৭১’র নৃশংস গণহত্যার সাক্ষি বরগুনার ফারুকুল
সেইদিনের নারকীয় স্মৃতি মনে উঠলে আজও শিউরে উঠি, ঘুমাতে পারিনা.....
এম জসীম
মুক্তিযুদ্ধের সেই দৃশ্যপট যেন ফারুকুলের( ফারুক ভেন্ডার নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত) চোখের আয়নায় এখনও ভাসছে তাজা স্মৃতির মত। তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেননা সেই নৃশংস নারকীয়তা। দুইভাইকে চোখের সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার দৃশ্য মনে করতেই তার লোমকূপে শিহরণ জাগে। ভাই হারানোর শোক এখনও তাঁর পাঁজরে ছুঁয়ে দেয় অযুত বেদনা। সেসব দিনের কথা মনে করতেই কষ্টে, বেদনায়, শোকে আর্দ্র হয়ে ওঠে চোখ । বরগুনার শহীদ স্মৃতি সড়কের বাসিন্দা ফারুকুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন টসবগে তরুন। পাকিস্তানি হানাদান বাহিনী ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে তত্কালিন পটুয়াখালী জেলা দখল করে নেয়। বরগুনায় যাতে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী ওয়ারলেস যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্য ১৯৭১ সালের ২১ মে ফারুকুল ইসলাম ও তাঁর দুভাই নাসিরুদ্দিন মোশাররফ হোসেন সানুসহ পাঁচজন মিলে গিয়েছিলেন বরগুনা ওয়ারলেস অফিসের তারবার্তার সংযোগ বিছ্ছিন্ন করতে। সঙ্গে ছিলেন অহিদুল ইসলাম পান্না ও গিয়াস উদ্দীন নামে আরও দুজন । সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ফারুক ও তার দুই ভাই। ধরা পড়ার পর তাঁদের আটক রাখা হয় বরগুনা কারাগারে। ২৩ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বরগুনায় আসে এবং আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্য গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, বাড়ি-ঘরে ব্যাপক লুণ্ঠণ চালায়। বরগুনা শহরের নাথপট্টিসহ বিভিন্ন হিন্দু গ্রামে বহু নারী-পুরুষকে আটক করে জেলখানায় বন্দি করে। ২৮ ও ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় বসে প্রহসনের বিচারের মধ্যদিয়ে প্রায় ১৫০ জন নিরীহ লোককে মৃত্যুদন্ড দিয়ে তাঁদের জেলখানার পিছনে লাইনে দাঁড় করিয়ে নৃশসভাবে হত্যা করা হয়। সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হন ফারুকুলের দুইভাই। ফারুকুলকেও হত্যার উদ্দেশ্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দুদিন গুলি চালানো হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কীভাবে তিনি বেঁচে যান, কীভাবে চোখের সামনে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে দুভাইকে নৃশংসভাবে খুন করা হয় এবার সেসব শুনুন ফারুকুলের সঙ্গে কথা বলে সেকাহিনীর অনুলিখন পড়ুর এবার ।
অনেক লোক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। তারপর শুরু হয় মূর্হুমূর্হু গুলি। আমাকে ল্য করে ছোঁড়া হলো তিনটা গুলি। তার একটিও আমার শরীরে ভেদ করলোনা। বিষয়টা খুব অবিশ্বাস্য মনে হলো নিজের কাছেও! অথচ তখন মৃত্যুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি। আজরাঈলের সামনে থেকে কেউ জীবন ফিরে পায় ? আমার আশপাশে যাদের গুলি করা হলো তারা কেউই বাঁচেনি। চারপাশে শুধু রক্ত, লাশ, আর গোঙানীর শব্দ। আর থেমে থেমে গুলির ভয়ানক আওয়াজ। আমার শরীরটা তখন প্রায় অবস হয়ে আসছিল। পাশে ঘাড়টা ফিরিয়ে দেখি আমার ভাই নাসির উদ্দীন গোঙাচ্ছেন। তাঁর পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে কয়েকটা গুলি। পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে নাড়ি-ভ–ঁড়ি। তখন আমার চারপাশে কেবল রক্ত আর রক্ত। রক্তের দিঘিতে ভাসছি আমি। ভাই নাসির উদ্দীন তখনও মরেনি। বললেন, ফারুক তুই বাইচ্চা আছো ? আমি বললাম হ্যাঁ। তোর গায়ে গুলি লাগে নায় ? আমি বললাম, লাগছে। তুই ভাল কইর্যা দ্যাখ। তোর শরীরে তো রক্ত। মুর্হূমুর্হূ গুলি চালিয়ে ও গ্রেনেড চার্জ করে ততণে জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডের দিকে চলে গেছে পাকিস্তানি সেনারা। আমি তাদের চলে যেতে দেখে একটু উঠে বসি এবং ভাইয়ের পেটে ভুঁড়ি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ভাই আমাকে বলে, তোরে হয়তো আল্লায় মায়ের কোলে ফিরাইয়া নিতে পারে। আমারে একটু পানি দিবি ? আমি চারদিকে তাকাই। পানি কোথায় ? চারদিকে কেবল রক্ত। মরা লাশের স্তুপ। বারুদ আর রক্তের মিলিত গন্ধে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কোথাও একফোঁটা পানি দেখছিনা। আমি ভাইয়ের মুখে একফোঁটা পানি আর দিতে পারলামনা। আমার ভাই বলে, ঠিক আছে, লাগবেনা। আমি আর শ্বাস নিতে পারিনারে, ভাই। মায়রে দেইখ্যা রাখিস, আমি চললাম। আমার ভাই চিরজীবনের তরে আমাকে ছেড়ে গেল। আমার বুকটা তখন ধড়ফড় করছিল। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার শক্তি আমার ছিলনা। আশপাশে তাকিয়ে আরেক ভাই মোশাররফকে খুঁজলাম, কিন্তু দেখলামনা। মোশাররফ আমাদের লাইনের একটু ছিল , সে আগেই মারা গিয়েছিল।
