somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যারা এসএসসি দিয়েছে...- মুহম্মদ জাফর ইকবাল (সেইসকল এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের জন্য যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে...)

১৫ ই মে, ২০১১ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আমার খুব প্রিয় একজন লেখক। শুধুমাত্র তার লেখার জন্য সে প্রিয় না। সে প্রিয় কারণ আমাদের কিশোর সমাজ যখনি কোন বেকায়দায় পড়ে তখনি তিনি তাদেরকে অণুপ্রেরণা দেন। মানুষ স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে পছন্দ করে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল হলেন সেই ব্যক্তি যিনি স্বপ্ন দেখতে শেখান। অতীতকে ভূলে ভবিষ্যতকে নিয়ে বেচে থাকতে শিখান। এ কারণেই তিনি আমার প্রিয়। ১৫/০৫/২০১০ইং প্রথম আলো’র সম্পাদকীয় পাতায় তার একটা অসাধারণ লেখা ছাপা হয়েছিল। সেইসকল পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে যাদের স্বপ্নভঙ্গ হবে। স্বপ্নভঙ্গ নয়, নতুন স্বপ্ন তৈরী হবে নতুন কোন ভাবে। স্বপ্ন আছে বলেই মানুষ বেচে ছিল, আছে এবং থাকবে। স্বপ্ন দেখানোর কারীগরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই তার অসাধারণ লেখাটির জন্য। আশা করবো লেখাটা পড়ে আপনারা বুঝতে পারবেন কিভাবে একজন স্বপ্নভঙ্গ মানুষকে সঙ্গ দিতে হবে। তাদেরকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাচ্ছিল্য না করে তাদেরকে অণুপ্রেরণা দেবেন। এটাই চাইবো।।।
---------------------------------------------------

১.
আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। আমি আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভুলে বসে আছি, কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলোর কথা এখনো ভুলিনি! পরীক্ষা না যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সব খবরের কাগজে হাস্যোজ্জ্বল ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপা হবে, তারা একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে ধরে, দুই আঙুল দিয়ে ‘ভি’ তৈরি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে—দেখেই আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের হাসিগুলো আমাদের মুখে ফুটে ওঠে, মনে হয়, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিয়ে আসি।
যেদিন এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়, তার পরদিন খবরের কাগজটির পৃষ্ঠা ওল্টানোর সময় আমার বুক দুরু দুরু করতে থাকে। প্রথম পৃষ্ঠায় ছেলেমেয়েদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবির পাশাপাশি আরও একটি ব্যাপার ঘটে, সেটি হচ্ছে আশাভঙ্গের বেদনা। সেই খবরগুলো খবরের কাগজে আসে না, আমরা তাই জানতে পারি না। আশাভঙ্গের কারণে কোনো ছেলে বা মেয়ে যখন ভয়ানক কিছু করে ফেলে, তখন সেটি খবরের কাগজে চলে আসে, সেগুলো দেখে আমার বুক ভেঙে যেতে চায়, নিজেদের অপরাধী মনে হয়। বেশ কয়েক বছর আগে খবরের কাগজে ফুটফুটে একটি মেয়ের ছবি দিয়ে তার বাবা-মায়েরা একটা বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ছিলেন। এসএসসির রেজাল্ট হওয়ার পর মেয়েটি মন খারাপ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, বাবা-মা কাতর-কণ্ঠে সেই মেয়েটিকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য অনুনয় করছেন। বিজ্ঞাপনটি কেটে সেটি আমি অনেক দিন পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, ফোন করে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করি মেয়েটি ফিরে এসেছে কি না। শেষ পর্যন্ত সাহস করে ফোন করতে পারিনি, যদি শুনি তাঁরা বলেন মেয়েটি আর ফিরে আসেনি, চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে, তখন আমি কী করব।
