ডাক্তাররা বলেন নিয়ম মেনে রোজা পালন করলে সাধারণত সমস্যা হয় না, বরং রোজা রাখলে শরীরের উপকার হয়। এরপরও রোজাদারদের বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় যেমন-
হার্টবার্ন বা বুকজ্বলা
পাকস্থলীতে খাবার হজম করার জন্য সব সময় এসিড থাকে। এই এসিডে আবার খাদ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়। কিন্তু পাকস্থলীর গাত্রে থাকা বিশেষ পিচ্ছিল আবরণ নিজেকে এসিডের হাত থেকে বাঁচায়। তবে কোনো কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসিড তৈরি হলে বা পাকস্থলীতে খাবার না থাকার সময় এসিড নিঃসরণ হলে অথবা পাকস্থলী থেকে এসিড ইসোভেগাসে (খাদ্যনালির অংশ) চলে এলে বুক জ্বলে। রোজার সময় এই হার্টবার্ন বা বুকজ্বলা সমস্যাটি অনেকের হয়। সাধারণত রোজা রাখলে এসিড কম তৈরি হওয়ার কথা, কিন্তু ক্ষুধা পেলে ও খাবারের কথা চিন্তা করার কারণে কারও কারও এসিড নিঃসরণ বেড়ে যায়। তাদের হার্টবার্ন বা বুকজ্বলা সমস্যা বেশি হয়। এ সমস্যায় এন্টাসিড, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। সেহরি খাওয়ার সময় এ জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। তবে ওষুধ খেয়ে হার্টবার্ন দূর করার চেয়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে করা বেশি ভালো। পরিহার করতে হবে তৈলাক্ত খাবার, ভাজাপোড়া, বাসি ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার। তা ছাড়া ধূমপান করার অভ্যাস থাকলে তা থেকে এই সময়টা বিরত থাকতে হবে। যাদের টক ঢেকুর আসে, বুক জ্বলে তারা শোয়ার সময় একটু উঁচু বালিশ ব্যবহার করলে উপকার পাবেন। যাদের আগেই হার্টবার্ন বা বুকজ্বলা সমস্যাটি আছে তারা এন্টাসিড, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল ইত্যাদি ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় খেতে পারেন। সেহরির পাশাপাশি ইফতারের পরপর এ ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
মাথাব্যথা
রোজায় খুব কমন সমস্যা এটি। বেশ কিছু কারণে মাথাব্যথা হয়। বড় কারণ পানিশূন্যতা, ক্ষুধা, ঘুম ও রেস্ট কম হওয়া, চা, কফি পান না করা। সমস্যাটি কম হবে যদি সেহরি মিস না হয়, ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পানি ও জুসজাতীয় তরল বেশি করে খাওয়া যায়। যাদের মাথাব্যথার সমস্যা রোজায় প্রতিদিনই হয় তারা সেহরিতে একটা প্যারাসিটামল খেতে পারেন। রোদে যাবেন না, ছাতা ব্যবহার করবেন, সানগ্লাস ব্যবহার করবেন। যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শমতো রোজা রাখবেন।
কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য
রোজায় এ সমস্যা বেশি হয়। এর কারণ পানিশূন্যতা ও আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া। বেশি করে শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে বিশেষ করে ইসবগুলের ভুসি, তবে লাল আটা ও ঢেঁকিছাঁটা চাল খেতে পারলে ভালো উপকার পাবেন। এরপরও সমস্যা থাকলে ল্যাক্সেটিভ ওষুধ খেতে পারেন।
হার্ট কিডনি ও অন্যান্য অসুখ
রোজা রাখার ফলে হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। আবার এসব অসুখ থাকলে রোজা রাখা যাবে না তেমনটিও ডাক্তাররা বলেন না। তবে যারা এসব অসুখে আক্রান্ত কিন্তু রোজা রাখছেন এবং কোনো সমস্যা বোধ করছেন তাদের উচিত ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া।
বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মা
অনেকে মনে করেন, রোজা রাখলে বুকের দুধ কমে যায়। ফলে সন্তান দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কথাটি একদমই ভুল। কেননা রোজা রাখলে বুকের দুধ কমার কোনো আশঙ্কা নেই। এ ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই সেহরি ও ইফতারের সময় প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। ইফতারের পর শোয়ার আগ পর্যন্ত ঘণ্টায় ঘণ্টায় অল্প অল্প করে পানি খেতে হবে।
অ্যাজমা বা শ্বাস কষ্টের রোগী
রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের রোজা রাখতে কোনো বাধা নেই। রোজা রাখা অবস্থায় ইনহেলার নেয়া যাবে কি না এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি ডিজিজ বিভাগের প্রধান ডা. এ কে এম মোশারফ হোসেন জানান, ইনহেলার নিলে রোজা নষ্ট হবে কি না চিকিৎসক হিসেবে তা বলা মুশকিল। যতটুকু জানি ওষুধ সরাসরি রক্তে মিশে গেলে রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সঠিক নিয়মে ইনহেলার নিলে রক্তে ওষুধ মিশতে পারে না বা নগণ্য পরিমাণ মিশতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরামর্শ হলো সেহরি ও ইফতারের সময় ইনহেলার নিন। আর হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিন।
