somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেক্যুলারিজম, ধর্মব্যাখ্যা ও সাম্রাজ্য: ইসলাম সংস্কারের রাজনীতি (কিস্তি: ১)

০৮ ই জুন, ২০১০ রাত ৮:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
মূল: সাবা মাহমুদ
অনুবাদ: মোকাররম হোসাইন



সেপ্টাম্বর ১১, ২০০১’র ঘটনাবহুল কালপর্ব থেকে দুই দশকের বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রাজনীতির উল্থানের প্রেক্ষাপটে সেক্যুলারিজমের [†] পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান তীব্রতর হয়েছে। চড়া সূরে বাঁধা এসব হাঁক-ডাকের লক্ষ্যবস্তু ইসলাম, বিশেষকরে ইসলামের সেই সব চর্চা ও বয়ান (discourse) যেগুলো মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের ধারক-বাহক বলে সন্দেহ করা হয়। বামপন্থি ও উদারপন্থি উভয় ধারার মধ্যে একটা প্রবণতা সমানভাবে দেখা যায়––তারা মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের ভাগ্যকে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার সাথে জুড়ে দেন। একই সাথে রাজনৈতিক মতবাদ (doctrine) ও রাজনৈতিক নীতি (ethics) হিসেবে। এই যুগলবন্দী মার্কিন পররাষট্র দপ্তর হতে উদ্ভূত বয়ানের মধ্যে তীব্রভাবে ধ্বণিত হচ্ছে, বিশেষ করে ‘ইসলামকে তার ভেতর থেকে’ নতুন আকার দেয়া ও রূপান্তর করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সমূহে। এই প্রবন্ধে আমি দুটো বিষয় পরখ করে দেখব। প্রথমত: সেক্যুলারিজমের সে বিশেষ মতবাদ যা ইসলাম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামকে সেক্যুলার করার ধারণাকে ভিত্তি দিয়েছে। দ্বিতীয়ত: সে কুশলী প্রক্রিয়া সমূহ যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভবিষ্যত এই পরিকল্পনা। ঐতিহাসিকভাবে পরিবর্তনশীল ক্যাটাগরি হিসেবে বিচিত্র উদ্ভববৃত্তান্ত (genealogy) সমেত সেক্যুলারিজমের একটা অকাট্য সংজ্ঞা নির্ধারণ অথবা মার্কিনমুলুকে বা মুসলিম বিশ্বে এর ঐতিহাসিক রূপান্তর নির্ণয় করা অমার উদ্দেশ্য নয়। আমার লক্ষ্য আরও সীমিত। আমি দেখাতে চাই সেক্যুলারিজমের সে বিশেষ বোঝাপড়া যার উপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের উপর সমসাময়িক মার্কিন বয়ানসমূহ, যে বোঝাপড়া মুসলিম বিশ্ব সংশ্লিষ্ট মার্কিন নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি দ্বারা গভীরভাবে নির্ধারিত।

সেক্যুলারিজমের আধুনিক প্রপঞ্চের উৎপত্তি বিষয়ে বেশ কটা বিবরণী পেশ করা যায়। এরকমেরই একটি ওজনে ভারী আখ্যান হল ‘ধর্মীয় সহিষ্ণুতা’র মতবাদ। এই ব্যাখ্যা আনুসারে আধুনিক সেক্যুলারিজমের উদ্ভব ঘটেছে সপ্তদশ শতকে একটা রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধের সমাপ্তি টানতে। আর এটা করা হয়ছিল দ্বন্দ্বরত খ্রিস্টান উপদল সমূহের বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে একটা নূন্যতম সাধারণ ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মীয় মতবাদ হতে সর্বতভাবে স্বাধীন একটা রাজনৈতিক নীতি সংজ্ঞায়ীত করার মধ্যদিয়ে।[১] এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন নির্ভরশীল ছিল রাষ্ট্রীয় কতৃত্বের কেন্দ্রীভূতকরণের মধ্যে। একই সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং পারিবারিক বলয়ে সমাজের সীমা নির্ধারণের উপর, যাতে বলয়গুলোর মানচিত্র আঁকা যায় রাষ্ট্রশাসনের গণিত দিয়ে এবং যেন এগুলো রাষ্ট্র শাসনের বিষয় হয়ে উঠে। এই বর্ণনায়, সেক্যুলারিজম তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্র ও চার্চের ক্রিয়াপদ্ধতি এবং রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে যে পৃথকীকরণ প্রতিষ্ঠা করে তার মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রথিত বলে বিবেচনা করা হয়। এটা ধরে নেয়া হয়, রাষ্ট্র যেকোন ধর্মীয় সত্যের প্রতি ঘোষিত নিরপেক্ষতার গুণে ধর্মীয় লক্ষ্যকে রাজনীতির চর্চা হতে পৃথক করবে এবং একই সাথে নিশ্চিত করবে ব্যক্তিগত পছন্দ ও ইচ্ছার ভিত্তিতে বল প্রয়োগহীন ধর্মচর্চা।

ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে উদারনীতির (liberalism) ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা যায়, বিবেকের স্বাধীনতাই সেক্যুলারিজমকে উদার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল কতিপয় সমসাময়িক একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (totalitarian regime) ধর্ম ও রাষ্ট্রের তত্বগত পৃথকীকরণ মেনে চললেও, তারা (উদাহরণ স্বরূপ চীন, সিরিয়া, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন’র কথা বলা যায়) মানুষের ধর্ম চর্চার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার এরূপ লঙ্ঘন উদার গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মূল অঙ্গিকারের সাথে দ্বান্দ্বিক। এর অর্থ এ নয় যে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতি কেবল একটি মডেল অনুসারে প্রণিত, চর্চিত, ও নিয়ন্ত্রিত। তবে এটাও ঠিক উদার সমাজে যেমন আছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সীমা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা নিয়ে গণবিতর্ক, তেমনি আছে বলপ্রয়োগ ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বিহীন স্বাধীন ধর্ম চর্চার অধিকার রক্ষার উদ্যোগ।[২] যদিও উদার রাজনৈতিক শাসনের বুনিয়াদি ধারণা হিসেবে চার্চ ও রাষ্ট্রের মতবাদগত (doctrinal) বিভাজন এবং বিবেকের স্বাধীনতার সেক্যুলার নীতি––এ দু’য়ের মধ্যে যে বিশেষ সর্ম্পক তা আবার টানাপোড়নে বিচ্ছিন্ন হয় এবং বিচিত্র ধরণের সমস্যাও তৈরি করে। তবুও আজকের দিনগুলোতে আমেরিকান উদার ও প্রগতিশীল সবাই সমানভাবে সেক্যুলারিজমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাদের ধারণা এই বিশেষ সমাজ-রাজনৈতিক আয়োজনই ধর্মীয় হানাহানির বিপদ ঠেকানোর সর্বোত্তম পন্থা।

লিবারেল সেক্যুলারিজম মুলত স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ এদুই নীতিকে কেন্দ্র করে গঠিত এক সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায়––এমন ধারণার প্রতি সাম্প্রতিক এক গবেষণা কতিপয় কৌতূহলোদ্দীপক চেলেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অনেক পণ্ডিতের মতে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে তথাকথিত বিভাজন ধর্ম ও আধুনিক সরকার ব্যবস্থার আন্তসর্ম্পকিত গঠনের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দেয়না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই আন্তসর্ম্পক যে কেবল প্রাচ্য সমাজেই আছে তা নয়, আছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও বৃটেনেও––যে দেশগুলো একাটা সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা কেমন হবে তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। একদিকে ঐ সব জাতি সমূহের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুননে ধর্মীয়-আন্দোলন ও -প্রতিষ্ঠান সমূহের গাঠনিক ভূমিকা[৩], অন্যদিকে পন্ডিতদের মতে, বিচারিক (juridical) ও সাংবিধানিক (legislative) পন্থায় ধর্মীয় জীবনের উপর চলতে থাকা নিয়ন্ত্রণ––এ দুই বিপরীত অবস্থা সেক্যুলার মতবাদ যে সরল সর্ম্পকের কথা বলে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল সর্ম্পকের ইঙ্গিত দেয়। আমেরিকায়, উদাহরণস্বরূপ, এক মর্কিন মনীষা দেখিয়েছেন কিভাবে নিম্ন ও উচ্চ আদালত ক্রমাগতভাবে নির্ধারণ করে দিচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের চর্চা ও প্রকাশ কখন কেমন হবে।[৪] একই সাথে আরও একটি উদাহরণ হিসেবে পাবলিক স্কুলে ধর্মীয় প্রতীক (বিশেষভাবে হিজাব) প্রর্দশনকে নিষিদ্ধ করা সাম্প্রতিক ফরাসি আইনকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায় এক আত্ন-স্বীকিৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিভাবে সংজ্ঞায়িত করে দিচ্ছে লোক পরিমণ্ডলে কোনটা ধর্মীয় ও কোনটা জাগতিক পোশাক (যা উদারনৈতিক রাজনৈতিক দর্শনে একটা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়)।