কখনো কখনো আরও ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে, পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর একটি ছেলে বা মেয়ে আশাহত হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। কী সর্বনাশ! আমি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই খবরটির দিকে তাকিয়ে থাকি, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারি না। এবার এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় হঠাৎ আমার কাছে একটি এসএমএস এসেছে, সেখানে লেখা পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে, পরীক্ষা খারাপ হওয়ার জন্য একজন আত্মহত্যা করেছে।
সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, মাঝখানে একটা সময় গেছে যখন প্রতিদিনই কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে—সবাই কম বয়সী মেয়ে। বাবা-মা বৈশাখী মেলায় নিয়ে যাননি বলে আত্মহত্যা, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মহত্যা, বখাটে ছেলে রাস্তায় টিটকারি দিয়েছে বলে আত্মহত্যা, ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছে বলে আত্মহত্যা। আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি আর চমকে চমকে উঠি।
আমার কাছে বিষয়টা অনেক বেশি বেদনাদায়ক ছিল, কারণ ঠিক সেই সময় আমার একজন ছাত্রী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শাওয়ারের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। একেবারে ফার্স্ট ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টারের বাচ্চা একটি মেয়ে। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল। নিজের হাতে নিজের জীবনটা নেওয়ার ৩০ মিনিট আগেও সে জানত না, এ রকম ভয়ংকর একটা কাণ্ড সে করে ফেলবে। গভীর রাতে টেলিফোনে খবর পেয়ে মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে আমার প্রিয় মেয়েটির প্রাণহীন নিথর দেহটিকে বাথরুমের শাওয়ারের সঙ্গে ঝুলতে থাকার দৃশ্যটি যে কী ভয়ংকর রকম হূদয়বিদারক, সেটি অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। শুধু মনে হয়, আহা, মেয়েটি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে যাওয়ার আগে যদি শুধু একবার আমাকে ফোন করে বলত, স্যার আমার বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, রাগে-দুঃখে-অপমানে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে—তাহলে হয়তো আমি এই বাচ্চা মেয়েটিকে বলতে পারতাম, তোমার জীবন তোমার একার নয়। তোমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমার আপনজনের জীবন—স্বার্থপরের মতো নিজের জীবনটুকু নিয়ে তোমার আপনজনকে তুমি কষ্ট দিতে পারো না! তাকে আমি আরও অনেক কিছু বলতে পারতাম, আগে আমার কাছে যখন লেখাপড়ার কথা বলতে এসেছে, তখন আমি তাকে যেভাবে উৎসাহ দিয়েছি, তার থেকে একশ গুণ বেশি উৎসাহ দিতে পারতাম। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি আমার সঙ্গে কথা বলেনি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলেনি, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেনি, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শাওয়ার থেকে ঝুলে পড়েছে।
আমি এখনো ক্লাস নেওয়ার সময় ভুল করে তার রোল নম্বর ডেকে ফেলি, তখন মনে পড়ে এই রোল নম্বর থেকে আমার ছাত্রীটি আর কখনো উত্তর দেবে না। একজন শিক্ষকের জীবনে এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।

২.
টিন-এজ বয়সটা খুব জটিল একটা সময়। আমরা সবাই সেই সময়টা পার হয়ে এসেছি এবং আমাদের সবারই নিশ্চয়ই সেই সময়টার কথা মনে আছে। পরিচিত পৃথিবীটা তখন অন্য রকম মনে হতো—তখন বুকের ভেতর থাকত তীব্র আবেগ। সহজ বিষয়টাকে মনে হয় জটিল, জটিল বিষয়টাকে মনে হয় দুর্বোধ্য। শরীরে নতুন নতুন হরমোন খেলা করতে শুরু করেছে, সেই হরমোন আমাদের চিন্তার জগৎকে পাল্টে দিচ্ছে। আমরা সবাই সেই জটিল সময়টা পার হয়ে আসতে পেরেছি, কারণ আমাদের চারপাশে থাকত পরিবারের আপনজন। মনের কথা বলার জন্য থাকত বন্ধুবান্ধব, কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার জন্য থাকত লেখাপড়ার দায়িত্ব, শরীরের প্রাণশক্তি বের করার জন্য থাকত খেলার মাঠ। টিন-এজ সময়ের সেই জটিল মাইনফিল্ডে সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমরা বের হয়ে এসেছি।