চোখের ছানি
রোজায় চোখের রোগীরা যে সমস্যায় পড়েন সেটি হলো রোজা রাখা অবস্থায় ড্রাগ ব্যবহার করতে পারবেন কি না। এর কারণ চোখে ড্রপ দিলে তা মুখে চলে যেতে পারে, যা রোজার জন্য ক্ষতিকর। বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট চক্ষুবিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ জানান, চোখের সঙ্গে নাকের যোগাযোগকারী একটি নালি আছে। কেউ কাঁদলে চোখের পানি তাই নাকে চলে আসে। তাই চোখে ড্রপ নেয়ার সময় চোখের ভেতরের কোনায় (নাকের পাশে) চেপে ধরলে নালিটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওষুধ নাকে বা গলায় যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সে ক্ষেত্রে রোজা রেখে আপনি অনায়াসে চোখে ড্রপ দিতে পারেন। প্রয়োজনে পদ্ধতিটি রপ্ত করার জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়
অধ্যাপক ডা.এম এ জলিল আনসারী রমজান মাসে রোজা পালনের সময় ডায়াবেটিস রোগীদের কী কী নিয়ম ও সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন সেসব নিয়ে রোগী ও তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে স্বভাবতই অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। এছাড়া নবীন চিকিৎসকরাও অনেক সময় রোজার সময় ডায়াবেটিসের চিকিৎসার বিষয়ে রোগীদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হন।
রোজা ও রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী রোজাদারকে শেষরাত হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা কোনো প্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। সন্ধ্যা হতে শেষরাতের মাঝে ইফতারি, রাতের খাবার ও সেহরি গ্রহণ করতে হয়। এতে অনেক ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রাত্রিকালে কম সময়ের মধ্যে বেশি খাবার গ্রহণের ফলে রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং দিনের ভাগে বিশেষ করে বিকেলে ইফতারি গ্রহণের আগে রক্তের গ্লুকোজ কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মতো মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্যই রোজার সময় কীভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে রোজার আগে থেকেই সে বিষয়গুলো রোগীদের জানা প্রয়োজন। গত দুই দশকে এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা পালনকালীন নিয়মের ব্যাপারে অতীতের অনেক সংশয় ও মতানৈক্য দূর হয়েছে। তবে কোনো রোগী রোজা থাকতে পারবে কি পারবে না এ ব্যাপারে চিকিৎসকের মতামতের সঙ্গে রোগীর ইচ্ছার যথেষ্ট গরমিল লক্ষ করা যায়। বাস্তবে চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে অনেক ডায়াবেটিক রোগী সম্ভাব্য জটিলতার বিষয় জেনেশুনেও রোজা পালন করতে আগ্রহী হন।
ঝুঁকি পূর্ণডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসকদের দৃষ্টিতে রোজা পালনের সময় সম্ভাব্য জটিলতার মাত্রানুসারে ডায়াবেটিস রোগীদের ১. অত্যধিক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ২. বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৩. মাঝারি ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪. কম ঝুঁকিপূর্ণ এ চার শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। অত্যধিক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ডায়াবেটিক রোগীরা হলো এমন ডায়াবেটিক রোগী-
• যারা প্রায়ই হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হন অর্থাৎ রক্তের গ্লুকোজ কমে যায়
• গত তিন মাসের মধ্যে কখনো হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে
• যারা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে বুঝতে পারেন না
• যাদের অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম করতে হয়
• যাদের ডায়াবেটিস খুব বেশি অনিয়ন্ত্রিত
• যারা ৩ মাসের মধ্যে কখনো রক্তের গ্লুকোজ বৃদ্ধিজনিত জটিলতা যাকে ডায়াবেটিক কিটোএসিডসিস ও কমা বলা হয় এমন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন
• গর্ভবতী মহিলা, কিডনি ফেইল বা অন্য কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত রোগী
• যারা টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
