somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক বর্ষবরণের সৌন্ধর্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা

১২ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই দেশ থেকে উপমহাদেশ, তার বাইরে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সর্বত্র আজ বাঙ্গালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব হয়ে দাঁড়াচ্ছে নববর্ষ- পয়লা বৈশাখ। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের মাস খানেক আগে থেকে ঢাকার ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে বর্ষবরণের প্রস্তুতি শুরু করেন ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের সকালে রমনা পার্কের বটমূলে তারা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করেন। বিপুল সংখ্যক সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ উপস্থিত হন সেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে।
একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং বেশকিছু পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা’র প্রস্তুতি শুরু করেন। তারা নানা ধরনের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণির ভাস্কর্য তৈরি করেন, যেগুলো নিয়ে পহেলা বৈশাখের দিন সকালবেলা মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। বর্ণিল পোশাক পরে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় অংশগ্রহণ করেন।

অন্যদিকে পহেলা বৈশাখের মাস খানেক আগে থেকেই বিপরীত একটি চিত্র দেখতে পাওয়া যায় রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের আনাচে-কানাচে। বেশিরভাগ মসজিদে শুক্রবারের জুম্মার বয়ানে খতিব অথবা ইমামরা পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং শিরক আখ্যা দিয়ে তাতে মুসলমানদের যোগদান না করার আহ্বান জানান। একই কাজ করেন সারাদেশে ওয়াজ করে বেড়ানো মাওলানারাও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউবে পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা’র বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে কট্টরপন্থী মৌলবাদী মুসলমানরা। মৌলবাদীদের এই উস্কানিতে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মুসলমান পহেলা বৈশাখ উদযাপন এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ঘৃণ্য ও অধর্মের কাজ জ্ঞান করে উৎসবে অংশগ্রহণ করে না। পাড়া-পড়শি কেউ পহেলা বৈশাখের উৎসবে অংশ নিলে অনেকে তাদেরকে কটু বাক্য শোনাতেও দ্বিধা করে না। অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কটুক্তির ভয়ে পহেলা বৈশাখের সবরকম অনুষ্ঠান বর্জন করে। কট্টরপন্থী মৌলবাদীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের আহ্বানই নয় কেবল, বন্ধ করার হুমকিও দিয়ে থাকে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে এবছর আইনী নোটিশ পর্যন্ত পাঠিয়েছেন এক মৌলবাদী আইনজীবি। অথচ নববর্ষ একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব, বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পালিত হয়।

আমাদের সংস্কৃতিকে ভীষণ ভয় করে দেশের স্বাধীনতা-বিরোধী এবং মৌলবাদীরা। ভয় এইজন্য যে তারা যত মানুষকে অন্ধকারে রাখতে চায়, সংস্কৃতি তত মানুষের মধ্যে আলো জ্বালায়। আর যেখানে আলো থাকে, সেখানে অন্ধকারের শক্তি টিকতে পারে না। মৌলবাদীরা জানে যে তাদের মতো অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারে কেবল সংস্কৃতি, সংস্কৃতি ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তাই যে-কোনো উপায়ে তারা বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা বন্ধ করতে চায়।

সেই পাকিস্তান আমলেই শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের বাঙালি দোসররা বুঝেছিল যে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনার শক্তি অনেক, তাই যে কোনো প্রকারেই হোক তারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনা নষ্ট করতে চেয়েছিল, বাঙালিকে শিকড়চ্যূত করতে চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল যে বাঙালি মুসলমানকে সংস্কৃতির শিকড় থেকে বিচ্যূত করতে হলে, তাঁদেরকে ভারতের বাঙালি হিন্দুদের থেকে আলাদা করতে হবে। ভারতের বাঙালি হিন্দু এবং পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তুলে দিতে হবে।

এই বিভাজনের উদ্দেশ্যেই বাংলা একাডেমি বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে একটি কমিটি করে বাংলা একাডেমি। এটি ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে পরিচিতি পায়। সেই কমিটি পঞ্জিকা সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। যদিও পাকিস্তান সরকারের সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