সবাই বের হতে পারে না, জটিল ধাঁধায় আটকা পড়ে যায়। সারা পৃথিবীর পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে টিন-এজ ছেলেমেয়েরা। আমাদের বাংলাদেশের কোনো পরিসংখ্যান আমি খুঁজে পাইনি, কিন্তু পৃথিবীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটি হচ্ছে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের অপমৃত্যুর বড় কারণগুলোর একটি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে—এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জীবনটাকে সহজ করার জন্য তাদের অনেক রকম পরিকল্পনা থাকে—আমাদের সে রকম কিছু নেই, আমরা শুধু কমন সেন্স দিয়ে এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করি। আমি যখন বাংলাদেশে প্রথম এসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি, তখন একজন ছাত্রের খোঁজ পেলাম যে একাধিকবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি, তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে তখন মাথা নিচু করে কাতর-কণ্ঠে বলেছে, ‘আমি জানি না স্যার, আমি কী করব, আমার মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করে।’ আমি তাকে বলেছি, এর পরের বার যখনই ইচ্ছে করবে, আমার সঙ্গে দেখা করবে। ছাত্রটি মাঝেমধ্যেই আসত, অপরাধীর মতো বলত তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করছে। আমি তখন তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতাম, উৎসাহ দিতাম—জটিল একটা পৃথিবী যে আসলে সহজ, আনন্দময় একটা জীবন তাকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। শেষ পর্যন্ত ছাত্রটি লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে স্থায়ী হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখে ঘর-সংসার করছে।
আমি মনোবিশেষজ্ঞ নই, আমি শুধু কমন সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি টিন-এজ বয়সের জটিল একটা সময় যদি একটু স্নেহ-মমতা দিয়ে পার করিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পরের জীবনটা হয় অনেক সহজ।
সে জন্য এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার দিন আমার বুক ধুকপুক করতে থাকে। আমি জানি, এদিন যখন লাখ লাখ ছেলেমেয়ে সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত হবে, ঠিক তখন অসংখ্য ছেলেমেয়ে আশাভঙ্গের কষ্টে কাতর হবে। এদের সবাই যে নিজের কারণে এই আশাভঙ্গের বেদনাটুকু পাবে তা নয়—অনেক সময়ই সেটি হবে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার সহকর্মীর একটি মেয়ে যখন পরীক্ষায় খুব ভালো একটা ফল আশা করছে, তখন আবিষ্কার করল সম্পূর্ণ বিচিত্র একটা কারণে খুব ভালো পরীক্ষা দেওয়া একটা বিষয়ে তাকে ফেল দেখাচ্ছে। আঘাতে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়—আমরা এ রকম কথাবার্তা শুনেছি, সেবার আমি নিজের চোখে দেখলাম। মেয়েটি শুধু যে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তা নয়, তার শরীরের সব অনুভূতিও থেমে গেল। ঘুমের ওষুধ দিয়েও তাকে ঘুম পাড়ানো যায় না, ভয়াবহ একটি অবস্থা। পরিবারের সবার স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায় তাকে শেষ পর্যন্ত সুস্থ করে তোলা হয়েছিল। পরের বার পরীক্ষা দিয়ে চমৎকার রেজাল্ট করে এখন সে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
সবাই আমার সহকর্মীর মেয়েটির মতো সৌভাগ্যবান নয় যে একটা দুর্ঘটনার পর সে গভীর ভালোবাসা এবং মমতায় সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজন আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর। একটি ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় তার পছন্দের ফল না পেয়ে যখন গভীর আশাভঙ্গের বেদনায় কাতর হয়ে আছে, তখন তাকে তার চারপাশের মানুষ থেকে গালাগাল শুনতে হয়, অভিশাপ শুনতে হয়। টিন-এজ বয়সের সেই জটিল মনোজগতে এটি যে কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার হতে পারে, সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এই দেশের সব অভিভাবকের কাছে তাই আমার কাতর-অনুরোধ, এসএসসি পরীক্ষায় আপনার ছেলে বা মেয়ের ফল যদি আশানুরূপ না হয়, তাহলে তাদের ওপর রেগে উঠবেন না। তাদের সান্ত্বনা দিন, সাহস দিন, তাদের পাশে এসে দাঁড়ান।

৩.
