লিংক রাজধানীতে অনুরূপ ডাক্তার দেড় হাজার : বিএমডিসি
।। আবুল খায়ের ।।
ভারত থেকে এমবিবিএস ও মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী এমডি-এর সার্টিফিকেট মাত্র ১২ হাজার টাকায় ক্রয় করে এনে কথিত ডাঃ গোলাম কিবরিয়া ৫ বছর যাবৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে প্র্যাকটিস চালিয়ে আসছিলেন। ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্টের ম্যাজিষ্ট্রেট আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে র্যাব-৪ এর সদস্যরা মিরপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন পিসিল্যাব নামের একটি বিলাস বহুল প্রাইভেট চেম্বারে রবিবার সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গোলাম কিবরিয়াকে গ্রেফতার করেন। এদিকে র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা রাজধানীর অলিগলি ও অভিজাত এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে গোলাম কিবরিয়ার মত আরো দেড়শতাধিক ভুয়া ডাক্তারের সন্ধান পান। তারা বছরের পর বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসছে। তাদের ভুয়া চিকিৎসা নিয়ে কত রোগী প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে তারা হয়েছে কোটিপতি এবং ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীর মত অভিজাত এলাকায় বিলাস বহুল জীবন যাপন করে আসছে। প্রতারক ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও অন্যান্য দায়িত্বশীল সংস্থা কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ফলে খোদ রাজধানীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় চিকিৎসার নামে প্রতারণার কারবার চলছে দীর্ঘদিন।
গোলাম কিবরিয়ার ভুয়া চিকিৎসক জীবনের কাহিনী শুনে কর্মকর্তরা রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়েন। ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে দেড় সহস্রাধিক ভুয়া ডাক্তার রয়েছে। এ ছাড়া ভুয়া ডিগ্রীধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক। তারা এমবিবিএস পাস করার পর ভুয়া উচ্চতর ডিগ্রী ব্যবহার করে বছরের পর বছর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসছেন।
গ্রেফতারকৃত গোলাম কিবরিয়া র্যাবকে জানায়, সে ছিল কুষ্টিয়ার একটি ওষুধের দোকানদার। এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ২০০৩ সালে ভারতে গিয়ে এমবিবিএস ও মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী এমডি এর ভুয়া সার্টিফিকেট মাত্র ১২ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। এরপর দেশে ফিরে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সেজে কুষ্টিয়ায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পরে রাজধানীর মিরপুরে পিসিল্যাব নামে একটি প্রাইভেট চেম্বারে এবং বিভিন্ন বেসকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছিল। প্রতি রোগী বাবদ ফি নিত ৩০০ টাকা। রোগী ভাগিয়ে আনার তার রয়েছে বিশাল দালাল চক্র। গোলাম কিবরিয়ার ভাষ্যমতে ২০০৩ সাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে সে রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছিল। পিসিল্যাব নামের প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সে ২৭ লাখ টাকার বিনিময়ে পার্টনার হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য মোবাইল কোর্ট গোলাম কিবরিয়াকে ৫ লাখ টাকা এবং পিসিল্যাবের মালিক এম শামীমকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ভুয়া ডাক্তার গোলাম কিবরিয়া মোবাইল কোর্টকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে অঙ্গীকার করে যে, সে আর ভুয়া চিকিৎসকের কাজ করবে না।
এদিকে বিএমডিসি সূত্রে বলা হয়েছে এমবিবিএস পাস করার পর ডাক্তাররা পিজিটি অর্থাৎ স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। যা কোন ডিগ্রি নয়। অথচ অনেকে এমবিবিএসের পর বিএইচএস (আপার) অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিসকে ডিগ্রী হিসাবে ব্যবহার করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। সূত্র জানায়, বিএইচএস কোন ডিগ্রী নয় বলে বিএমডিসির নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া নানা ধরনের প্রশিক্ষণকে ডিগ্রী হিসাবে ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছে এক শ্রেণীর এমবিবিএস ডাক্তার। বিএমডিসির কর্তৃপক্ষের এদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কিংবা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কথা থাকলেও বাস্তবে, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলের। সূত্র জানায়, রাজধানীতে একটি চক্র দীর্ঘদিন ভারতীয় এমবিবিএস ও উচ্চতর ভুয়া ডিগ্রী নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে আসছে। রাজধানীর গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ভুয়া এমবিবিএস সার্টিফিকেট প্রদানকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান। এই সকল প্রতিষ্ঠানের ভুয়া এমবিবিএস সার্টিফিকেট নিয়ে এক শ্রেণীর চিকিৎসক সেজে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিক্যাল চেকআপ পরীক্ষাগারে, প্রতারণা করে আসছে বলে র্যাব সূত্রে জানা যায়।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক বলেছেন, ভুয়া ডিগ্রীধারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে বিএমডিসিকে ঢেলে সাজানো হবে।
উল্লেখ্য, বিএমডিসি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত এমবিবিএস ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ডাক্তাররা ভুয়া ডিগ্রি ও চিকিৎসা বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে এবং নানা অপরাধে জড়ানোর কারণে ১৯৯৪ সালে মাত্র ২ জন ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয় এবং কিছুসংখ্যক ডাক্তারকে সতর্ক করে দেয় বিএমডিসি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া কর্তৃপক্ষের কাছে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আর কোন তথ্য নেই। বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডাঃ জাহেদুল হক বসুনিয়া বলেন, বিএমডিসির কাছে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশনধারী হতে হবে। ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর। অবশ্য রেজিস্ট্রেশনধারী চিকিৎসকদের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে ওয়েবসাইট চালু করার প্রক্রিয়া চলছে বলে রেজিস্ট্রার জানান।
মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটগণ বলেন, রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ডাক্তারদের ওয়েবসাইট চালু থাকলে যে কোন রোগী কিংবা নাগরিক একজন ডাক্তারের ডিগ্রি সম্পর্কে সহজে নিশ্চিত হতে পারবেন। এতে চিকিৎসার নামে প্রতারণা কমে যাবে বলে তারা জানান।
লিংক