কিন্তু কালে কালে কি হলো, আরব বীররা এই দেশের মেয়েদের বিয়ে করে, এই সবুজ মাটির প্রেমে পড়ে, এখানকার সংস্কৃতির উদারতার টানে তারাও কেমন নিজর্ীব মুসলমানে পরিণত হলো। এর মাঝে ইংরেজ এসে এই বিশাল ভ্থখণ্ডের দখলতো নিলই, সেই সঙ্গে এখানকার অধিবাসীদের মনে আধুনিক জ্ঞান-বাসনাও জ্বালিয়ে দিলো। আর এতেই যতো কাল হলো, কারণ এই অঞ্চলের অধিবাসীরা এমনিতেই উদার বলে খ্যাত ছিল, সেই সঙ্গে ইংরেজি শিৰা যুক্ত হওয়ায় তারা নিজেরাই দেশটাকে শাসনের দায়িত্ব নিতে চাইলো। সেই সময় আমার দাদা প্রাণপণে ইংরেজের পৰ নিয়েছিলেন কিন্তু শেষ রৰা হয়নি, গান্ধী নামে এক কৌপিনধারী বৃদ্ধ ও সেই সঙ্গে তার নেহরম্ন-জাতীয় সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করলো যে, ইংরেজকে এই দেশ ছাড়তে হলো। তবে একথাও সত্যি যে, এর মাঝে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমার দাদাদের ও ইংরেজের মিলিত স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত দিয়েছিল। তবে আমার দাদাসূরীরা একেবারে বিনা লাভে সরে দাঁড়ায় নাই। তারা মুফতে একটা দেশ ঠিকই নিয়ে নিয়েছিল নিজেদের জন্য। তারা এক চোখ কানা এক ইংরেজি জানা পার্সিকে ঠিক করেছিল তাদের নেতা হিসেবে, সে দাঁড়িয়ে পেশাব করতো, শরাব পান করতো, একটু আলুর দোষও ছিল - কিন্তু তাতে কি? তার মুখ দিয়েই দাদারা বের করিয়ে নিয়েছিলো আমাদের ধর্মের মহান বাণী। আমার দাদা গর্ব করে বলতেন, "ব্যক্তি জীবনে ধর্মের নামে কোনও দিন পশ্চিম দিকে মুখ কইরা খাড়ায় নাই, আমরা তারে দিয়াই আমাগো পাকিসত্দান আদায় কইরা লইছি। আকাটা হিন্দুগো আমরা এমুন শিৰাই দিছি"।
আমার দাদার মুখের ভাষাটা একটু কাঁচা ছিল। আমার দাদীর মুখে শুনেছি সেসব। যদিও এই বৃদ্ধা কখনওই আমার দাদাকে ভালোবাসেননি বলেই মনে হয়েছে আমার। আমার বাবা তাদের তৃতীয় সনত্দান, প্রথম দু'জন মারা যায়। আমার দাদী নাকি ইচ্ছে করেই নিজের গর্ভে থাকাকালীনই তাদের মেরে ফেলেন। মৃতু্যর আগে তার মাথা খারাপ মতো হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন নিজের ঘরে বসে থাকতেন, বেরম্নতেন না। আমরা গ্রামে গেলে শুনতাম তিনি চিৎকার করে বলছেন, "তর মুখ আমি দেখতে চাই না, তুই একটা মুর্তিমান পাপ। আগের দুই পাপরে আমি নিজ হাতে মাইরা ফালাইছি। তরে পারি নাই, তাই তুইও তর বাপের মতো দেশের বিরম্নদ্ধে লাগছস। তর বাপের কুরক্ত আছে তর মইদ্যে। তর বাপে আমারে থুইয়া বান্দি লইয়া ঘুমাইতো, আর বিয়ানে উইঠ্যা আঠা লাগানো তহবনে নামাজ পড়তো, হেই বাপের পোলা তুই, তুই দেশটারে বেইচ্যা দিবি, তোরে না মাইরা আমি ভুল করছি, মহা ভুল করছি"। আমার দাদি আমাদেরও পছন্দ করতেন না, বলতেন, "সাপের ঘরে সাপই হয়, গোখরোর ঘরে কেউটে জন্মাবে, ধোড়া সাপতো আর জন্মাবে না!!"।
আমরাও দাদিকে পছন্দ করতাম না, গেঁয়ো লাগতো, অথচ মাঝে মাঝে তার মুখেই শুনতাম চমৎকার সব কথাবার্তা। কিন্তু সেসব সব আমাদের বাবার শেখানো ধর্মকথার বিপরীত। বাবা সেগুলো আমাদের শুনতে দিতেন না। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে রেগে যেতেন। বলতেন, "তোমাদের দাদির মাথা খারাপ। তোমরা উনার কাছে কখনও যাবে না। কিছু দিলে খাবে না। কখনও না"। শুনেছি ওই অশিৰিত ভদ্রমহিলা আমার দাদার অঢেল টাকা, যা পাকিসত্দান আমলেই তিনি করেছিলেন,তার কিছুই গ্রহণ করেননি। শেষ জীবন কাটিয়েছেন নিজের বাপের ভিটায়, অত্যনত্দ কষ্টে, প্রায় অনাহারে। তিনি বলতেন, "হিন্দুর জমি দখল কইরা, মানুষের রক্ত চুইষ্যা যে সম্পত্তি তোগো দাদায় বানাইছে, তাতে আমি পিশাব করি। থু থু থু. . . . তখন বুঝতাম না। এখন বুঝি কিন্তু একথাও সত্যি যে, মুসলমানের দেশে হিন্দুর কোনও অধিকার নেই। তাই হিন্দুর জানমালে মুসলমানের হক আছে, এটাই ধর্মের বিধান। আমার দাদা তাই কোনও পাপ করেননি। আমার বাবাও না। মুসলমানের দেশে বিধমর্ীর সম্পত্তি গণিমতের মাল, হুজরে পাক হজরত একথাই বলে গিয়েছেন। আমার দাদা নমস্য, তিনি এই দেশ থেকে হিন্দু খেদিয়েছেন। মহান আলস্নাহ্ তায়ালা তাকে বেহেশত্ নসীব করম্নন- যাযাকুলস্নাহ্ খাইর।
(অসমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০