তথ্যসুত্র
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে ইরানের প্রেসিডেন্ট ডঃ আহমাদিনেজাদের ভাষণ
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, মুষ্টিমেয় কিছু দেশ কর্তৃক গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণের দিন শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেছেন, গোটা বিশ্ববাসীর সুখ ও সমৃদ্ধির স্বার্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।
বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার সময় জনাব আহমাদিনেজাদ আরো বলেছেন, একটি ছোট্ট গোষ্ঠি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করবে- এটা মেনে নেয়া যায় না। ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যেসব দেশ নিজেরাই সবার আগে মৌলিক নীতিমালা লংঘন করছে সেসব দেশ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেবে- তা হতে পারে না। গণতন্ত্রের নাম নিয়ে তাদেরকে আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করতে দেয়া যায় না। দ্বিমুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে জাতিগুলোকে চরম অপমান অপদস্থ করার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে জনাব আহমাদিনেজাদ উল্লেখ করেন। নিউইয়র্ক সময় সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হওয়া ভাষণে জনাব আহমাদিনেজাদ ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়ার জন্য ইসরাইলকে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, ইসরাইল আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের মধ্যেমে ফিলিস্তিনে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বিদেশী সেনারা ঐ দুটি দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে সন্ত্রাস ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ কখনো বন্ধ হয় নি বলে জনাব আহমাদিনেজাদ উল্লেখ করেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ১৯২টি দেশকে নিয়ে গঠিত জাতিসংঘকে আরো কার্যকর ও গণতান্ত্রিক করার স্বার্থে সংস্থাটিতে আমূল পরিবর্তন আনার আহবান জানান। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যের ভেটো ক্ষমতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, একটি সুস্পষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠি অমানবিকভাবে গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং নব্য দাসপ্রথা চালু করবে- তা মেনে নেয়া যায় না। এটি কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, ঐ মুষ্টিমেয় শক্তিগুলো নিজেদের বর্ণবাদী স্বার্থ হাসিলের জন্য সকল জাতির এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকার জাতিগুলোর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। জনাব আহমাদিনেজাদ বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা জাতিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। লিবারেলিযম বা কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, লিবারেলিযম ও পূঁজিবাদ মানবজাতিকে সুখ ও সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে নি। কাজেই সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চাকা বন্ধ হয়ে যাবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সকল দেশকে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়ে বলেছেন, কেবলমাত্র আল্লাহ প্রেরিত পুরুষ বা নবী রাসূলদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণের মাধ্যমে মানব জাতি মুক্তি পেতে পারে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, বৈষম্য, দারিদ্র ও অজ্ঞতা নির্মূল করে সকল মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নবী রাসূলগণ ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
জাতিসংঘে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের ভাষণের সময় ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াক আউট
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ভাষণের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেছেন।