কিন্তু অশুভ শক্তি ভেতরে ভেতরে তৎপর ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে আশির দশকে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তারা আবার মাথা চারা দিয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে যা সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের সরকার শহীদুল্লাহ কমিটির সংস্কারকৃত (আসলে খৎনাকৃত) সেই পঞ্জিকা চালু করে বাংলাদেশে। ফলে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট হয়ে যায় ১৪ এপ্রিল তারিখে।

এর পর বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের পহেলা বৈশাখ হয়ে গেল পৃথক দিনে। এতে বিপাকে পড়লেন বাংলাদেশের হিন্দুরা। তিথি-নক্ষত্র দেখে হিন্দুরা পূজা-পার্বণ করে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সংস্কারকৃত পঞ্জিকার সঙ্গে তাদের পূর্জা-পার্বণের তিথি-নক্ষত্র মেলে না। এজন্য তাঁদেরকে ভারতীয় পঞ্জিকাই অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশে যেদিন পহেলা বৈশাখ পালিত হয়, সেদিন হিন্দুদের চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে হয়। এদিন তারা চড়ক পূজা, হাজরা পূজা, শিবপূজার মাথা চালান এবং শ্মশানপূজা করে থাকে। যারা এই সব পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দিতে পারেন না। বলা যায় গ্রাম-গঞ্জের হিন্দুরা বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতেই পারেন না তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির কারণে। তবে শহরের হিন্দুরা পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দেয়।

পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দিলেও হিন্দুরা বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের পরের দিনও পহেলা বৈশাখ পালন করে ভারতীয় পঞ্জিকা অনুসরণ করে, সে ওই তিথি নক্ষত্রের কারণেই। গ্রামে-গঞ্জে শিবপূজার সন্ন্যাসীরা এদিন বানেশ্বর পূজা করে, বহুরূপী সেজে গ্রামে-বাজরে মাঙন মাঙে। শহর-গ্রাম উভয় স্থানের হিন্দু ব্যবসায়ীরা করে হালখাতা।

সেই পাকিস্তান আমলে মৌলবাদী শক্তি এবং পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের মধ্যে এই বিভাজনটাই করতে চেয়েছিল, যা তারা তখন করতে পারেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার পাকিস্তানের সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ দুই দেশে পৃথক দিনে অনুষ্ঠিত হওয়াটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ম্বৈরশাসক এরশাদের বিদায়ের পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার কতবার ক্ষমতায় এলো-গেলো, কিন্তু কেউ-ই হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করে সংস্কারকৃত পঞ্জিকা বাদ দিয়ে আগের পঞ্জিকা ফিরিয়ে আনার কথা ভাবলো না।

বাংলা পঞ্জিকা মুসলমানদের যাপিত জীবনে কোনো কাজেই আসে না। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় সকল অনুষ্ঠান পালন করে আরবের হিজরি পঞ্জিকা অনুসরণ করে। তাহলে বাংলা পঞ্জিকার মতো মুসলমানদের কাছে অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় হঠাৎ কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো প্রথমে পাকিস্তান শাসকের কাছে, পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের কাছে? কেন প্রয়োজন বোধ হলো সংস্কারের? হলো এই জন্য যে যাতে করে ভারতের বাঙালি হিন্দুদের নানা উৎসব থেকে পূর্ব-পাকিন্তান এবং পরবর্তীকালের বাংলাদেশের মুসলমানদের আলাদা করা যায়, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের একটা দেয়াল তুলে দেওয়া যায়।

পঞ্জিকা সংস্কারের কারণে পহেলা বৈশাখ পালন নিয়ে ক্ষোভটা থাকার কথা বাংলাদেশের হিন্দুদের। তাদের পক্ষে পহেলা বৈশাখ বর্জনের ডাক দেওয়াটাও অন্যায্য নয়। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা সরকারের বিরুদ্ধেও জোরালো কোনো প্রতিবাদ করেনি। পহেলা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধেও নয়। অথচ পহেলা বৈশাখের উৎসব বর্জনের ডাক দিয়ে বিভাজন রেখা তৈরি করে রাখে মৌলবাদী মুসলমানরা!

বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরি করতেই বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়েই পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধ করা হয়। আর ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সাধারণ পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নওয়াব বংশোদ্ভূত খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতি নয়।’

আশ্চর্যের বিষয় এর সমর্থনে তখন এগিয়ে আসে চল্লিশজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং দৈনিক পাকিস্তানে তাদের বিবৃতি ছাপা হয়। এদের মধ্যে শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, আইনজীবী, গায়কও ছিলেন। আর এদের বিপরীতে রবীন্দ্র সংগীতের পক্ষে বিবৃতি দেন মাত্র আঠারো জন বুদ্ধিজীবী।

এত সব কাণ্ড করেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানদের বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা থেকে দূরে রাখা যায়নি। রবীন্দ্রচর্চাও তাঁরা বাদ দেন নি। পূর্ব-পাকিস্তানে যে বছর রবীন্দ্র সংগীত নিধিদ্ধ হয়, সেই ১৯৬৭ সালেই ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন পহেলা বৈশাখে রমনা পার্কের বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শাসকের চোখ রাঙানি কখনোই পরোয়া করেনি ছায়ানট। শাসক রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করেছে, বিপরীতে মানুষের মাঝে রবীন্দ্র সংগীত ছড়িয়ে দেবার কাজ করেছে ছায়ানট।
তবে বাধা ছিল, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির চর্চা বলে প্রচার করত একটা শ্রেণি, অসাম্প্রদায়িক বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের গায়ে সাম্প্রদায়িক তকমা লাগানোর চেষ্টা করত। কিন্তু সফল হতে পারেনি তারা। বরং দিন যত গেছে ছায়ানাটের বর্ষবরণ উৎসব সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে তত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। কেবল বাংলাদেশীরাই নয়, ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশীরাও এখন বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দেয়। সমগ্র রমনা পার্ক, সোরওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাস্তা জুড়ে মেলা বসে। হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন কল্পনাও করা যায় না।

এই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। যশোরের বেসরকারী সংগঠন চারুপীঠ অশুভ শক্তির বিনাশ কামনায় পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা বের করেছিল। তখন অবশ্য সেই শোভাযাত্রার নাম ছিল- আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৯৬ সালে আনন্দ শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে চারুকলা। হাতি, বাঘ, মাছ, পেঁচা ইত্যাদি প্রাণির ভাস্কর্য এবং নর-নারী ও বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির মুখোশ নিয়ে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, নাচ-গান করতে করতে পহেলা বৈশাখের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় চারুকলা থেকে। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় এই শোভাযাত্রায়। কয়েকটি রাস্তা পরিভ্রমণ শেষে মঙ্গল শোভাযাত্রা ফিরে আসে চারুকলায়। কখনো কখনো বানানো হয় অশুভ শক্তির প্রতীকী মুখোশ।

এই অশুভ শক্তি কারা? বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, যারা ১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালীর ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তারা অশুভ শক্তি। মৌলবাদী এবং জঙ্গিগোষ্ঠী অশুভ শক্তি। দূর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, টাকা পাচারকারী, দেশ ও দেশের মানুষের অন্বিষ্টকারীরা অশুভ শক্তি। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একত্রিত করে মানবিক বোধ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। পহেলা বৈশাখের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা শিল্পসমৃদ্ধ নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে।

অনেকের প্রশ্ন এই যে- পহেলা বৈশাখে এইসব প্রাণি বানিয়ে শোভাযাত্রা আগে তো ছিল না, তাহলে এখন হয় কেন? এর উত্তর হলো- সংস্কৃতি হচ্ছে নদীর মতো প্রবাহমান, সংস্কৃতি চিরকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। কখনো কখনো সংস্কৃতিতে নতুন উপাদান যুক্ত হয়, আবার কখনো কখনো পুরাতন অনেক উপাদান বাদ পড়ে যায়। বাঙালির সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখ ছিল, আছে এবং থাকবে। কখনো তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে, আবার কখনো পুরাতন কিছু রীতি বাদ যাবে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ উদযাপন চলতেই থাকবে।

