somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরবানীঃ জীবন্ত রক্তপাতের উৎসব

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখকঃ নায়ার খান || বাংলা অনুবাদঃ আলমগীর হুসেন

প্রতি বছর ঈদুল-আযহার বা বড় ঈদ উৎসবের সময় আমার মনে হয় আমি যেন একটা প্রাচীন সমাজে বাস করছি, যখন জীবন্ত মানব বলি দিয়ে তার রক্ত উৎসর্গ করা হতো ঈশ্বরকে খুশী করার জন্য। প্রত্যেক ঈদের দিন দেশের সর্বত্র রাস্তার কোণে কোণে প্রকাশ্যে জীবন্ত প্রাণী হত্যা দেখার জন্য আনন্দ-উল্লাসে সমেবেত ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে আমি দেখি একটা একটা সম্ভাব্য তালেবানের প্রতিচ্ছবি। সেসব প্রাণীগুলো বাঁচার জন্য কি আপ্রাণ চেষ্টা করে! এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ছেদনকৃত গলা দিয়ে ফিনকি রক্ত বেরিয়ে আসে। যেন তালেবানদের জীবন্ত মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ করার মতো। আর সে দৃশ্য ওসব বাচ্চা মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য সবচেয়ে আনন্দ-উৎসবের বস্তু বা অংশ। আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, ওসব ছেলেদের অনেকে একদিন অন্য মানুষের উপর অনুরূপ কার্য ঘটাতে দ্বিধা করে না

ব্যক্তিগতভাবে আমি শাকাহারী নই। তবে মাংসের চাহিদার জন্য জনচক্ষুর আড়ালে কষাইখানায় প্রাণী জবাই করা এক জিনিস, আর সেটাকে গণ-তামাশা বানানো অন্য জিনিস। একটা উটের জীবন কবজ করতে প্রায় আধা-ঘণ্টা দস্তাদস্তি করতে হয়, যে প্রক্রিয়া কালে উটের লম্বা গলায় বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটা হয়। এবং শত শত মানুষ, যাদের বেশীরভাগ বাচ্চা ছেলেমেয়ে, সে দৃষ্ট দেখতে থাকে। অথচ সভ্য সমাজে প্রাণীকে কেবল জনচক্ষুর অন্তরালেই নয়, তাদেরকে সর্বাধিক ব্যথাহীন প্রক্রিয়ায় জবাই করাও নিশ্চিত করা হয়, যা ইসলামে হারাম গণ্য।

জনগণ আমার মন্তব্যকে ধর্ম-বিরোধী বলবে নিঃসন্দেহে। তবে আমার বক্তব্যঃ আজকের বিবেক-সম্পন্ন মানুষের অন্তত উচিত ধর্মীয় আচারকে বর্তমান সভ্য ধারণার সাথে তাল রেখে চালানো। গত কয়েক শত বছরে মানুষ শহুরে হয়ে উঠার সাথে সম্পদ ও কুরবানীর অর্থ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কৃষি-প্রধান সমাজে পশু-প্রাণী হলো সম্পদ; সুতরাং সে সম্পদের তথা পশু-প্রাণীর উৎসর্গ বা কুরবানী। কিন্তু শহুরে সমাজে সম্পদ হচ্ছে টাকা-পয়সা। কাজেই কেউ পশু কুরবানী না দিয়ে আল্লাহর নামে সমপরিমাণ টাকা গরীবদেরকে খাওয়ানোর জন্য কিংবা হাসপাতালে দান করার জন্য দিলে একই পরিমাণ বা তারও বেশী উপকার আনবে, এবং তা প্রকাশ্যে পশু হত্যার মত কুৎসিত ও নির্মম দৃশ্য ও পরিবেশ নোংরা করা থেকে আমাদেরকে বাঁচাবে। আমাদের সমাজে যখন সুষ্ঠ ও বিবেকবান চিন্তাভাবনার চেয়ে আচার-প্রথা ধর্মের মূল, তখন কে শুনবে এমন পরামর্শ? বিশেষত ঈদে রাস্তায় রাস্তায় মহড়া করে কুরবানী দেওয়া যখন নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করেঃ

• একটা মোটাকাটা দামী প্রাণীকে জনসমক্ষে কুরবানী দেওয়া কোরবানী-দাতার প্রতিপত্তি প্রদর্শন করে;

• যৌন ও সামাজিকভাবে নিষ্পেষিত মানুষের অন্যকে যাতনা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করে;

• অন্য ধর্মের লোকদের উপর নিজেদের প্রাধান্য প্রদর্শন, বিশেষত মুসলিম সংখ্যালঘু সমাজে – যেমন ভারতে।

