নাহ! এমন কিছু আমার জন্যে নয়। আমি দেখতে একদম কুৎসিত নই, আমি অনেক গোছালো স্বভাবের, রাত জেগে পড়াশুনা করি আর যাই করি, সকালে আমার চোখের নিচে হালকা কালচে ভাব দেখে একমাত্র অর্ক ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না আমি জেগে ছিলাম। ও আমাকে দেখে কখন এটাই আমি বুঝি না। সবসময় এমনকি আমার সাথে থাকার সময়েও অন্য মেয়েদের গিলতে থাকে, অবশ্য বাজে দৃষ্টি নয়, ওর দৃষ্টিতে থাকে এক ধরনের মুগ্ধতা। আমার ভীষণ হিংসে লাগে, আমি সহ্য করতে পারি না তখন। ওকে আমার নিজস্ব সম্পত্তি মনে হয়, যে কারনে ওর আর এখন কোন বন্ধু নাই বললেই চলে। এই হাবাগোবাটার প্রেমে আমি কিভাবে পড়লাম সেটাই তো মাঝে মাঝে বুঝি না। আচ্ছা অনেক হয়েছে কথা এবার আমাদের পরিচয় দেই, আমি নিলু অথবা নীলা। আর ও হচ্ছে একজন অর্ক। ও আমার ক্লাসেই পরে যদিও ওকে ক্লাস করতে তেমন দেখা যায় না। সারাদিন পরে পরে ঘুম। কিভাবে যে পারে? মাঝে মাঝে ডেটিং এর জন্য আমি একা একা বসে অপেক্ষা করি আর ও হাজির হয় তিন চার ঘণ্টা পর। আর এসেই বলবে ক্যান যে এত্ত তাড়াতাড়ি আসো আরেকটু পরে আসলে কি এমন সমস্যা হয়? বুঝো অবস্থা অন্যায় করবে ও আর সব দোষ আমার।
আমাদের বাসাটা ধানমন্ডি লেকের পাশেই, আমার রুমের বারান্দা থেকেই আমি লেক দেখতে পাই, বাসায় ভেসে আসে মিস্টি হাওয়া, তবে মাঝে মাঝে পচা ছেলেদের হতাশার কটু গন্ধও ভেসে আসে না এমন নয়। মাঝে মাঝে আমি বিকেলে বারান্দায় গিয়ে দাড়াই আর দেখতে পাই চলমান প্রেম, না চলমান প্রেমিক জুটি, শব্দটা আমার পছন্দ হয় না, প্রেমিক জুটি না হয়ে প্রেমিকা জুটি হবে না ক্যানো? ক্যানো চারপাশে পুরুষবাচক শব্দের এত ছড়াছড়ি? বিরক্ত হয়ে আবার নিজের রুমে এসে বসি। আমার আবার একটা স্পেশাল শান্তি আছে সেটা হচ্ছে আমার রুম আমি পরিবারের অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছি, এটা বাসার বাকি তিনজন মেনে চলে। সবাই ভালো করেই জানে যদি না মানে তবে যা হবে তার কোন অর্থ থাকবে না। আমি পিসিতে একটা গান ছাড়ি "যদি মন কাঁদে এক বরষায় তবে তুমি চলে এস" অথবা " প্রেম একবারি এসেছিলো নীরবে আমারি দুয়ারো প্রান্তে, সে এসেছিলো পারিনি জানতে"। আর গান চলতে চলতেই যেন বৃষ্টি চলে আসে পরিবেশ কিংবা আবহটাকে আরো মায়াময় করে তুলতে। আমি তখন কাঁদতে শুরু করি। এ কান্নার কোন মানে নাই, আমার কোন আপ্সুস, দুঃখ, কষ্ট কিংবা হারানোর বেদনা নাই। জীবনে যা চেয়েছি তা পেয়েছি অথবা আদায় করে নিয়েছি টাইপ মেয়ে। তবুও ভীষণ কান্না আসে। আমার বুক ভাসে কান্নার জ্বলে। হয়ত এ আমার দুঃখ বিলাস। আমি কাঁদি আর অঝোর ধারায় পৃথিবীও কাঁদে।
