somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংসারের নিয়ম এবং মা

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের বাড়িতে বাবার অসুখ করত, জ্বর হত, পেটে ব্যাথা হত, মাথা ধরত, শিরায় টান পড়ত, গরম লেগে যেত। মায়ের এসব কিছুই হত না। সারাদিন উনুনের পাশে থাকলেও না। মার শরীরটি ছিল বড় নীরোগ। আমাদের দেশের সব মায়েরাই খুব নীরোগ হয়। বাবারা হয় না। বাবারা মুরগীর রানটা খায়, মাছের মাথাটা খায়, নরম মাংসটা তাদের বেছে দেওয়া হয়, পরিস্কার গ্লাসে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। তবুও সব অসুখ বাবাদেরই করে। মায়েরাও কখনও কখনও ভাল খায় তবে সে বাবার উদরপূর্তির পর অথবা কোনোদিন যদি ভালবেসে বাবা মাকে বলে রানটা নিতে তারপর।
আমাদের বাড়িতেও একই ব্যবস্থা ছিল। তবে বাবা খুব ভাল বাবা ছিলেন, ভাল খাবারটা আমাদের পাতে তুলে দিতেন, তবে মাকে নয়। বাবা খারাপ মানুষ নন, মাছের মুড়োটা মায়েরও যে দুই একদিন খেতে ইচ্ছে হতে পারে এ তিনি জানতেন না। আর সে হয়ত তার মাকেও দেখেননি বলেই। মাঝে মাঝে বাবা দুরে কোথাও যেতেন। আর সেদিনতো সারাদিন রান্না বন্ধ, যেন বাবা ছাড়া বাড়ির আর লোকের কোন খিদে নেই। আগের রান্না খাবারই খেতে হত আর বাবা ফেরার দিন মা ভাল খাবার রাঁধতেন। বাবা না রাধার কথা মাকে কোনোদিন বলে যেতেন না বরং বাজারের টাকা দিয়ে যেতেন। তবে না রাঁধাই যে সংসারের নিয়ম, মা নিয়ম মানতেন। সেই টাকা জমিয়ে রাখতেন, অসুবিধের দিনে বাবার হাতে গুজে দিতেন।
মাঝে মাঝে মায়েরও তো অসুখ হত। ঐ একটু গা গরম বলে মা কাজ লেগে যেত। বাবার হলে বাবাও অফিসে যেত। তবে আত্মীয় স্বজনদের খবর দেওয়া হত, বাড়িতে আপেল কমলা আসত, কচি মুরগীর ঝোল রাঁধা হত, সারারাত পানিপট্টি নিয়ে সরিষার তেল মেড়ে মা পাশে বসে থাকত। মায়ের অসুখ হলে বাবাকে কোনদিন দেখিনি পাশে বসে থাকতে। অথচ বাবা তো মাকে ভালবাসত। বাবার অসুখ হলে পুরা বাড়িতে দশ নম্বর বিপদ সঙ্কেত চলত, সেদিন টিভি ছাড়া যেত না। বই নিয়ে কান পেতে বসে থাকতাম কখন বাবার ডাক পড়ে, চুলটা টেনে দিতে বলে, পাটা টিপে দিতে বলে। মায়ের অসুখ হলে কোন অসুবিধা হত না, সেদিন টিভি ছাড়া যেত, দুষ্টুমি করা যেত। আমাদের খাইয়ে হয়ত মা মুখ গুজে এক জায়গায় পড়ে থাকতো। জলপট্টি নিয়ে কেউ সারারাত দাড়িয়ে থাকতো না। বড়োজোর জিগ্যেস করতাম মা ওষুধ খেয়েছ?
আমাদের সমাজের সব মায়েদের মেয়েদের গল্পটা এরকম। মায়েদের মেয়েদের অসুখ হলে ডাক্তার দেখাতেও কৃপণতা করা হয়। বেশিরভাগ মেয়েরাই তো স্বামীর উপর নির্ভরশীল। তাই তারা লজ্জা পায়। সংসারে বাড়তি খরচ ভেবে রোগা শরীরটিও তারা নীরোগ দেখায়। না হলে শ্বশুর বাড়ির লোকদের মনক্ষুণ্ণ হয়। বউয়ের এত অসুখ করলে 'সংসারে আর কি উন্নতি হবে' এরকম একটা সংশয় এসে যায়। তাই মায়েরা-মেয়েরা অসুখও হলে চেপে যায়।