ঈদ একদিকে উচ্চ-বিত্তদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও অহংকার প্রদর্শনের এক উৎসব; অন্যদিকে মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যকে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের আরও বাইরে নিয়ে যাওয়ার এক আয়োজন। প্রত্যেক ঈদ ও তার পরবর্তি সময়ে গরু ও ছাগল-ভেড়ার মাংসের দাম উর্ধ্বমুখী হয়, কেননা ঈদের সময়ে ব্যাপক সংখ্যায় এসব প্রাণী হত্যা তাদের ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি করে।

অনেকে আমার সাথে দ্বিমত করবে যেঃ পশু-প্রাণী জবাই নয় – বরং পাশ্চাত্য থেকে আগত সহিংসতাপূর্ণ চলচ্চিত্র ও ভিডিও খেলা ইত্যাদি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাঝে সহিংসতা ও হত্যার ঝোক সৃষ্টি করার বেশী ক্ষমতা রাখে। সে দাবী যুক্তিযুক্ত। তবে সহিংসতাপূর্ণ ছবিগুলো প্রথমেই হুশিয়ারী দেয় যে, বাচ্চারা সেটা দেখার উপযুক্ত নয়। দ্বিতীয়তঃ ছবিতে গোলাগুলি, খুনাখুনী আর জীবন্ত প্রাণীর রক্তপাতে মাঝে ব্যবধান রয়েছে।

খুনাখুনী সবক্ষেত্রেই খারাপ, কিন্তু সাংঘাতিকতা প্রদর্শনে পরিমিতি বা ব্যবধান থাকা উচিত। বিশ্বব্যাপী শহরগুলোতে প্রতিদিন শত শত মানুষ খুন হয়। কিন্তু বছরখানেক আগে শিয়ালকোটে দুই ভাইয়ের জনসমক্ষে হত্যায় পাকিস্তানের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজ এতটা আশ্চর্য ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল কেন?

পাকিস্তানে অর্ধেকের বেশী খুন করা হয় ভোতা অস্ত্র, যেমন কুঠার দিয়ে “ইজ্জত বাঁচাতে হত্যা” (honor killing) – যা ভোক্তভুগীকে সর্বাধিক যন্ত্রণা দেয় মৃত্যুকালে। এরূপে হত্যাকৃত ভোক্তভুগীরা একই ধরণের ব্যাথা ও যন্ত্রণা অনুভব করে, যেরূপ করেছিল শিয়ালকোটে হত্যাকৃত ভ্রাতৃদ্বয়। তবে দেশবাসী এতটা বিক্ষুব্ধ কেন হয়েছিল সে ভাই দু’জনের হত্যায়। তার কারণ ছিলঃ বর্বর-নির্দয় হত্যার সে দৃশ্যটি উপস্থিত সাধারণ লোকজন উৎসুক্যের সাথে দেখছিল, যেন একটা মজাদায়ক খেলার মত।

অনুরূপভাবে কোন মানব ব্যক্তিকে গুলি করে মারা খারাপ। কিন্তু একজন অসহায় সাধারণ মানুষকে, যেমন হাত-পা বাঁধা ড্যানিয়েল পার্লকে, “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি তুলে ধীরে ধীরে গলা কেটে হত্যা করা এবং সে দৃশ্যের ভিডিও বানিয়ে ইন্টারনেটে সম্প্রচার করা সভ্য মানুষের কাছে অগ্রহণীয়। অনুরূপভাবে মহড়া করে মানুষ হত্যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানদের জন্য একটা সচরাচর চর্চা। এরূপ প্রত্যেকটি প্রদর্শণীর পর বলিদানকৃত ব্যক্তির ছিন্নমস্তককে চুল ধরে তোলা হয় ক্যামেরার সামনে, যা সমেবেত এক উৎফুল্ল জনতা দেখে আনন্দিত হয়।

সৌদি আরবে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর মোমিনরা দৌঁড়ে ছুটে মসজিদের নিকটবর্তি উন্মুক্ত মাঠে সেখানে সমেবেত জনতার সবচেয়ে সামনে জায়গা নেওয়ার জন্য – যারা সেখানে জাহির হয় দাগী আসামীদেরকে জনসমক্ষে মস্তক ছিন্ন করে হত্যা করার দৃশ্য দেখার জন্য।
এরূপে মানুষ হত্যা ও ঈদুল-আযহায় প্রকাশ্যে মহড়া করে পশু কুরবানী দেওয়ার মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ই একই ধরনের মনোবৃত্তির কার্যকর প্রতিফলন মাত্র।
----
পাকিস্তানী লেখক নায়ার খান ইতহাস, ধর্ম ও পারস্পারিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের উপর গবেষণায় উৎসাহী। লেখাটি ইংরেজীতে http://www.viewpointonline.net-এ প্রকাশিত হবে। লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে ইমেইলঃ [email protected].
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১১ ভোর ৬:০২
৪০টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×