• অন্যদিকে যারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ব্যায়াম ও শুধু মেটফরমিন ও এ জাতীয় ওষুধের অতিরিক্ত কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না, তাদের জন্য রোজা পালনে ডায়াবেটিসের জন্য কোনোরূপ বাড়তি ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এর মাঝামাঝি শ্রেণীর রোগী যাদের ডায়াবেটিস প্রায় অনিয়ন্ত্রিত থাকে, যাদের একা থাকতে হয়, যারা ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনি, হার্ট, ফুসফুস, লিভার বা অন্যান্য অঙ্গের কঠিন রোগে আক্রান্ত তাদের রোজা পালনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। লক্ষণীয়, ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন প্রকারের ঝুঁকি চিহ্নিত করা বা বুঝতে পারা রোগীদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া রোজা পালনের সময় ডায়াবেটিক রোগীদের ওষুধ ও খাদ্য গ্রহণের নিয়মাবলির বেশ পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কোনো ডায়াবেটিক রোগী উল্লিখিত ঝুঁকিগুলো সঠিকভাবে জানার পরও রোজা পালনে আগ্রহী হলে তাকে রোজা থাকাকালীন খাদ্য, ব্যায়াম, ওষুধ গ্রহণ ও ডায়াবেটিস চেকআপের নিয়মাবলি অনুসরণ করতে হয়। এ জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত নিম্নবর্ণিত পরামর্শগুলো প্রদান করে থাকেন।
যাদেররো জানা রাখার পরামর্শ প্রদান করতে হয় ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস রোগী বিশেষ করে যখন তাদের ডায়াবেটিস প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিত থাকে, যাদের ডায়াবেটিস অতি সম্প্রতি শনাক্ত হয়েছে এবং রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, যারা নিয়মিত ওষুধ, খাদ্য ও পরামর্শ গ্রহণ করতে অপারগ, যাদের ডায়াবেটিসের পাশাপাশি হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস বা অন্য কোনো সিস্টেমের মারাত্মক অসুখ রয়েছে, গর্ভবতী মহিলা, সম্প্রতি হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ও যারা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে বুঝতে পারেন না। হাইপারগ্লাইসেমিয়াজনিত মারাত্মক জটিলতা, বার্ধক্যজনিত জটিলতা, জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগী, অনিয়ন্ত্রিত মৃগিরোগী ইত্যাদি।
খাদ্যনিয়ন্ত্রণ
রোজা পালনকালীন খাদ্য তালিকায় তেমন কোনো পরিবর্তন করতে হয় না। শুধু খাবারের সময় পরিবর্তন করতে হয়। রোজার আগে কারও ২ হাজার ক্যালরি খাবার তালিকা প্রযোজ্য হলে রোজা পালনকালীনও সেই ক্যালরিসমৃদ্ধ খাদ্যই গ্রহণ করা যাবে। দৈনিক খাদ্যতালিকার খাবার ইফতারি, সান্ধ্যকালীন খাবার ও সেহরির খাবারে ভাগ করে খেতে হবে। ইফতারির সময় পরিমিত ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি ইত্যাদি খাওয়া যাবে। তবে মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন জিলাপি, চিনি, গ্লুকোজ, গুড় ইত্যাদি মিষ্টির তৈরি শরবত বাদ দেয়া ভালো। সালাদ ও সবজি ইচ্ছামতো খাওয়া যাবে। একবারে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা ঠিক হবে না। বেশি পরিমাণে পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত হবে। প্রয়োজনে সুগারবিহীন এসপারটেমযুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে।
সন্ধ্যারাতের খাবার ও সেহরিতেও মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার অথবা কম খেতে হবে। ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডাল, দুধ, সবজি ইত্যাদির মাধ্যমে রোজা পালনের সময়ও খাদ্যকে সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করা যায়। এ ব্যাপারে পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। সেহরির খাবার যতদূর সম্ভব দেরিতে গ্রহণ করা ভালো।
ব্যায়াম
যথারীতি ব্যায়াম করা যাবে তবে ইফতারির আগে বেশি কায়িক পরিশ্রম করা ঠিক হবে না। সন্ধ্যারাতের খাবার গ্রহণের পর পরিমিত ব্যায়াম করা যেতে পারে। তারাবিসহ রাত্রিকালীন নামাজ আদায়ে বেশ ব্যায়াম হয়ে থাকে।
মুখে খাবার ওষুধ
চিকিৎসকরা রোজা পালনকালে ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবনে বেশ কিছু পরিবর্তন করে থাকে। চিকিৎসকদের মতামতেও কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। সাধারণত মেটফরমিন ও এ জাতীয় ওষুধে যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের ওই ওষুধই একই মাত্রায় ইফতারির পর ও সেহরির পর গ্রহণ করতে বলা হয়। যারা মেটফরমিন ছাড়া অন্য খাবার ওষুধ (সালফোনিলইউরিয়া শ্রেণী) গ্রহণ করেন তাদের সকালের ডোজ অপরিবর্তিত রেখে ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজ অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আগে গ্রহণ করতে বলা হয়। এ শ্রেণীর যেসব ওষুধ শরীরে অল্পক্ষণ কাজ করে রোজার সময় সে ওষুধ ব্যবহার করা কিছুটা সুবিধাজনক।
