপাতত দিচ্ছি না, যেকোন কৌশলেই হোক মেয়েটিকে উদ্ধার করো”। জীবনে প্রথম নিজের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ মোকাবেলা করতে এসে শুরুতে ভেঙে পড়লেও স্যারের দিকনির্দেশনা মূলক কথায় আমি কিছুটা সাহস ফিরে পাই; এটা অনেকটা লঞ্চডুবি যাত্রীর খড়কুটা আঁকড়ে ধরে বাঁচার মতন। আশা-নিরাশার দোলাচলে আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে গেলাম।
ঐ ঘটনার তিন দিন পর, তৎকালীন এসপি চাঁদপুর মামলাটির নথিপত্র সহ তার অফিসে তলব করলেন। আমি তাঁর অফিসে হাজির হওয়ার সাথে সাথে পারুল উদ্ধারের অগ্রগতি কতটুকু জানতে চাইলেন। আমি বিমর্ষ বদনে উত্তর দিলাম, “স্যার, এখনো অপহৃতার কোন সন্ধান মেলে নাই”। তখন তিনি কড়া ভাষায় আদেশ দিলেন, “আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সন্তোষ জনক অগ্রগতি চাই”।
যখন আমার উপর দিয়ে ১২-১৪ নাম্বার বিপদ সংকেত বয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি আমি জানতে পারি বাড়িতে আমার বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করে রেখেছেন। বাড়িতে যাওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম, মনে হল ইহা যেন “মরার উপর খাড়ার ঘা”। নতুন জীবনে পদার্পনের আকুলতা উপেক্ষা করে বাবা-মাকে আমার উক্ত সমস্যার কথা না জানিয়েই চাকুরির ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে আপাতত বাড়ি আসা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে দেই।
এভাবেই কোন অগ্রগতি ছাড়াই মামলা তদন্তের সময়সীমা প্রায় তিন মাস চলে গেল; তদন্তের আইনগত সময়সীমা প্রায় শেষের দিকে। অন্যকোন গত্যন্তর না দেখে মামলার নথিপত্র সহ এসপি স্যারের অফিসে হাজির হলাম। স্যারকে জানালাম এই মামলায় আমি তিনজন লোককে সন্দেহ করেছি। এক- মুহুরী (যে মামলাটির এজাহার লিখেছে); দুই- বাদীর পক্ষের উকিল; তিন- মামলার বাদী পারুলের পিতা লালু মিয়া। অনুমতি দিলে প্রথম দুইজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মামলার রহস্য উদঘাটিত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারন অশিক্ষিত বাদী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৫(১) ধারার মর্মার্থ বুঝার কথা নয়। এসপি স্যার বললেন, “তোমার যুক্তিসংগত সন্দেহ হইলে তদন্তের সার্থে আটক করতে পারো”। অনুমতি পেয়ে কোর্টের সামনে একটি রেস্তোরায় বসে মুহুরীকে ফোন করে উক্ত রেস্তোরায় আসতে বললাম। পুর্বেই একটি রেইডিং পার্টি রেস্তোরার আশেপাশে নিয়োজিত রেখে ছিলাম। মুহুরী রেস্তোরায় আসা মাত্রই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। আইনজীবীর সহকারী হিসেবে অভিজ্ঞ মুহুরী কিছুতেই মুখ খুলতে চায় না। রাত্রি দশ ঘটিকায় চাঁদপুর বার ও প্রেস ক্লাবের সভাপতি থানায় এসে হাজির। কারন ঐ মুহুরী অত্যন্ত ক্ষমতাধর একটি সংঘঠনের সাধারন সম্পাদক। বার ও প্রেস ক্লাবের সভাপতি মামলার রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দিয়ে মুহুরীকে ১৫ দিনের জন্য তার জামিনে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কর্তৃপক্ষের সহিত আলোচনা করে শর্ত সাপেক্ষে জিডি এন্ট্রি করে মুহুরীকে তার জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। চৌদ্দ দিন পুর্ন হওয়ার পর আমি বার ও প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাহেবকে ওসি স্যারের মাধ্যমে সময় শেষ হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
এদিকে আমার বাবা-মা পাত্রী পক্ষকে ১৫ দিনের মধ্যে আমি বাড়ি যাব পাত্র-পাত্রী উভয় উভয়কে দেখবে বলে কথা দিয়ে রেখেছেন। তারা আমাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য আবার চাপ প্রয়োগ করতে লাগলেন। আমার বাবা আমাকে ফোন করে বলেন, “তোর চাকরি করার দরকার নাই; বিয়ের ব্যপারে ছুটি না পাইলে সেই চাকুরী করার দরকার কি?”। আমার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমি কোন ভাবেই তাদের বলতে পারছিলাম না।
১৫ দিন পুর্ন হলো। নাইট ডিউটি করে সকাল আটটায় ডিউটি শেষ করে ঘুমাতে যাই এমন সময় আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এক উকিল সাহেব আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলেন; আপনার মামলার ভিক্টিম পারুলকে পাওয়া গেছে, >>>> কিন্তু মৃত না জীবিত? >>>> জানতে চাইলে নিচে প্রদত্ত লিঙ্কে ক্লিক করে বাকীটুকু পড়ুন।
,,,,,,,,,,,,
(০১)বিদ্রঃ এই পোষ্ট আপনাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক তাতে কি; ফেসবুকের এই পেজে একটি লাইক দিতে তো কোন সমস্যা নাই, তাই না?
এই লেখাটির সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:১১