মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে সুদ বুঝানোর জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার নাম হলো রিবা। রিবা শব্দটির অর্থ হলো অতিরিক্ত, বেশি, বৃদ্ধি, বিকাশ। অর্থাৎ রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যা ঋণদাতা পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়ে তারই বিনিময় হিসাবে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে আদায় করে থাকে। রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যা কোন মালের বিনিময় নয়। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই সুদী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। সুদ সম্পর্কে তারা যথেষ্ট জ্ঞাত নয়। তাদের কাছে সুদ একটি সাধারণ বিষয়। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকিং ধারায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনদেন করার ফলে তারা যে সুদের সাথে প্রত্য ও পরো ভাবে জড়িত হচ্ছে এ সম্পর্কে তারা সচেতনতা বোধ করেনা। কিভাবে সম্পদকে বৃদ্ধি করা যায় এটাই তাদের প্রধান নেশা, এর বিনিময়ে যে কি ভয়াবহতা তাদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয় তা তারা আচঁ করতে পারেনা। অনেক েেত্রই লোক মুখে শোনা যায় যে, ইসলামী ব্যাংক গুলো সুদ খায় তবে ঘুরিয়ে খায়, সোজাসুজি খায় না। আবার এ কথাও শোনা যায় যে, ইসলামী ব্যাংক গুলো সুদ খায় তবে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় কম খায়। এ কথাগুলোর আসলেই কোন ভিত্তি নেই। আমার মতে তাদের এ ধারণা নিছক অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা তারা না বুঝেই এ ধরণের কথাবার্তা বলে থাকেন। বাহ্যিক দিক থেকে উভয় ব্যাংকের কার্যাবলী একই মনে হলেও মূলত এক নয়। এই বিষয়টা বুঝতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি ধারণা পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন কোন গরু জবেহের সময় ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ নিয়ে জবেহ করা আর ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ না নিয়ে জবেহ করা এক বিষয় নয়। যদিও বাহ্যিক দিক থেকে উভয়ই গরু জবেহের ধরণ,জবেহের উপকরণ তথা ছুরি, রশি ইত্যাদি একই ধরণের হলেও তবুও উভয় গরুর মধ্যে ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ নিয়ে জবেহ করার কারনে একটি হালাল আর ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ না নিয়ে জবেহ করার কারণে অন্যটি হারামে পরিণত হয়।
এমনিভাবে বাহ্যিক দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা একই মনে হলেও সূক্ষ্ম পার্থক্যের কারণে উভয়ের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। যেখানে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ডিপোজিট সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট শতকরা হারে, সেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে চুক্তি করে যে, ব্যাংক তাদের অর্থ ব্যবসায় খাটিয়ে যে লাভ বা মুনাফা হবে তা থেকে তাদেরকে পূর্ব চুক্তি মোতাবেক একটি শতকরা হারে এই মুনাফা প্রদান করবে। আর লোকসান হলে পূর্বচুক্তি মোতাবেকই গ্রাহকগণ তা বহন করবে। ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ এখানে চুক্তির শর্তের কারণেই ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। আর এ চুক্তির শর্তগুলো যারা বুঝতে চায় না বা বুঝে না তারাই উপরোক্ত ঐ ধরণের নানা কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে। সুদ এমন একটি ফাঁদ যে ফাঁদে আটকে কেবল মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমেই ধ্বংস হয়ে যায় না। বরং অনন্ত কালের জন্য চরম দশায় নিপতিত হয়ে ধুকে ধুকে জ্বলতে থাকবে অথচ সে যন্ত্রণা কিছুমাত্র শেষ হবে না। সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জীবনের তিনটি পর্যায়ে সুদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে। সুদ মানুয়ের তিনটি বিষয়ের উপর আঘাত হানে।