ইনসুলিন
যাদের দিনে দুবার অর্থাৎ সকালে ও বিকেলে ইনসুলিন নিতে হয় তাদের সবার ডোজ অপরিবর্তিত মাত্রায় ইফতারের আগে এবং বিকেলের ডোজ অর্ধেক করে সেহরির আগে গ্রহণ করতে হবে। রক্তের গ্লুকোজের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে ইনসুলিনের মাত্রা পরিবর্তন করতে হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ সাম্প্রতিক সময়ে বাজারজাত স্বল্প সময় কাজ করে এরূপ ইনসুলিন রোজা পালনকালে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অধিকতর সুবিধাজনক হতে পারে। রোজার সময় দীর্ঘ সময় কাজ করে এরূপ ইনসুলিন সন্ধ্যাকালে গ্রহণ করা উচিত। সেহরির সময় এ শ্রেণীর ইনসুলিন গ্রহণে ইফতারের আগে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
রোজা পালনকালে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ মেপে লিখে রাখা প্রয়োজন। ইফতারের আগে, এর ২ ঘণ্টা পর, সেহরির আগে, এর ২ ঘণ্টা পর এবং কখনো হাইপো অথবা হাইপারগ্লাইসেমিয়ার ন্যায় উপসর্গ বা সন্দেহ হলেই রক্তের গ্লুকোজ মেপে নেয়া প্রয়োজন। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৬০ মিলিগ্রামের কম হলে বা ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি হলে রোজা ভেঙে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হর মোনরোগ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
প্রসূতির রোজা ডা. ইমনুল ইসলাম ইমন
মায়ের দুধ শিশুকে দেয়া আল্লাহ ওয়াজিব করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারায় শিশুকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ দানের নির্দেশ দিয়েছেন। মায়ের বুকের দুধ আল্লাহর বড় নেয়ামত। শিশুর পুষ্টি, জীবনধারণ এবং বৃদ্ধির জন্য মায়ের দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দুধ শিশু জন্মের ছয় মাসে শুধু প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে না বরং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক টিকা হিসেবে কাজ করে। শিশুর বয়স বাড়ার পরেও মায়ের দুধ বিভিন্ন রোগ থেকে তাকে মুক্ত রাখে। মায়ের দুধ খেলে শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়, ফলে শিশুর ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানপাকা, মেনিনজাইটিস, একজিমা, অ্যালার্জি, দাঁতের অসুখ ইত্যাদি কম হয়। এছাড়া রোগ হলেও এদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে এরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
রমজান মাসে প্রসূতি মায়েরা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি রোজা রাখার জন্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। প্রসূতি মায়েদের বেলায় রোজা রাখার জন্য চিকিৎসকের মতামত প্রয়োজন। প্রসূতি মায়েরা তাদের খাবার গ্রহণের বিষয়ে এমন খাবার পছন্দ করবেন যাতে করে পুষ্টির ঘাটতি দেখা না দেয়। দৈনিক খাবার তালিকায় আমিষজাতীয় অথবা প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি থাকতে হবে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, ডাল থেকে আমিষজাতীয় খাদ্যের উপাদান পাওয়া যাবে। বুকের দুধে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়ামের উপস্থিতির জন্য খেতে হবে সবুজ শাকসবজি, দই, পনির, বাদাম, কমলা, কলা, আঙুর, আপেল ইত্যাদি। ইফতারের আয়োজনে কলিজা সিঙাড়া, কাবাব, ডিম, লাচ্ছি রাখা যেতে পারে। খেজুরসহযোগে ইফতার করলে প্রয়োজনীয় লৌহের চাহিদা মেটে। ইফতারের শুরুতেই পর্যাপ্ত তরলজাতীয় খাবারের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়।
প্রসূতি মায়ের বেলায় বুকের দুধ বাড়াতে তরলজাতীয় খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্য পানি ছাড়াও স্যুপ, ঝোল, ডাল, শরবত, সাগু ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। রোজা রাখার জন্য রমজানের সেহরি, ইফতার, সন্ধ্যারাত তিন বেলায় পর্যাপ্ত সুষম খাবারের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে নবজাতকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন-
শিশু দৈনিক ছয়বারের বেশি প্রস্রাব করছে কিনা, শিশুটি দৈনিক চারবার আঠালো মল ত্যাগ করছে কিনা, শিশুটির ওজন বাড়ার গতি ঠিক থাকছে কিনা। শিশুটি দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টায় ৮-১২ বার বুকের দুধ পান করছে কিনা। উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে শিশুটির প্রস্রাব, পায়খানা, বৃদ্ধি, স্বাভাবিক থাকলে তাহলে বলা যেতে পারে শিশুটি পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে। পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাওয়া গেলে প্রসূতি মায়ের রোজা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, পর্যাপ্ত বুকের দুধের অভাবে শিশু যদি দুর্বল, ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে প্রসূতি রোজা ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী সময়ে তা আদায় করে নেবে।
প্রসূতি মা রোজা রাখতে চাইলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। রোজা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য যেমন-শর্করা, চর্বি, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি আনুপাতিক হারে গ্রহণ করতে হবে। কারণ প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য গ্রহণের ফলেই মায়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষা পায় এবং নবজাতকের বৃদ্ধির গতি স্বাভাবিক থাকে।
লেখক: জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশুবিভাগ) শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা
আখতারুন নাহার আলো
প্রত্যেক মুসলমানেরই শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পথ্যবিদদের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখা উচিত।
হূদরোগ
হার্টের রোগীরা কতখানি অসুস্থ সেটি হিসাব করেই রোজা রাখতে হবে। তবে এটি ঠিক যে, রোজার সময় ইফতারিতে যেসব উপাদান থাকে তা প্রায়ই ডুবো তেলে ভাজা হয়। এগুলো সবই ট্রান্সফ্যাট। এই ট্রান্সফ্যাট রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং তা হূদরোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ জন্য ইফতারিতে ডুবো তেলে ভাজা খাবার পরিহার করে ইফতারির প্লেট সাজানো উচিত।
হূদরোগীর ক্ষেত্রে শরবত কোনো ক্ষতিকারক উপাদান নয়। ফলের রস হলে আরও ভালো হয়। এছাড়া থাকতে পারে ছোলা ভাজা, ঘুঘনি, কুসুমবিহীন সিদ্ধ বা পোচ ডিম। নরম খিচুড়ি, ঘি-চর্বি ছাড়া হালিম, নুডলস, চিঁড়ার পোলাও। ননস্টিক ফ্লাইপ্যানে তৈরি পেঁয়াজু, আলুর চপ, যে কোনো বড়া খাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে তেঁতুল টমেটোর চাটনি থাকলে ভালো হয়। সন্ধ্যারাতে ভাত-মাছ-সবজি এবং ভোররাতে ভাত-মুরগির মাংস বা মাছ-ডাল-সবজি থাকা উচিত। দুধ পান করতে চাইলে ননীবিহীন দুধ খাওয়া ভালো। এর সঙ্গে কলা খেলেও হূদরোগীর জন্য ভালো হয়। যা কিছুই খাওয়া হোক না কেন খাবারে পর্যাপ্ত পানি থাকা প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস থাকলে অনেকেই রোজা রাখতে ভয় পান। আসলে এতে ভয়ের কিছু নেই। তবে ভয়টা অমূলক নয়। কারণ খাদ্য উপদেশ দেয়ার সময় বলা হয় সময়মতো এবং প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর খাবার খাবেন। আর যারা ইনসুলিন নেন তাদের খাবারের আগে অর্থাৎ ১৫-২০ মিনিট আগে ইনসুলিন নিতে বলা হয়। এ জন্য রোজার সময় তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। তবে যদি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তারা রোজা রাখেন তাহলে কোনো অসুবিধাই হয় না। আবার রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষা করলেও রোজা ভাঙবে না। সবচেয়ে সুখের বিষয় এই যে, রমজানের প্রথম আহার ইফতারের প্রায় সব উপাদানই ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উপযুক্ত। শুধু চিনি-গুড় বাদ দিলেই হলো। শরবতের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা বিকল্প চিনি দিয়ে লেবুর শরবত, ইসবগুলের শরবত, তোকমার শরবত, তেঁতুলের শরবত খাওয়া যেতে পারে। তবে ফলের রস নয়। ছোলা-পেঁয়াজুর পাশাপাশি মুড়ি বা চিঁড়া বা ফ্রায়েড রাইস অথবা খিচুড়ি চলবে।
অর্থাৎ যে কোনো একটি শর্করাজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এদিকে নুডলস যেহেতু ময়দার তৈরি এ কারণে এটিও শর্করাজাতীয় খাবারের মধ্যেই পড়বে। আসলে অন্যদিনে সকালের নাশতায় যতটুকু শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার কথা ছিল ইফতারিতে ঠিক ততটুকুই কার্বোহাইড্রেট খেতে হবে। মিষ্টি ফল যেমন-খেজুর, আম, কমলা, আপেল, কলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বলা যায় যদি রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে যে কোনো একটি ফল পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। টক ফল যেমন-আমড়া, কামরাঙ্গা ইত্যাদি রুচি অনুযায়ী খাওয়া যাবে। সন্ধ্যারাতে কেউ রুটি