কিছুণ পরই একদল রাজাকার সেখানে আসে। ওরা আমার পরিচিত। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। কারণ ওরা আমার ভাইকে মেরেছে, দেশের অগনিত নিরিহ মানুষকে মেরেছে, দেশের পবিত্র মাটিকে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ওদের একজন বললো, তুই এহনও বাইচ্চা আছো ? তোর গুলি লাগে নায় ? তারপর ওরা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে গিয়ে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা জানায়। কিছুণের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা সুর-সুর করে আমার কাছে ছুঁটে আসে এবং আমাকে ঘিরে ধরে। যেন ওরা অদ্ভূত চোখে চিড়িয়াখানার কোন জন্তুকে বিস্ময়ভরে দেখছে। যে লোকটির হাতে টমিগান ছিল সেই পাকিস্তানি সেনা ইকবাল আমাকে বলে ওঠ, শালা । আমি উঠতে পারিনা। জমাটবাঁধা রক্তে আটকে গেছে আমার শরীর।
ওরা আমাকে নিয়ে এল জেলখানার একটি পুরুষ ওয়ার্ডে। সেখানে এনে গোসল করাল। বিস্কুট খেতে দিল। রাতে পাকিস্তানিরা মদ খেল। মহিলা ওয়ার্ডে বন্দি যুবতিদের বেছে বেছে নিয়ে গেল ফূর্তি করার জন্য। তখন পাকিস্তানি সেনারা থাকতো জেলখানার পাশেই সিঅ্যান্ডবির ডাকবাংলোয়।
পরদিন ১৭ জন হিন্দু তরুনকে গণকবরে গুলি করে মারলো ওরা। এবার আমাকে ক্যাপ্টেনের সামনে আনা হলো। আমি ক্যাপ্টেনকে বললাম, স্যার, আমার দুইভাইকে কাল মেরে ফেলা হয়েছে। আমাকে মায়ের কাছে যেতে দেন। আমাকে মাইরেননা। ক্যাপ্টেন কিছু বলার আগেই ইকবাল বলে, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাকে মেরে ফেলুন। বিহারি ওসি আনোয়ার বলে, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে পরে ও আমাকে মেরে ফেলবে। এসব কথা শুনে ক্যাপ্টেন আমাকে আবার টমিগানের সামনে দাঁড় করালেন। ল্যভেদ করার জন্য আমাকে বসানো হলো দেয়ালের সামনে। এরপর গুলি। প্রথম গুলিটি চলে গেল কানের বাঁ পাশ দিয়ে। ক্যাপ্টেন আবার্ চি্তকার করে বললেন, এগেইন শ্যুট ! এবার গুলিটা বেরিয়ে গেল ঠিক মাথার ডানপাশ ঘেঁষে।সবাই তাজ্জব হয়ে হয়ে আমাকে দেখতে লাগলো। ক্যাপ্টেন বললেন, তোমহারা পাস তবজ হ্যায় ? তারপর তন্নতন্ন আমার শরীর খোঁজা হলো। না কোন কবজ বা তাবিজ পাওয়া গেলনা।
ক্যাপ্টেন কিছুণ নিরব থাকার পর কি ভেবে আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলেন। তারপর ২৮ দিন আমি সেই ওয়ার্ডেই বন্দি ছিলাম। পরে আমার মা তত্কালিন বরগুনার মহকুমা প্রশাসকের কাছে গিয়ে হাত-পা ধরে বেশ কাকুতি-মিনতি করেণ। এরপর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২৮ ও ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় বন্দি অসংখ্য নিরিহ লোককে জেলখানার পিছনে গণকবরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। তবে ঠিক কত লোককে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার যথার্থ কোন পরিসংখ্যান আজও উদ্ধার করা যায়নি। তবে সেখানে ৭৬ জনের নাম ও পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এসব মানুষের জীবন্ উসর্গের মধ্যদিয়ে বরগুনা জেলা ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানিদের কবল মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জণ করে। কিন্তু সেদিনের স্বজন হারানো অগনিত ফারুকুলদের শোক আর বেদনা আজও মুছে যায়নি। গণকবরের সেই শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে এখন সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ স্মৃতি সৌধ। এই স্মৃতির মিনারে প্রতিবছর শহীদ স্বজনেরা ফুল নিয়ে হাজির হন, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে প্রিয় মানুষটিকে স্মরণ করেণ। তবে দু:খের কথা হলো এসব শহীদ পরিবারের অনেক সদস্যই নানা অবহেলা আর সীমাহিন বঞ্চনার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন । যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম তাঁদের জীবন-জীবিকার সংস্থান হয়নি আজও। এই লজ্জা আমরা ঢাকবো কি দিয়ে!
আলোচিত ব্লগ
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা
সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১
নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন
হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়
সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।
হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই
সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন