গত শতকের মধ্যভাগে ভূমি দখল, শাসন ও শোষণের প্রতক্ষ্য ঔপনিবেশিক যুগের মোটামুটি সমাপ্তি হলেও নতুন পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম এমন এক বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থব্যবস্থার জন্ম দিল, যেখানে ভূমি দখলের পুরনো সাম্রাজ্রবাদের আর দরকারই থাকলনা। প্রত্যক্ষ শাসন হতে মুক্ত হলেও ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহে (যেমন: রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, ইত্যাদি) পাশ্চাত্য অনুগামী ধ্যান-ধারণা পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি হয় প্রাশ্চাত্যবাদী আধুনিকতায় লালিত, সুবিধাভোগী, গণমানুষের চেতনা বিযুক্ত এক শ্রেণী, যারা আধুনিকতা ও প্রগতির নামে অব্যাহত রাখে ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ও জ্ঞানগত অধীনতা। দেবত্ব ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে আধুনিকতা ও প্রগতির পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ তাদের মনের অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দিয়ে হয়ে উঠে ঐশ্বরিক সার্বভৌম। তাকে প্রশ্ন করা যায় না, বরং মেনে নিয়ে চর্চা না-করলে আখ্যা পেতে হয় সেকেলে, সংস্কারগ্রস্থ, রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ। প্রখ্যাত উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তক ফ্রাঞ্জ ফানো তাঁর The Wretched of the Earth গ্রন্থে বলেন, “ঔপনিবেশিক শক্তি যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করায়, সেখানে সব শিশুদের শেখানো হয় ইউরোপীয়দের আগমন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রগতির সূচনা বিন্দু। উপনিবেশীতের অতীতকে অসংলগ্ন বিকৃত সঙ্কীর্ণ বিশ্ববীক্ষা দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়। উপনিবেশ পূর্ব সময়কে বর্ণনা করা হয় অ-সভ্যতা, ইতিহাস-শুণ্যতা ও বর্বরতার যুগ হিসেবে।” এভাবে গণমানুষের চেতনায় আত্ম ও অতীত হয়ে উঠে পরিত্যাজ্য। নিজ ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ তার কাছে হীনমন্যতার আকরে পরিণত হয়, আর পশ্চিমের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আরাধ্য হয়ে উঠে। আপনকে পর ও পরকে আপন জ্ঞান করার পরিণতি উপনিবেশীতের, বিশেষত মধ্যবিত্তের, চেতনায় বিকৃতি আনে। ফলে নাট্যমঞ্চে উপনিবেশবাদের প্রস্থান ঘটলেও, প্রবেশ করল তার ভূতরে শরীর। শুরু হল এক নয়া-উপনিবেশবাদ (neo-colonialism)। অনিবার্য কারণে, একজন উত্তর- ঔপনিবেশিক চিন্তক ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস নির্মাণ ডিসকোর্সের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন, উপনিবেশবাদী ইতিহাস আখ্যান হতে তাঁর ইতিহাসকে বিকৃতি ও কালিমা মুক্ত করে পুননির্মাণ এবং পুনসঙ্গায়িত করার মধ্য দিয়ে আত্মঅতীত পুনরুদ্ধার ও আত্নপরিচয় সন্ধান এবং ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা উৎখাত করার তৎপরতায় লিপ্ত হন। ইতিহাসের প্রমিত ভাষ্যের সাথে তাঁর বোঝাপড়া তাই অকুতোভয় বিদ্রোহী সৈনিকের।
চিনুয়া আচেবে একজন উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখক হিসেবে তাঁর লেখাজোকা শুরু করেন। যোসেপ কনরাডের Heart of Darkness কিংবা যয়েস কেরির Mister Johnson-এ অফ্রিকান ইতিহাসের যে বিকৃত, খন্ডিত ও বর্ণবাদী উপস্থাপনা তাকে খারিজ করে আফ্রিকান সাহিত্যে চিনুয়া আচেবের Things Fall Apart এক নতুন পথের দিশা দান করে, নতুন যুগের গোড়া পত্তন করে। উত্তর-ঔপনিবেশিক উপন্যাসের ধারায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পূর্ব নাইজেরিয়ায় ইওমোফিয়ার ইগবো গ্রাম। সময় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের কয়েক দশক। আত্মপ্রত্যয়ী মুখ্যচরিত্র ওকোনকোর উত্থান পতনকে কেন্দ্র করে তিনভাগে বিভক্ত এ গল্পের আখ্যান রচিত হয়। ওকোনকোর জীবনচিত্র আঁকতে আঁকতে আচেবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ঠিক পূর্ববর্তী, সমসাময়িক এবং অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে ইগবোদের সজীব টলটলে জীবন স্রোতে টেনে নিয়ে যান তাঁর পাঠককে।