অনেকদিন আগে আমার এই অহেতুক কান্নার কথা অর্ক কে বলেছিলাম ও সব শুনেটুনে চুপ করে আছে, কিছুই বলে না। নাহ একটা টা কিংবা একটা টু। কোন আওয়াজ নাই, আমি পড়লাম মহা ঝামেলায়। এই বোবা ভূতের সাথে কিভাবে সারা জীবন থাকবো চিন্তা করতেছি। ও হটাত আমাকে বলল তুমি যখন ওরকম করে কান্না করবা তখন আমার খুব ওখানে থাকতে ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে করবে তোমাকে দেখতে, ক্যানো যে এই অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা আমাকে বললা। আমার লজ্জা লাগে খুব। পরক্ষনেই ভীষণ তেজ নিয়ে বলি হু আমার কান্না দেখতে ইচ্ছে করে তোমার? তুমি তো ছেলে ভালো না, সারা জীবন আমাকে কষ্ট দেয়ার পায়তারা করছো নাকি? আর এইটা কেমন সখ যে আমার কান্না দেখতে চাও, ছি তোমার লজ্জা করলো না? আমার উচ্চমাত্রার ধমকে ও বেচারা কাহিল হয়ে যায়, আরো লজ্জা পায় যখন পথচারী ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। তারপর যখন আদর করে ওর কানটা ধরে বলি তোমার কান ধরতে আমার খুব মজা লাগে তখন ও একটু ধাতস্ত হয়ে আমার কান ধরে বলে তোমার কান ধরতেও আমার খুব ভালো লাগে। আমার প্রেম করি।
এর মাঝে একদিন রেজাল্ট দিয়ে দিলো, ফাইনালের, ওকে আরো কমপক্ষে দুইটা সেমিস্টার পড়তে হবে, আর আমার সিজিপিএ ৩.৯০। আমি না পারছি খুশি হতে না পারছি আনন্দিত হতে। কিভাবে কি করি? এদিকে বাসা থেকে বিয়ের চাপে চাপে নিজেকে আর সোজা করতে পারছি না। সব শেষে কোনরকমে আমতা আমতা করে বাসার সবাইকে টিভির রুমে গিয়েই বললাম ওর কথা। সবাই জাস্ট বিশাল একটা টাস্কি খায়, মনে হচ্ছে তাদের মাথার উপরেই আমেরিকার টুইন টাওয়ার ক্রাশ করছে। আমার সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিলো আমি অনেক বুদ্ধিমতি, যদি কোন ছেলেকে পছন্দ করিও সেটা হবে সেই রকম বিত্তবান কোন লোকের এক মাত্র ( বখে যাওয়া কু) সন্তান। কিন্তু এ আমি কি করলাম? ছেলে এমনকি ভালো ছাত্রও নয়। তারা সবাই আমার উপর ঝাপিয়ে পরবে বিশাল আক্রোশে, এতদিনে এই বদরাগী ব্যাক্তিত্তের মেয়েটার একটা দুর্বলতা পেয়েছে তারা। নিজেদের মেয়েই যেন মহা শত্রু ছিলো আমি আবিস্কার করলাম। কিভাবে কবে নিজের আব্বু আম্মুর সাথে এত দুরুত্ত হলো আমি তাদের মুখ পানে চেয়ে ভাবতে থাকি, আসলে কবেই বা কাছাকাছি ছিলাম? জন্মের পর থেকে আয়া বুয়ার কোলে কোলে ঘুরেছি খেয়েছি, পড়াশুনা জন্যে পিচ্চি থেকেই টিচার আর টিচার। সব বুড়ো বুড়ো নাম করা টিচার। অবশ্য মোটা অংকের টাকা স্যালারী পাওয়ার জন্যে কেউ কখন আমাকে বকা ঝকা দেয় নাই। আমি এমনকি তাদের দাড়িও টেনে দিতাম। দস্যি মেয়ে কিনা। তবে হ্যা একটা টিচার ছিলো আমার খুব প্রিয়, আমি ক্লাস ওয়ান থেকে এসেসসি পর্যন্ত তার কাছে পড়েছি সে, ছিলো আমার অংকের টিচার। উনি আমাকে শুধু অংক ক্যানো সব বিষয়ের কৌতূহল মিটাতেন।