খেতে না চাইলে ভাত খেতে পারেন। তবে এ সময় ডাল বাদ দিলে ভালো হয়। কারণ ইফতারিতে ডালের তৈরি খাবারই বেশি খাওয়া হয়। সেহরিতে ভাত মাছ বা মাংস এবং সবজির সঙ্গে ডাল খাওয়া যেতে পারে। তবে যদি এ সময় দুধ খাওয়া হয় তাহলে ডাল বাদ দিলে ভালো হয়। আর যাদের ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স আছে তারা সয়াদুধ বা যে কোনো নিউট্রিশনের প্রোডাক্ট খেতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে অন্যদিনে পাঁচ থেকে ছয়বার যতটুকু খাবার খাওয়া হতো সেই পরিমাণ খাবারই ইফতার, সন্ধ্যারাতে ও সেহরিতে খেতে হবে। এর বেশি নয়, আবার কমও নয়। আবার কোনো বেলার খাবার বাদও দেয়া যাবে না। তাহলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তশর্করা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। রোজার সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি তারাবির নামাজ পড়া হয়-এ জন্য এ সময় ডায়াবেটিস রোগীর পৃথকভাবে ব্যায়াম করায় কোনো প্রয়োজন নেই।
বৃদ্ধ ব্যক্তিদের রোজা
রোজা পালন করা প্রতিটি মুসলমানেরই অবশ্য পালনীয় বিষয়। সুতরাং বয়স বেড়ে শারীরিক সামর্থ্য কমে গেলেও রোজা রাখতে হয়। ধার্মিক মানুষ বয়সের দোহাই দিয়ে রোজা ছাড়তে পারেন না। তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের শারীরিক অসুস্থতা ও খাবার গ্রহণের ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে তাদের অসুবিধা হয়। অর্থাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে রোজা রাখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। তাদের খাবার হবে সহজপাচ্য ও নরম। ছোলা ভাজা চিবাতে অসুবিধা হলে ঘুঘনি, চটপটি দেয়া যায়। এছাড়া ভিজানো চিঁড়া, নুডলস, হালিম, দুধ-সুজি, দুধ-সেমাই এগুলোও ইফতারিতে সংযোজন করা যেতে পারে। যেহেতু তাদের খাবারে তেলের পরিমাণ কম হবে সে জন্য সন্ধ্যারাতে এবং সেহরিতে কিছুটা হলেও তেল রাখতে হবে। একেবারে তেল ছাড়া খাবারে অনেক সময় বিপাকক্রিয়ায় সমস্যা হয়। এছাড়া স্বাদের একটা ব্যাপার তো থেকেই যায়। বৃদ্ধ ব্যক্তিদের সেহরিতে দুধ-ভাত-কলা দিলে ভালো হয়। তাদের রমজানের খাবার এমন হবে যাতে শরীর ঠিক থাকে। আবার যাদের অসুস্থতা রয়েছে সেই অসুখ বুঝেও ইফতারি দিতে হবে। শরবত তাদের জন্য খুবই উপযোগী খাবার।
ইউরিক এসিড ও রোজা
যেহেতু রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ এ জন্য যতটা সম্ভব রোজা বাদ না দেয়া সবারই উচিত। কিন্তু যাদের ইউরিক এসিড বেশি তারা রোজা পালন করতে গিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। দেখা যায় রোজার সময় ইফতারির উপাদানগুলো বেশির ভাগই ডাল দিয়ে তৈরি হয় ফলে রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে গিয়ে বাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্যথা বেড়ে যায়। এ কারণে সতর্কতার সঙ্গে ডাল অবশ্যই বাদ দিতে হবে। তাদের খাবার তৈরি করতে হবে ময়দা, চালের গুঁড়া, সুজি ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়া তারা খেতে পারেন চিঁড়া, মুড়ি, নুডলস, দুধ, দই, ফ্রায়েড রাইস, ফল, শরবত ইত্যাদি। এ ধরনের রোগীর নিষিদ্ধ খাবার হলো সব রকমের ডাল, ছোলা, বেসন, মটর, মটরশুঁটি, সিমের বিচি, বরবটি, বেগুন, পালংশাক, পুঁইশাক, মাশরুম, আতাফল, সমুদ্রের মাছ এবং কাঁটাসহ ছোট মাছ। এদের ঘি, মাখন, মাছের ডিম, মাংসের চর্বি, মাংসের স্যুপ বাদ দেয়া প্রয়োজন। প্রতিদিন ইফতারিতে আনারস রাখতে পারলে বাতের জন্য উপকার পাবেন।
পানিশূন্যতা
রোজার সময় একটি সমস্যা প্রায়ই হতে দেখা যায়। সেটা হলো পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন। এই কারণে অনেকে রোজা রাখতে ভয় পান। ভয়টি অমূলক নয়। কারণ আমাদের দেহে ৫০-৭০ ভাগ পানি। পানি গ্রহণ ও বর্জন এই দুই প্রক্রিয়ার ওপর পানির সমতা নির্ভর করে। একজন পূর্ণবয়স্কের দুই থেকে তিন লিটার পানি প্রয়োজন। এর বেশি অংশ আসবে তরল খাবার থেকে। বাকি অংশ দৈনিক গ্রহণীয় খাবার থেকে। এদিকে ঘাম, মূত্র এবং মলের মাধ্যমে কিছু পানি ব্যয়িত হয়। বাকিটা ব্যয় হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। পানীয় জল গ্রহণের মাধ্যমে এর ভারসাম্য ঠিক থাকে। একে জলীয় সাম্য বলে। পানির স্থিতিস্থাপকতার জন্য আমরা খাবার গিলে খেতে পারি। এছাড়া শ্লেষ্মাক্ষরণের জন্য অন্ত্রনালি, শ্বাস-প্রশ্বাস, বিপাকক্রিয়া, প্রস্রাবের জন্যও পানি প্রয়োজন হয়।