আজ থেকে একশো বছর আগে দূর্গাপূজা কিংবা ঈদ যেভাবে পালন করা হতো, এখনো কি সেভাবে পালন করা হয়? হয় না। এই একশো বছরে দূর্গাপূজা এবং ঈদের জৌলুস বহুগুণে বেড়েছে, দূর্গাপূজা-ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, উদযাপনের ধরন বদলে আরও বেশি বর্ণময় হয়েছে। এখন তো পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ঈদের দিনে ঈদ শোভাযাত্রাও বের করে। এও তো ঈদ আনন্দে নতুন সংযোজন। এসব বাদ দিতে হবে? নিশ্চয় না।
জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আয়োজন এখন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মধ্যেই সীমিত নেই, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। এমনকি কয়েকটি দেশের প্রবাসীরাও পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আয়োজন করেন।

আমাদের সংস্কৃতির এই অগ্রযাত্রাই সহ্য করতে পারছে না মৌলবাদী শক্তি। তারা এখন উঠে-পড়ে লেগেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পহেলা বৈশাখের গায়ে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির তকমা লগিয়ে তা বন্ধ করতে। মৌলবাদীদের ভাষ্য অনুযায়ী- মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পহেলা বৈশাখ যদি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিও হয়, তাহলেই বা সেটা বন্ধ করতে হবে কেন? বাংলাদেশে তো দেড় কোটির অধিক হিন্দু বসবাস করে। তারা তাদের সংস্কৃতি পালন করতে পারবে না? আর মৌলবাদীরা যে সংস্কৃতিকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের বর্জন করতে বলে, তা কিন্তু মুসলমানদেরও সংস্কৃতি, আজকের এই মুসলমানদের পূর্ব-পুরুষরাই একদা এই সংস্কৃতি পালন করেছেন। এই দেশের বেশিরভাগ মুসলমানের শিকড় এই মাটিরই। নিজের সংস্কৃতি বর্জন করলে মানুষ উন্মুল হয়ে যায়। মুসলমানদের মধ্যে এই বোধের বিকাশ যত দ্রুত হবে, দেশে তত দ্রুত শান্তি ফিরে আসবে। নবী মুহাম্মদ নিজেও তো পৌত্তলিক সংস্কৃতির হজ-ওমরাহ বর্জন করেননি। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের অনেক সংস্কৃতিই ইসলামে ঢুকে গেছে। আজ যেসব মুসলমান মৌলবাদীরা সংস্কৃতি বর্জনের কথা বলে, তারা কি ভাত ছেড়ে রুটি খায়? হিন্দুরা চাঁদ-সূর্যকে দেবতা জ্ঞান করে পূজা দেয় বলে মুসলমান মৌলবাদীরা কি গায়ে রোদ-জ্যোৎস্না মাখে না?

২০০১ সালের পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা বোমা হামলাও করেছিল। সেই হামলায় ১০ জন মানুষ নিহত হন। তারপরও মানুষ কিন্তু ভয়ে ঘরে বসে থাকেনি। হাজারে হাজারে মানুষ পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দিয়েছেন আর উৎসবের জৌলুস আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে তুলেছেন। পহেলা বৈশাখ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে শিরক আখ্যা দিয়ে মৌলবাদীরা যেসব সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, সেইসব মানুষের উচিত নিজের শিকড় ও ঐতিহ্যের দিকে ফিরে তাকানো এবং এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য অনুধাবন করা। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিহীন মানুষ এক উন্মুল ও অপূর্ণাঙ্গ মানুষ, অর্ধমানব। এই মানুষেরা ফিরে আসুক সংস্কৃতির বটবৃক্ষের তলায়, সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত হোক। দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক বর্ষবরণের সৌন্ধর্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা।


ঢাকা
১৪৩০





সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৭
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×