শেষমেশ পরিবার আর আত্মীয়স্বজনের সাথে আর পেরে উঠি না ইন্ট্রোভারট আমি। ভেবে ভেবে একটা ডিশিশান জানাই সবাইকে আমি আরো পড়াশুনা করবো, কেউ না মানতে চাইলেও মানা করতে আর পারে না তারা। মিউনিখের উদ্দেশ্যে যাবার কয়েকদিন আগে অর্ক কে জানাই সব কিছুই। ও শুধু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা অর্ক তুমি কি একবার পারতে না আমাকে থেকে যেতে বলতে? আমি তোমাকে সেই অধিকার দেইনি? তুমি কি পারতে না বলতে চলো তুমি আমার সাথে। বলোনি কেন? আমার মাঝে মাঝেই খুব জানতে ইচ্ছে করতো। ওখানেও গিয়েও কতো যে কেঁদেছি, এই জীবনে আমাকে মাত্র দুইটা মানুষ বুঝে তুমি আর সেই অংকের শিক্ষক। আর সব তুমি বুঝেও আমাকে কেন বলোনি? বহু বছর পর যেদিন তোমাকে আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম তুমি বলেছিলে তোমার অহমে লেগেছিলো বড্ড। নাহ আমাকে নিয়ে নয় আমার পরিবারের তোমার পরিবারের প্রতি মুল্যায়ন। হ্যা সে আমি বুঝতে পেরেছি দেশে ফিরেই এসে দেখলাম তোমার বেশ বাড়বাড়ন্ত। তুমি এখন একটা নাম করা ফার্মের মালিক, কত্ত যে টাকা। আমার পরিবার আর না করতে পারবে না এবার।
কিন্তু তুমিও অনেক বদলে গিয়েছিলে নাকি? আমি বুঝতে পারি না অত। যদি বদলে যাও সেই ভয়ে তোমার সামনে আসিনি। তুমিও তো একদিন খোজ নাওনি। একবার ফোন পর্যন্ত করোনি, কিংবা একটা মেসেজ। আমার সেই কষ্টের দিনগুলি এখন আর নেই। পাগল ছেলে, ঘুম কাতরে ছেলেটা বদলে গিয়েছিলো বাহিরে শুধু ভিতরে সে রয়ে যায় আগের মতোই। এখনো সে তখনের মতো আমাকে ভালবাসে। আমি শুধু অনুভব করি ওর প্রতিটা অনুভূতি জুড়ে শুধু আমি আর আমি।
এই নিলু চটপটি খাবা?
হুম
এই যে নাও গরম গরম রান্না করে এনেছি। হাসি মুখে আমার পাশে বসে ও আমাকে নিজের হাতে চটপটি খাইয়ে দেয়, আর আমার চোখ জুড়ে শুধু ভাললাগা অনুভূতি ফুটে উঠে। ওরও তাই।
আমাদের নতুন অতিথি আসছে সামনের মাসেই, ও তাই ছুটি নিয়েছে এক মাসের, আর এই সুযোগে ওর হাতের অসাধারন রান্না গুলো খেতে পারছি আমি। ওর রান্না হাত দারুন। ইচ্ছে আছে কাল সকালের ওর শহরে চলে যাবো, ওর শহরটাও দারুন, কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে। জীবনানন্দ দাস ঐ নদীর পাড়ে বড় না হলে কিভাবে যে কবি হতেন আমিও ভাবি মাঝে মাঝে। ওখানে ওদের বাসায় বসে প্রতি সকালে শাশুড়ির হাতের যত্ন নিয়ে বানানো নাস্তা আর দুপুরে তাজা তাজা মাছ আর ওর হাতের রান্নার সুবাস। দারুন মজার হবে তাই না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