প্রথম পর্ব ইগবো প্রতিবেশে সমাজ সিঁড়ি বেয়ে ওকোনকোর উচ্চে আরোহনের গল্প। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় ইগবো সংস্কৃতির বীর গুকোনকোর শারীরিক সক্ষমতার উদ্বোধন। বলি খেলায় পরাক্রমশালী আমালিনজ-দ্যা-ক্যাটকে পরাজিত করে শারীরিক ক্ষমতার খ্যাতি অর্জন। যে শারীরিক শক্তি, সম্পদ, বীরত্ব ও স্ত্রী সংখ্যা ইগবো সমাজে উপরে উঠার মানদন্ড, সবকিছুই ওকোনকো অর্জন করে অগাধ পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্প দিয়ে এবং পরিণত হয় গ্রামের ক্ষমতা বলয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে। আর তার জীবনের ঘটনা প্রবাহে ইগবো জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে এমন সব বৈশিষ্ট্য যেমন––সম্পদের ধারণা, বিয়ে, উপাসানা, বিচার ব্যাবস্থা, যুদ্ধ, ভাষা, সবকিছুই দক্ষ নৃতাত্ত্বিকের গভীর অনুসন্দিৎসায় আচেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু ওকোনকোর নির্দয়তা তার কষ্টার্জিত মর্যদাকে কিছুটা অনিশ্চতায় ফেলে। পুরোহিত এযেদুর এক ছেলেকে দুর্ঘটনাবশত হত্যা করে গ্রাম থেকে সাত বছরের জন্য নির্বাসিত হয় নিকটবর্তী এম্বটানার এক গ্রামে। কাহিনীর এ অংশে আচেবে উপনিবেশপূর্ব ইগবো সমাজ পুননির্মাণ করেন। ইগবো এক সুস্থিত, চলমান ও যুথবদ্ধ সম্প্রদায় যাদের আছে কর্মনীতি এবং যারা ব্যক্তিগত অর্জনকে মূল্যায়ন করে। আছে বিশদ বিচার ব্যবস্থা এবং নমনীয় সরকার পদ্ধতি। ব্যাপক বিস্তারিত ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠানে ইগবো সম্প্রদায়ের সত্তাজ্ঞানের (ontological) অনুভূতি। তবে ইগবো অতীতকে নিছক ভাবালুতায় পর্যবশিত করা দৃঢ়ভাবে এড়িয়ে যান আচেবে। সাংস্কৃতিকভাবে অনুমদিত নৃসংশতা, আচার হিসেবে পালিত যৌনতা, জমজ সন্তান পরিত্যাগ, নিয়মিত মানব বলিদান––এসব বাদ পড়ে না তার অতীতের প্রতি সংবেদনশীল লেখনীতে। আচেবে আবার ওবিয়েরিকার মত সংস্কারমনা চরিত্র সৃজন করে এটাও স্পষ্ট করেন যে, ইগবো কৃষ্টিতে অন্তর্গতভাবে সঞ্চারিত ছিল গতিশীল পরিবর্তন সক্ষমতা।
দ্বিতীয় পর্বে, নির্বাসিত জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা জগত ও জীবন সম্পর্কে ওকোনকোর উপলব্ধি পাল্টে দেয়, পোড় খাওয়া জীবন তাকে দান করে স্বজাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা । অতিমাত্রিক আত্বসর্বস্বতার বিপদ সম্পর্কে সে সচেতন হয়ে উঠে, এবং আত্মিয়তা ও স্বজাতির প্রতি তার ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি তাকে মহৎ মানুষে পরিণত করে। আসন্ন উপনিবেশবাদের অশুভ লক্ষণ এবং সেটা প্রতিরোধে তার সংকল্পও এই পর্বে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
তৃতীয় পর্বে, ওকোনকো ফিরে আসে ইওমোফিয়ায়, যেখানে সে আবার নিজেকে পুনরায় একীভূত করতে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ইওমোপিয়ায় আসে অনেক পরিবর্তন। সব কিছু ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে––ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর নির্বিঘ্ন সক্রিয়তা আনে সনাতন জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন। বৃটিশ মিশনারীদের আগ্রাসী ধর্মপ্রচার সূচিত করে নতুন মূল্যবোধ, যেটা বিনষ্ট করে জাতিগত ঐক্য। ওকোনকোর স্বপুত্র নওয়ি খ্রিস্ট বিশ্বাস গ্রহণ করে এবং প্রত্যাখান করে পিতাকে। পরিবর্তনের প্রতি ওকোনকোর সহিংস প্রতিরোধ তাকে অন্তরীণ করে কারাগারে। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভয়ে ভীত তার স্বজাতির স্বজনরা তাকে সামান্যই সাহায্য প্রদান করে। নতুন বাস্তবতার সাথে আপোষে অনিচ্ছুক ওকোনকো আত্বহণনে অসীমের অনন্ত যাত্রায় শামীল হয়ে যায়।
উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে বিস্ময়করভাবে বক্রাঘাতমূলক (ironical) এক অনুচ্ছেদে। যে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ওকোনকোর জটিল জগত হাজির হয়েছিল, এক মুহূর্তে আচমকা তা দিক বদলায় উদ্ধত ও সংকীর্ণ বৃটিশ সাম্রাজ্যের বংশবদ জেলা প্রশাসকের দিকে। তার সীমিত বিশ্ববীক্ষা আফ্রিকাকে মামুলি গৎবাঁধা ধারণায় পর্যবসিত করে, যে ধারণাকে উপন্যাসটি শুরুতেই সফলভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিল।
