ব্রাম স্টোকার একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন যে অক্টোপাসের মতো দেখতে একটি প্রাণী তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তার ঘাড়ে শ্বদন্ত বসিয়ে রক্ত চুষে খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠে বসেই তিনি লেখা শুরু করে দেন, কারণ স্বপ্নের স্মৃতি মানুষ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে থাকে। এই স্বপ্নের সারাংশ থেকেই স্টোকার ড্রাকুলা গল্পটির প্লট দাড় করিয়েছিলেন এবং টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম করে, বিভিন্ন বই পত্র, মিউজিয়ামের নথি ঘেঁটে এবং স্থানীয় রূপকথা ইত্যাদি একসঙ্গে করে বিখ্যাত "ড্রাকুলা" বইটি লিখেছিলেন। দুঃস্বপ্ন থেকে গল্প লেখার এই ধারণাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি নিজের কিছু দুঃস্বপ্নকে পরিমার্জিত করে কয়েকটি গল্প লিখেছি। ভাবছি, ধারাবাহিক ভাবে, বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন নিয়ে লিখব। তবে বলে রাখি, এই লেখাগুলো আমি ঘুম থেকে উঠে লিখিনি, ঘুম থেকে উঠে এক-দুই লাইনে টুকে রেখেছি, পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিনতে লিখেছি।
আয়না-ভীতি
"সুমন, আমার চোখের দিকে তাকাও।"
"বলো যুথী।"
"না, তুমি তাকাচ্ছ না। তাকাও আগে।"
"আচ্ছা, তাকালাম। বলো।"
"এ কি, তুমি কাঁপছ কেন?"
"কাঁপছি না।"
"কাঁপছ!"
" না তো!"
"তোমার কি হয়েছে বলো তো। ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দেখি তুমি গুটিসুটি মেরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এক কোণে বসে আছো, মাঝে মাঝে প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াও। কেন?"
"জানি না।"
"তুমি আমাদের শহরের বাসাটা ছেড়ে এই নির্জন এলাকায় বাসা নিয়েছ, গত কয়েক মাসে আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় যাওনি, অফিসেও যাওনি। কেন? "
"এমনি, শরীরটটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"
"তুমি ঘরকুনো হয়ে পড়লে কেন এভাবে? আগে তো ঘুরতে অনেক পছন্দ করতে। অথচ গত সপ্তাহে নিজের আপন মামাতো বোনের বিয়েতেও যাওনি। কি হয়েছে তোমার বলো তো সত্যি করে?"
"কিছু না যুথী! বললামই তো, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"
"না, আরও কিছু ব্যাপার আছে। তুমি লুকোচ্ছ!"
"কিচ্ছু লুকোচ্ছি না।"
"তাই? তাহলে বলো যে বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলেছ কেন? আজকাল দাড়ি কামাতেও আয়না ব্যবহার করো না। কেন? কেন তোমার আমার সেলফোন দু'টো বিক্রি করে বাসায় ল্যান্ড লাইন এনেছ?"
"এমনি।"
"এমনি? এটা কোন উত্তর হলো?"
"হুম।"
"তোমার মানসিক সমস্যা হয়েছে সুমন, তোমাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব কাল।"
"না!!"
"না, নিয়ে যাবই।"
"প্লিজ না!"
"ঠিকাছে, নেব না। এক শর্তে,তুমি আয়নায় মুখ দেখবে আমার সামনে বসে। আমার ধারণা কোন রহস্যময় কারণে তুমি আয়না দেখতে ভয় পাচ্ছ।"
"আয়না? আয়না কই পেলে তুমি? সব আয়না তো আমি ফেলে দিয়েছি।"
"আমার পার্সে একটা ছোট আয়না ছিল।"
"সর্বনাশ, কোথায় সেটা? এক্ষুণি ফেলে দাও!"
"কেন ফেলে দেব? দেব না। তুমি আমার সামনে আয়নায় নিজের মুখ নিজে দেখবে।"
"ঠিকাছে, কিন্তু তারপরই তুমি ফেলে দেবে আয়নাটা।"
"আচ্ছা।"
সুমন নিজের চেহারা দেখল আয়নায়, ছোট্ট গোল আয়নায় তার লম্বাটে মুখটা অদ্ভুত দেখাল।
"হয়েছে, এবার ফেলে দাও যুথী।"
"না। ফেলব না। কেন ফেলব? আমি জানতে চাই, আয়না রহস্যটা কি!"
"দোহাই লাগে, ফেলে দাও ওটা।"
"না। ফেলব না। আমি জানতে...."
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল যুথী। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে পেয়েছে সে। কি ভয়ংকর! তার চোখের মনির অংশটা পুরোপুরি সাদা, কোন কালো অংশ নেই। সাদা চোখের কিনারায় রক্ত জমেছে। চেহারাও কাগজের মতো সাদা,যেন রক্তশূন্য। কালো কুচকুচে ঠোটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দু'টো শ্বদন্ত; ঠিক যেন হিংস্র কুকুরের দাঁত। কি ভয়ংকর!
"এসব কি সুমন? আমার চেহারা..."
"ইটস ওকে যুথী। আই লাভ ইউ! তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা..."
"কিন্তু আমার হয়েছে কি সুমন?"
"জানি না! দু'মাস ধরে তোমার শরীরের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানি না। যেদিন তোমার দাঁত গজাল, তুমি রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। যখন ফিরলে, তখন তোমার দাঁত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেই থেকে প্রতিরাতে তুমি একই কাজ করো। কিন্তু সকালে উঠে ঠিকঠাক আচরণ করো আবার।"
"সেজন্যই তুমি বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে রেখেছ? সেজন্যই এই দুর্গম এলাকায় বাসা নিয়েছ? আত্মীয় স্বজনকে এড়িয়ে চলছ এজন্যই?"
"হ্যা যুথী। কিন্তু তুমি মন খারাপ করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"কেমন করে ঠিক হবে? আমি কি পিশাচে পরিণত হয়েছি সুমন?"
"যুথী,রাত হয়েছে। কাল এসব আলোচনা হবে।"
"তুমি কি ভয় পাচ্ছ সুমন? রাত হলে কি আমি আমি প্রেতাত্মা হয়ে যাব?"
"প্লীজ,এখন ঘুমোতে চলো।"
"না।"
যুথী উঠে দাড়াল। আজ তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। রক্ত তৃষ্ণা, অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:০৪