প্রথমত মানুষের ইমানদারীতায়, দ্বিতীয়ত পরকালীন মুক্তির বিষয়ে, তৃতীয়ত মানুষের ইহকালীন অর্থনৈতিক মুক্তির উপর। অর্থাৎ সুদের কারণে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অন্যতম মৌলিক পরিচয় ইমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। পরকালীন জীবনে আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত জান্নাত লাভের পরিবর্তে জাহান্নামে নিপতিত হওয়াকে নিশ্চিত করে। এবং যে দুনিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা সুখ-শান্তি হতে বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ তার সব কূলই বৃথা। আমরা যদি সুদ মুক্ত হয়ে থাকতে পারি তবেই আমাদের জীবন হবে স্বার্থক । এছাড়া আমাদেরকে কঠোর আযাবের সম্মুখীন হতে হবে। সুদ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত -
“যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা জ্ঞানশূণ্য করে দিয়েছে। এই জন্য যে তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে রবের এ নিদের্শ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা আবার আরাম্ভ করবে তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।” (সুরা বাকারা ঃ ২৭৫)
মানুষের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো তা আল্লাহর দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দিয়ে থাকো তাই বৃদ্ধি পায়; তারাই সমৃদ্ধিশালী। (সূরা ঃ রুম ৩৯)
হে ইমানদারগণ তোমরা এই চক্রবৃদ্ধি সুদ খেয়ো না এবং আল্লাকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (আল ইমরান ১৩০)
আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ণ করবেন এবং দান কে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সূরা বাকারা ২৭৬)। যদি তোমরা সুদের ব্যবসা না ছাড়ো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধেও জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না। (সূরা বাকরা ২৭৯)
উপোরক্ত আয়াতগুলো হতে আমরা বুঝতে পারি, যারা পরকালকে অস্বীকার করে বা মিথ্যা মনে করে কেবলমাত্র তারাই সুদী ব্যবসায়ে অর্ন্তভূক্ত হয়ে আল্লাহর বিধান লঙ্গন করতে পারে। যেখানে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুদ সম্পর্কে এত আয়াত নাযিল করেছেন। যেন আমরা কোনভাবেই সুদী ব্যবসায়ে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে না পারি। যদি মান্য না করি তাহলে তো আল্লাহর অস্তিত্বকেই অবিশ্বাস করা হল। আর যারা এরপরেও সুদীকারবারীরা তারা নিশ্চিত জাহান্নামী হবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে এমন কোন সুযোগ রাখেননি যে,সুদ খেলে তাকে কিছুটা রেহাই দেয়া যাবে। বরং তার জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিতরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহান্নাম একটা অদৃশ্য বিষয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে জাহান্নামের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।
তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছে তাদের অচিরেই আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দেব, অতপর (পুড়ে যখন) তাদের দেহের চামড়া গলে যাবে তখন আমি তার বদলে নতুন চামড়া বানিয়ে দেবো যাতে করে তারা আযাব ভোগ করতে পারে। (সূরা নিসা ৫৬)
রাসূল (সা) সুদখোরদের বিষয়ে বলেছেন- সামুর ইবনে জুনদুব (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন নবী (সা) বলেছেন আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম। তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্ত নদীর তীরে পৌছে গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আর নদীর তীরে একটি লোক দাঁড়িয়ে ছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর এরপর নদীর মাঝে দাঁড়নো ব্যক্তি। তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুুখমন্ডল ল্য করে পাথর নিপে করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানেই উঠে আসার চেষ্টা করছে তখন তীরের লোকটি তার মুখ ল্য করে পাথর ছুড়ে মারছে। যার ফলে সে (পূর্বাবস্থায়) ফিরে যাচ্ছে। নবী (সা) বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম এ লোকটি কে? কী কারণে তার এ শাস্তি হচেছ। তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বললো, নদীর মধ্যে দাঁড়নো যে লোকটি দেখলেন, সে একজন সুদখোর।
প্রকৃত পে আমরা যে সম্পদ গড়ে যাচ্ছি এর কোন কিছুই আমাদের সাথে যাবে না।
রাসূল (সা) বলেছেন তিনটি সম্পদ তোমাদের নিজেদের।
এক. যা তোমরা খেয়েছ। দুই. যা তোমরা পরিধান করেছ। তিন. যা তোমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করেছ।
তবে আমরা কেন সুদের মাধ্যমে এত এত সম্পদ বাড়িয়ে চলেছি?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৬