ওকোনকোর উত্থান-পতনের কারণ তালাশ করতে গেলে তার ট্রাজেডির সম্মিলিত মাত্রাসমূহ সচেতনভাবে ভাবতে হয়। যে মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ তাকে ধারণ করেছিল, উপনিবেশবাদের সম্মুখে সেগুলো যখন ভেঙ্গে পড়ছিল, তখন তার পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী। জীবনের অগাধ পরিশ্রম দিয়ে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল, ঔপনিবেশিক শক্তির সম্মুখে সে তা বিসর্জন দিতে পারে না। আত্মসমর্পন করে খ্রিস্টান হতে পারে না। আত্মহননই তার ট্রাজেডির পরিণতি। ওকোনকোর নিজের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার যে সংকট, তার সাথে আপন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক সংকটের নিবিড় সর্ম্পক আছে। নয়া-ঔপনিবেশিকতা তার সম্প্রদায়ের চিহ্নায়নের বৈশিষ্ট্যগুলো অবমূল্যায়ন করে ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। এ ইস্যুগুলো Things Fall Apart-এ খুব বলিষ্টভাবে এসেছে।
Things Fall Apart-এর ভাষা ইংরেজি, প্রকরণের দিক থেকে উপন্যাস। On the Abolition of the English Department প্রবন্ধের জন্য খ্যাত কেনিয়ান লেখক আনগুজি ওয়া থিওঙ্গো (Ngugi wa Thiong’o) ভাষাকে মানুষের বিশ্ববীক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। ইংরেজিতে লেখালেখি করে আফ্রিকার প্রধানতম লেখকদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সত্বেও তিনি ইংরেজিতে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে তার অখ্যাত মাতৃভাষা গিকুয়ুতে (Gikuyu) লেখালেখি শুরু করেন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তবে ঔপনিবেশিকের ভাষার ইউরোপীয় আদর্শ আগ্রাহ্য করে দেশীয় উচ্চারণে কথা বলে, দেশজ শব্দ, বাগবিধী ও অভিব্যক্তির পুনঃপুনঃ প্রয়োগে উপনিবেশকের ভাষাকে বিনির্মাণ করা ও ভাষার উপর সাম্রাজ্যবাদী কতৃত্ব খর্ব করে দেওয়ার ভিন্ন এক উত্তর-উপনিবেশী প্রকল্পও কেউ কেউ গ্রহণ করেন। আচেবের অন্যসব উপন্যাসের মত Things Fall Apart আফ্রিকান ভাষারীতিকে উপনিবেশকের ভাষায় সমন্বয় করার কষ্টসাধ্য এক প্রচেষ্টা। আচেবে তার নিজ কৃষ্টিকে উপস্থাপন করেন ইগবো ভাষার লোকজ অলংকার, বিশেষ করে প্রবাদ ও প্রবচনের কথ্য-রূপ পুনপুন ব্যবহার করে কুঠারাগাত করেন উপনিবেশকের ভাষার অটুট শৃংখলার মূলে। প্রকরণের দিক থেকেও আচেবে গ্রহণ করেননি ইওরোপীয় উপন্যাসের আদর্শ। প্লট বুননের যে দুর্বলতা (আধুনিক ইওরোপীয় উপন্যাস সাপেক্ষে) কতিপয় সমালোচক আবিষ্কার করেন সেটা মূলত আচেবের ইচ্ছাকৃত বিচ্যুতি। গল্প বলার যে কথ্যরীতি ইগবো ঐতিহ্যে বজায় ছিল সেটাকে অবলম্বন করতেই আচেবে সরে আসেন ইউরোপীয় আদর্শ থেকে।
Things Fall Apart রচনার মধ্য দিয়ে আচেবে আফ্রিকান সাহিত্যে ব্যুপনিবেশনবাদ'র (decolonialism) যে ধারাপত্তন করেন তা আফ্রিকান মানস হতে পাশ্চাত্যায়ণের বিকৃতি সারাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আত্নপরিচয়ের হিনমন্যতার সংকট তাদের জর্জরিত করে না। অলিম্পিক গেমসের উদ্ভোধনী পর্বে স্যুট পরে ভদ্দরলোক সাজতে হয় না তাদের। “আমি খুবই আনন্দিত হব যদি আমার উপন্যাসগুলো (বিশেষ করে যেগুলো আমি অতীত প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছি) আমার পাঠকদের এতটুকু পাঠ দিতে পারে যে তাদের অতীত সব অপূর্ণতা সত্বেও বর্বরতার একটা দীর্ঘ আন্ধকার রজনি ছিল না, বরং ‘খোদার প্রতিনিধি’ প্রথম ইউরোপীয়রাই অমানিশার আঁধারি নিবেদন করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের।” আচেবের এ আশাবাদ আফ্রিকানরা ব্যর্থ হতে দেয় নি। কারণ ইগবো প্রবাদেই আছে: “Where one thing falls, another stands in its place” এবং “When the moon is shining, the cripple becomes hungry for a walk”।
[ লেখাটি চিন্তা’র ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
Click This Link