রোজার সময় দেহে পানির সাম্যতা নষ্ট হয় বলে অনেকে আশঙ্কা করে থাকেন। যদিও এটা আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু যদি ব্যাপারটা এমন হয়, ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত দেহের পুরো পানির চাহিদা মেটানো যায়, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পানিশূন্যতা রোধে তাই যুগ যুগ ধরে ইফতারের প্রথম আহার হিসেবে শরবত বিবেচিত হয়ে আসছে। বিভিন্নভাবে শরবত তৈরি করা যায় যেমন-ইসবগুলের ভুসি, তোকমা, লেবু, তেঁতুল, বেল, বিভিন্ন ফলের রস, দুধ, দই, চিঁড়া ইত্যাদি দিয়ে। শরবত ছাড়াও রাখা যেতে পারে ভেজানো চিঁড়া, দই, হালিম, পায়েস, দুধ-সেমাই ইত্যাদি।
সন্ধ্যারাতে ও সেহরিতে পাতলা ডাল, দুধ ও ভুনা তরকারির পরিবর্তে ঝোলসহ তরকারি রাখতে পারলে ভালো হয়। এভাবে যদি রমজানের সবগুলো দিনের আহার ঠিক রাখা যায়, তাহলে পানিশূন্যতা নিয়ে কোনো ভয় থাকা উচিত নয়।
ইফতার
এই সময় প্রথম উপাদানটি হলো শরবত। এই শরবতের প্রচলন হয়েছে মূলত দেহে পানির ঘাটতি পূরণ করার জন্য। একেকটি বাড়িতে শরবত নিজস্ব স্বাদ ও রুচি অনুযায়ী তৈরি করা হয়। শরবতের উপকরণগুলো হলো-লেবু, তেঁতুল, ইসবগুল, তোকমা, স্কোয়াস, যে কোনো ফলের রস, দুধ, দই, চিঁড়া ইত্যাদি। এর মধ্যে দেখা যায়, প্রতিটি উপাদানেরই খাদ্যগুণ ভালোমানের রয়েছে। যেমন-লেবু ছাড়াও অন্যান্য ফলের রসে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি, খনিজ পদার্থ। আবার ইসবগুল ও তোকমা অন্ত্রের কার্যকারিতা ভালো রাখে। ডাবের পানি বেশ উত্তম। এতে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম রয়েছে। যাদের প্রস্রাবে সমস্যা রয়েছে, অর্থাৎ প্রস্রাব কম হয় তাদের জন্য ডাবের পানি খুবই কার্যকর। রমজানে ডাবের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। শরবতের পর প্রথমেই আসে ছোলার কথা। ছোলা ভাজায় পেঁয়াজ, শুকনো অথবা কাঁচা মরিচ, টমেটো, শসা দিয়ে খেলে সত্যিই অপূর্ব লাগে। ছোলায় যেমন আছে খাদ্যশক্তি, তেমনি রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন বি। ছোলা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। তবে ওজন বেশি থাকলে ছোলা ভাজা বা ভুনা না খেয়ে সেদ্ধ ছোলা খাওয়া উচিত এবং পরিমাণেও কম হওয়া উচিত। ছোলা ছাড়া মটর দিয়ে চটপটি, ঘুঘনিও খাওয়া যেতে পারে। যারা বয়স্ক, চিবাতে অসুবিধা হয় তাদের জন্য ঘুঘনিই সবচেয়ে ভালো।
ছোলার পরেই আসে পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, হালিম, তেহারি, চিঁড়া, কলা, নারকেল, দুধ, সেমাই, নরম খিচুড়ি, কাবাব, দইবড়া, জিলাপি ইত্যাদি আরও অনেক ধরনের খাবার। যেহেতু এসব খাবার সবই ক্যালরিবহুল, এ কারণে খাবারের মধ্যে পরিমিতি বোধটা অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ, শুধু ইফতারির প্লেট হিসাব করলেই দেখা যাবে ১০০০-১৪০০ ক্যালরি পর্যন্ত ইফতারিতে খাওয়া হয়ে যায়।
ইফতারির উপাদানগুলোর মধ্যে ফল রাখাটা স্বাস্থ্যসম্মত। এতে ভিটামিন ও ধাতব লবণের অভাব পূরণ করা যায়। ফল দেহত্বক, চোখ, দাঁত, চুল, নখ যেমন ভালো রাখে তেমনি হূদরোগীদের জন্যও ভালো। দেশী-বিদেশী যে কোনো ফলই রাখা যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগ থাকলে রোগটিকে বিবেচনায় এনে তবে ফল খেতে হবে। অনেকে ইফতারে কাঁচা ছোলা পছন্দ করেন। এটা যেমন রক্তের চর্বি কমাতে সাহায্য করে, তেমনি পুষ্টিকরও বটে। কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদা কুচি, টমেটো কুচি, পেঁয়াজ, পুদিনা পাতা ও লবণ দিয়ে খেলে বেশ উপাদেয় হয়।
রাতের খাবার
অনেকে এত বেশি ইফতার করেন, ফলে রাতের খাবার খেতে চান না। এটা না করে কম করে সব বেলাতেই খাওয়া উচিত। রাতের খাবার হালকা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইফতারের খাবারে ডাল বেশি থাকে বলে এ সময় ডাল বাদ দেয়া ভালো। মাংসের চেয়ে হালকা মসলার রান্না মাছ, সবজি, শাক, ভর্তা এগুলো থাকতে পারে।
সেহরি বা ভোর রাতের খাবার
রমজানে এই খাবারটির গুরুত্ব অনেক। অনেকে মনে করেন, যেহেতু সারাদিন উপবাস থাকতে হবে, সেহেতু এ সময় বেশি বেশি খাওয়া উচিত। অন্যদিকে কেউ কেউ একেবারেই খেতে চান না। দুটোই ক্ষতিকর। অতি ভোজনে পেটে গ্যাস বা ডায়রিয়া হতে পারে, তেমনি আবার না খেয়ে রোজা রাখতে গেলে শরীর ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। এছাড়া শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়াম কমে ইলেকট্রেলাইটস ইমব্যালান্স হতে পারে। এদিকে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ সুদীর্ঘ উপবাস দেহের বিপাকক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেহের গ্লুকোজ ক্ষয় হয় বলে সহজেই ক্লান্তি আসে। এতে দিনের স্বাভাবিক কাজকর্মও করা যাবে না। সেহরির খাবার হবে অন্যান্য দিনে দুপুরে যে পরিমাণ খাবার খাওয়া হয় ততটুকু। এ সময় এক কাপ দুধ খেতে পারলে ভালো হয়। ইফতারিতে তেলের পরিমাণ বেশি থাকে বলে রাতের খাবার ও সেহরিতে কম তেলের রান্না করা খাবার খাওয়া উচিত। সবশেষে বলা যায়, রমজানে অত্যন্ত গুরুপাক ও দামি খাবার নয়, সহজলভ্য, সহজপাচ্য, পুষ্টিকর, রুচিকর ও জলীয় খাবার খেলে ৩০ দিনের রমজান সুন্দর এবং সুস্থভাবে কাটানো সম্ভব।