একসময় তাদের এই নীরোগ শরীরটি অজানা রোগে ভেঙে পড়ে। জরায়ুর ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এসব কত অসুখে যে কত মায়েরা মরে। অনেকে তো জানবার সুযোগই পায় না কি হয়েছে। একেবারে শেষে এসে ধরা পড়ে। যখন ছেলেমেয়েরা বড় হয় অনেক মায়েরা যেন একটু সাহস পায়, কথা বলবার ক্ষমতা পায়। সংসারে বয়স্ক মেয়েদের ক্ষমতা কিছু থাকলেও থাকে, অল্পবয়সীদের থাকে না। ক্ষমতার জন্য তাদের সারাজীবন অপেক্ষা করতে হয়। তবে ক্ষমতা মিললেও ফুরসত হয়ত মেলে না, শরীরে মরনব্যাধি নিয়েও তারা রাঁধতে বসে যায়।
আমার জীবদ্দশায় মা বাড়িতে আছে আর বাবার রান্না খেয়েছি বলেতো কোনদিন মনে পড়ে না।
মাঝে মাঝে মায়ের সাথে কথা হয়, মা তোমার শরীর ভাল? ভাল। সবসময়ই কি করে ভাল? তোমার অসুখ করে না? না, করে না। অথচ আমি জানি দাঁতের ব্যাথা হলে খুঁজে খুঁজে সে সস্তা ডাক্তার দেখায়। বাবার বেলায় সেটি হয় না তবে সে হয়ত বাবা খুব অসুস্থ বলেই। মাও আমাকে বলে তুই আরেকটা ভাল ডাক্তার দেখা। আমি চুপ করে থাকি। অসুস্থ হয়ে যেন ভীষণ অপরাধবোধে ভুগি।
অনেকেই বলবেন, শুধু শুধুই কেন অভিযোগ করছ? পুরুষেরা আর কি করবে! তারা তো আয় করে, সংসারের জন্য রক্ত পানি করে। মেয়েরা তো রক্ত পানি করে না, সারাদিন জী বাংলা দেখে। কিন্তু সব মেয়েরা কি আর দেখে! অনেকেই সংসারে খেটে মরে। অনেকে নিজেই আয় করে। অনেকে স্বামীর চেয়ে বেশিও করে। একবার ঘুরে আসুন তো তাদের বাড়ি। ক’বার ডাক্তারের কাছে যায় মেয়েগুলো। ঐ পয়সায়ালা মেয়েরাও কিন্তু পয়সা বাঁচায়, অসুখ হলে ওরাও লজ্জা পায়, রোগভরা দেহটা ওরাও নীরোগ দেখায়।
এখনকার ছেলেরা নাকি অন্যরকম। খুব বউকে বোঝে, ভীষণ দেখভাল করে।তবুও বলুন তো কটা ছেলে বউকে ভাল খাবারটা তুলে দেয়? শেষ কবে বউকে রানটা তুলে দিয়েছেন, অসুখ হলে একটু পানিপট্টি দিয়েছেন?

পরিশিষ্টঃ সব বাসার গল্প হয়ত একরকম নয়। বাবাকে অশ্রদ্ধা করছিনা। আমার বাবার মত মানুষ খুব কম দেখেছি। সেই আমার নায়ক। তবু এই নায়ককেই দেখেছি তার নায়িকার সাথে এরকম করতে। এর মানে এই নয় যে তাদের মধ্যে ভালবাসা নেই। আসলে তারা ভাবে খেয়াল না রেখেও বুঝি ভালবাসা যায়। পাশাপাশি থাকলেই ভালবাসা হয়। তাদের ধরণটা আলাদা ছিল। তবে মায়ের কথা যখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কত কিছু করি, খাই, কত রেস্তোরায় যাই। মা তো তার বয়সে যাননি। মাকে যদি নিয়ে যেতে পারতাম। খাওয়াতে পারতাম। তবে এসব যে হয়নি তা অভাবের কারণে নয় বরং যা হয়েছে তা সমাজের স্বভাবের কারনেই ।

*** লেখাটি কদিন আগে ফেসবুকে দিয়েছিলাম। তাই হয়ত কারো কারো পড়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪২
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×