আমাকে মাঝেমধ্যেই নানা রকম অনুষ্ঠানে যেতে হয়, সেই অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান হচ্ছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। সেখানে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে থাকে এবং সবাই পুরস্কার পায়। সেখান থেকে কেউ মন খারাপ করে যায় না।
সব অনুষ্ঠান এত সুন্দর নয়—অনেক অনুষ্ঠানেই প্রতিযোগিতা হয় এবং প্রতিযোগিতা হলেই সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন বিজয়ী থাকে। যারা বিজয়ী হতে পারে না, আমি তাদের মনের কষ্টটা বুঝতে পারি। কারণ আমি ছেলেবেলায় অসংখ্যবার এই গ্লানি সহ্য করেছি। তাই এ ধরনের অনুষ্ঠানে গেলে আমি আমার সময়টুকু ব্যয় করি তাদের বোঝাতে যে বিজয়ী হতে না পারা অগৌরবের কিছু নয়। প্রতিযোগিতা একটা ছেলেমানুষি প্রক্রিয়া—পৃথিবীর বড় কাজ প্রতিযোগিতা দিয়ে হয় না, পৃথিবীর সব মহৎ কাজ হয় সহযোগিতা দিয়ে। তাই ছোটখাটো ব্যর্থতায় কোনো গ্লানি নেই, এটা হচ্ছে জীবনের পথচলার অভিজ্ঞতা। সবাইকে এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে!
আমি খবর পেয়েছি, অনেক বাচ্চা-কাচ্চাও খবরের কাগজে ছাপা হওয়া আমার কলামগুলো পড়ে ফেলে! (কটমটে নীরস কলাম পড়ে সম্ভবত খানিকক্ষণ আমার মুণ্ডুপাতও করে।) অনুমান করছি, অনেক কম বয়সী ছেলে এই কলামটিও পড়ে ফেলবে। আমি শিরোনামটি এমনভাবে লিখেছি যেন যারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা এটি পড়ে ফেলে।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে তাদের অভিনন্দন। আমি নিশ্চিত তাদের পরিবার হইচই করে মিষ্টি কিনে আনবে—পাড়াপড়শি সবাইকে সেই মিষ্টি দেওয়া হবে। সেই মিষ্টি মুখে না দিয়েই আমি এখনই তার মিষ্টি স্বাদ অনুভব করতে পারছি। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনটা হোক আনন্দময়, হোক সৃজনশীল। দোয়া করি তাদের যেন প্রাইভেট পড়তে না হয়, তাদের কোচিং করতে না হয়, জীবনে কখনো যেন তাদের গাইড বই স্পর্শ করে হাতকে অপবিত্র করতে না হয়। দোয়া করি, তারা বড় হয়ে এই দেশের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিক।
যাদের পরীক্ষার ফল মনমতো হয়নি কিংবা আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় খুব খারাপই হয়েছে, আমার এই লেখাটি তাদের জন্য। আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, তাদের এই আশাভঙ্গের সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের এই পচা শিক্ষাব্যবস্থা। ১০ বছর লেখাপড়া করার পর যদি কেউ শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে তার দায়ভার তার একা নেওয়ার কথা নয়। সবাই মিলে এই দেশের লেখাপড়া ঠিক করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে যেটা হয়নি, এই প্রথমবার সেগুলো হচ্ছে। (এই দেশের অসম্ভব বড় সৌভাগ্য যে তারা একজন সত্যিকারের শিক্ষামন্ত্রী পেয়েছে, যিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা জানেন। সেটাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। তাকে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু তাঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, দেশের মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে।) ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েদের যেন এক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, সেটাই আমাদের স্বপ্ন।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি, তাদের নিশ্চয়ই মন খারাপ হবে—সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন খারাপ করে তারা যেন হতাশ হয়ে না যায়। পৃথিবীটা বিশাল, তার চেয়েও বিশাল হচ্ছে মানুষের জীবন। সেই বিশাল জীবনের সঙ্গে তুলনা করলে এসএসসি পরীক্ষাটা খুব ছোট একটা ঘটনা!
কাজেই বিশাল জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এই ছোট ঘটনার কথা ভুলে নতুন উৎসাহে তাদের জীবন শুরু করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে—এই বয়সটাই অন্য রকম, এই বয়সটাতে সবকিছুকেই একশ গুণ বড় মনে হয়। আনন্দকে একশ গুণ বড় করে দেখায় দোষ নেই।
কিন্তু দুঃখ-কষ্ট-হতাশাকে একশ গুণ বড় করে দেখা যাবে না। সামনের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১১ রাত ১১:১৯
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×