লেখক : প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম
রোজায় সুস্থতা অধ্যাপক ডা. তৌহিদুল আলম
সার্জারির ক্ষেত্রে
রোজার মাসে সাধারণত ইমার্জেন্সি সার্জারি ছাড়া অন্য অপারেশন করা হয় না। কারণ সার্জারি করতে হলে কম-বেশি রক্ত গড়িয়ে পড়ে ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু প্রসিডিউর বা প্রক্রিয়া যা মিনিম্যালি ইনভ্যাসিভ সার্জারি নামে পরিচিত তা ইফতােেরর পরে করিয়ে নেয়া যায়। অপারেশনের পর যে রোগীরা স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া ও হাঁটাচলা করতে পারছেন তারা সার্জনের পরামর্শে রোজা রাখতে পারবেন।
তবে একটি ব্যাপার লক্ষ রাখতে হবে রোজায় যেহেতু দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয় তাই পানিস্বল্পতা হতে পারে। এ থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি রোধে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত বেশি করে পানি, ফলের রস, ডাবের পানি, শাক-সবজি, সালাদ, ফল ও ইসবগুলের ভুসি খেতে হবে। সঙ্গে হালকা ব্যায়ামও করা যেতে পারে।
লেখক: সার্জারি বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হার্টেররোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার
এ রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন তবে ইফতার, রাতের খাবার ও সেহরিতে আমরা যে ধরনের খাবার খাই, তা থেকে একটু সতর্ক থাকতে হবে। উচ্চরক্তচাপ, হার্ট ফেইল ও রক্তনালিতে যাদের ব্লক আছে তারা নোনতা, চর্বিজাতীয় খাবার (গরু/খাসির মাংস) খাবেন না। তাদের খাওয়া হবে শাকসবজি, ভাত, মুরগির মাংস ইত্যাদি দিয়ে। রোজা রাখলে দেহে ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ে ফলে হার্ট সুস্থ থাকে। যে রোগীরা ওষুধ খাচ্ছেন তাদের ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের রিসিডিউল করিয়ে নিতে হবে অর্থাৎ লং অ্যাকটিং ওষুধ খেতে হবে।
আজকাল অনেক ওষুধ এমনভাবে তৈরি যাতে ইফতার থেকে সেহরির সময়কাল পর্যন্ত ডোজ অনুযায়ী খেলে সারা দিনে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে হার্টের যে রোগীদের তিন বেলা ওষুধ না খেলে শ্বাসকষ্ট হয়, অল্প পরিশ্রমেই বুক ব্যথা করে বা হাঁপিয়ে যায়, হাত-পায়ে পানি এসে গেছে তাদের রোজা না রাখাই ভালো। এমনকি দিনের বেলায় যাদের জিহ্বার নিচে ২-৩ বার স্প্রে নিতে হয় কিংবা মূত্রবর্ধক ওষুধ খেতে হয় তারাও রোজা রাখতে পারবেন না।
এ ধরনের রোগীরা বছরের অন্যান্য সময়ে যে নিয়মে ব্যায়াম করেন, এ সময়ও সেভাবে ব্যায়াম করতে পারবেন। আরেকটি ব্যাপার লক্ষ রাখতে হবে হার্টের রোগীরা যেন কখনোই ভরপেট না খান। কারণ ভরা পেটেই তাদের বুকে-পেটে ব্যথা বেশি হয়।
লেখক: হূদরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় হূদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল
রোজায় দাঁত ও মাড়ির যত্ন ডা. মো. রিয়াজুল আহসান
রোজার সময় দাঁত ও মাড়ির যত্নে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি সচেতন থাকতে হয়। কারণ রোজায় দীর্ঘ ১৪-১৫ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয়, এ সময় পানি বা কোনো তরল পান করা যায় না। ফলে মুখগহ্বর শুষ্ক থাকে এবং কুলি বা পানি পান না করার জন্য দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা খাদ্যাংশ ব্যাকটেরিয়া তৈরি এবং এই স্থানে জমে থাকতে সাহায্য করে। দাঁতের ফাঁকে এভাবে দীর্ঘক্ষণ ব্যাকটেরিয়া জমে থাকলে মাড়ির রোগ পেরিওডেন্টাল পকেট সৃষ্টি হয়। এর ফলে মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং খাদ্যের কণা মাড়ির ভেতর ঢুকে তীব্র দাঁতব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। এটি প্রতিরোধের জন্য রমজান মাসে যা করতে হবে, তা হলো-
• ইফতার ও সেহরি খাওয়ার পর দাঁত অবশ্যই পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করতে হবে। বিশেষ করে দুধ খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করতেই হয়।
• রোজাকালীন ওজু করার সময় পানি দিয়ে দাঁত ভালোভাবে কুলকুচি করতে হবে।