বুধবার জনাব আহমাদিনেজাদ তার ভাষণে ইসরাইলকে গণহত্যার জন্য দায়ী করার সাথে সাথে সর্বপ্রথম ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা উঠে চলে যায়। ইরানের প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে বলেছেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। তিনি আরো বলেছেন, ইহুদীবাদী ইসরাইল গত ৬০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বলপ্রয়োগ এবং দমননীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনী জনগণকে তাদের মাতৃভূমিতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এছাড়া যেসব ফিলিস্তিনী তাদের আবাসভূমিতে রয়েছে, ইসরাইলী সেনারা তাদের ওপর সব ধরনের অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাচ্ছে, এমনকি নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করতেও তারা দ্বিধা করছে না। জনাব আহমাদিনেজাদ যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন ফ্রান্সের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, কোস্টারিকা, ডেনমার্ক, জার্মানী, হাঙ্গেরি, ইতালি এবং নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধিরা সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। এছাড়া ইহুদীবাদী ইসরাইলের প্রতিনিধিরা শুরু থেকেই জনাব আহমাদিনেজাদের ভাষণ বয়কট করেছিলো। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইসরাইলের গণহত্যার নিন্দা জানালেও পশ্চিমা দেশগুলো এই ভাষণকে 'ইহুদী বিরোধী' বক্তব্য বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন মিশনের মুখপাত্র বলেছেন, জনাব আহমাদিনেজাদ পুনরায় 'ইহুদী বিরোধী' ঘৃণ্য ও আক্রমনাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন- যা আমাদের হতাশ করেছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট একাধিকবার ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে জোর করে চেপে বসা ইসরাইলের প্রতি সমর্থনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কথিত ইহুদী নিধনযজ্ঞ বা হোলোকাস্টের কল্পকাহিনীর ব্যাপারে গবেষণা নিষিদ্ধ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে আইন রয়েছে জনাব আহমাদিনেজাদ তারও কড়া সমালোচনা করেছেন।
হলোকাস্ট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যান্য গণহত্যার কথাও তুলে ধরুন : মার্কিন মিডিয়ার প্রতি আহমাদিনেজাদ
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদ আহমাদিনেজাদ মার্কিন সংবাদ মাধ্যমকে হলোকাস্ট বা জার্মান সেনাবাহিনীর দ্বারা কথিত ইহুদিদের গণ-হত্যার ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনার এবং বিশ্বের অন্যান্য গণহত্যার কথা তুলে ধরার জন্য আহবান জানিয়েছেন। তিনি মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আরো বলেছেন, ইতিহাসে হলোকাস্টের মতো আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে সে ক্ষেত্রে আপনাদের নজরে কেন ওই একটি মাত্র ঘটনাই এতো জরুরী হয়ে উঠবে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ৬ কোটি মানুষ নিহত হয়েছিলো কাজেই শুধু একটি গোষ্ঠীর প্রতি কেন আপনাদের নজর আটকে থাকবে? জনাব আহমাদিনেজাদ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নিহত ৬ কোটি মানুষের সবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তারা সবাই মানুষ। তারা খ্রিস্টান, ইহুদি না বৌদ্ধ সেটা কোনো বিষয় নয়। তাদেকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সবার জন্য আমরা দুঃখিত। মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ প্রশ্ন ছুড়ে দেন, মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টিতে হলোকাস্ট বিছিন্ন কোনো ঘটনা নাকি বিশ্বের ঘটনাবলীতে এখনো এই ঘটনার কোনো প্রভাব রয়েছে? একাডেমিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে ইরানের বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নও রয়েছে। তিনি বলেন, এ সব প্রশ্নের যথার্থ জবাব দিতে হবে। তবে প্রথমেই বুঝতে হবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এতো সব ঘটনাবলীর মধ্যে কেন অন্যান্য ঘটনার তুলনায় হলোকাস্টের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আজ আমাদের নিজেদেরকে যে প্রশ্ন করতে হবে তা হলো সত্যিই হলোকাস্টের ঘটনা কি ঘটেছিলো? যদি ঘটেই থাকে তবে তা কোথায় ঘটেছে? কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলো? হলোকাস্টের ঘটনার সাথে ফিলিস্তিনের জনগণের কি ভূমিকা ছিলো? তারা কি অপরাধ করেছে যে তাদেকে এই ঘটনার দায়ভার বহন করতে এবং ফল ভোগ করতে হবে? জনাব আহমাদিনেজাদ বলেন, ইসরাইলের দখলদারিত্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই ৫০ লক্ষ ফিলিস্তিনি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন,অন্য মানুষদের ভূমি দখল করার জন্য কেন হলোকাস্টের নাম ভাঙ্গানো হবে? কেন ফিলিস্তিনিদেরকে এ জন্য জীবন দিতে হবে? কে এখন দখলদারিত্বের ভূমিকায় ? তিনি বলেন, জাতিসংঘের ইশতেহারে কোন দখলদার শক্তির নিন্দা করা হয়েছে? জনাব আহমাদিনেজাদ প্রশ্ন তুলেন, ইউরোপে যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য বিশ্বের অন্য স্থানের কারো ভূমি দখল করা হবে সে কথা কোনো ন্যায়কামী মানুষ কি মেনে নেবে? দুভার্গ্যজনক ব্যাপার হলো পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদরা এ সব প্রশ্নের জবাব দিতে চান না। বরং তারা তখন অন্য প্রসঙ্গে সরে যান। জনাব আহমাদিনেজাদ বলেন, হলোকাস্টকে ফিলিস্তিন জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তথ্যসুত্র