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ধর্মের সীমা এঁকে তাকে তার যথাযত স্থানে স্থাপন করবে এ অভিপ্রায়ে উদারপন্থি ও প্রগতিশীল দুধারাই প্রায়শ ধর্ম চর্চার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অনুমোদন করলেও, এ ধরণের অনুমোদন উদারনৈতিক উদ্বেগের সাথে একটা টানাপোড়ন তৈরি করে। উদ্বেগটা হল নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা পালন করতে গিয়ে একটা বিশেষ ধর্মীয় অবস্থান অবলম্বন করার সম্ভাবনা থাকে। এ উদ্বেগ দেখা যায় বুশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাঁটানো পর্যালোচনাগুলোতে। বুশ প্রশাসন যখন উগ্র ডানপন্থি খ্রিস্টান কর্মসূচি কার্যকর ভাবে এগিয়ে নেয়, তখন ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতার রাষ্ট্রীয় দাবি অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কায় পতিত হয়। একইভাবে অনেক আমেরিকান ক্রিটিকের মতে ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (laique state) সীমা লঙ্গন করে, যখন সে পাবলিক স্কুলে ধর্মীয় পোশাক প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করে আইন প্রণয়ন করে। উভয় দৃষ্টান্তই রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতা ও তার সকল নাগরিকদের বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার প্রতি হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ভয়টা হল ধর্মের উপর রাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ––যা ‘তৃতীয় বিশ্ব ব্যতিক্রমতা’র (Third World exceptionalism)[৫] নির্দেশক বলে প্রায়শ বিবেচিত হত, তা এখন পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে রীতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রবণতা সারিয়ে তোলার ব্যবস্থাপত্রগুলোতে অনেক হেরফের আছে। অনেকেই আত্ন-স্বীকৃত ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রকে উদ্দিপনা দেয় আরও বেশি নিষ্ঠার সাথে ও ন্যায়সম্মত ভাবে কেবল কতিপয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না-রেখে উদার সমাজের অন্তর্গত সকল ধর্মগোষ্ঠীর জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুমোদন করতে। কেউ কেউ ধর্মীয় সীমায় যে কোন রকম বিচারিক বা সাংবিধানিক হস্তক্ষেপ বাতিল করার আহ্বানও করেন; এবং এসত্ত্বেও অন্যরা সুপারিশ করেন, রাষ্ট্র যেন সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হতে আর্থিক সাহায্য তুলে নেয়।

এই ব্যবস্থাপত্রগুলো যত সদিচ্ছাপ্রণোদিতই হউক না কেন, সেগুলো সেক্যুলারিজমের এমন এক বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করা হয়েছে, যার আছে তার মানদণ্ডগুলোর কোনটার প্রতি মাত্রাধিক উৎসাহ কোনটার প্রতি খুব সামান্য। লোক পরিমণ্ডল হতে ধার্মিকতার নির্বাসনই সেক্যুলারিজম এমন দাবি বাহ্যিক ভাবে গ্রহণ করতে যেমন মাত্রাধিক আগ্রহ দেখা যায়, তেমনি ধর্মীয় বিবাদ নিবারণ করার সবচেয়ে কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে সেক্যুলারিজমকে বুঝতে না চাওয়ার ব্যর্থতা বলে দেয়, কত সামান্যই সেক্যুলারিজমের মানদণ্ডগুলো স্বীকৃত হয়। উপরের উদাহরণগুলো এ আভাস দেয় যে, লোক পরিমণ্ডল হতে ধর্মকে নির্বাসন করা সেক্যুলারিজমের লক্ষ্য হিসেবে খুব জোরালো নয়; তবে, ধর্ম যে রূপ পরিগ্রহ করে, যে ব্যক্তিচৈতন্য ধর্ম অনুমোদন করে এবং ধর্মের যে জ্ঞানতাত্ত্বিক দাবি––এসব কিছুই সেক্যুলারিজম রূপান্তর করতে চায়। এরকম একটা সামগ্রিক প্রকল্পের কার্যকারিতা অপরিহার্যভাবে নির্ভর করে নানা রকম সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ধর্মীয় পরিধির রূপান্তরের উপর। এর অর্থ হল জাতিরাষ্ট্রগুলোকে বাস্তবিকপক্ষে (de facto) ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে ধর্মে-নিস্পৃহ কতিপয় চর্চা ও বিশ্বাস পরিবেশন করে, যেন সেগুলো দেওয়ানী আইনের (civil law) অধীনে নিয়ে আসা যায়।[৬] তালাল আসাদ তাঁর ফরাসি সেক্যুলারিজমের উপর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে লিখেছেন––ধর্মনিরপেক্ষ উদার রাষ্ট্র ধর্মীয় জীবনধারার উপর যে নিয়ন্ত্রণ চালাচ্ছে তকে উদারতান্ত্রিক শাসনরীতির ব্যতিক্রম হিসেবে বুঝতে চাওয়া ঠিক নয়, বরং বুঝতে হবে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা হিসেবে, স্মিতিয় অর্থে[††] ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে।[৭] আসাদের মতে, যদিও সেক্যুলারিজম রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় জীবন––এ দু’এর পারস্পরিক স্বাধীনতা মেনে নেয়, তবু কেবল রাষ্ট্রেরই আছে ধর্মচর্চা ও ধর্মমত’কে আক্রান্ত করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কিন্তু রাষ্ট্রকে আক্রান্ত করে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ধর্মের নেই। এই অপ্রতিসমতা, আসাদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতার এক মাপকাঠি, যেহেতু ‘ব্যতিক্রম’কে সংজ্ঞায়িত করার একচ্ছত্র কতৃত্ব কেবল রাষ্ট্রই ধারণ করে।

ইউএস কঙগ্রেস প্রণীত International Religions Freedom Act (IRFA) পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কিভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা ধর্মীয় স্বাধীনতার সেক্যুলার নীতিকে একটা নিয়মের অন্তর্গত করতে চায়। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের অধীনে IRFA সাক্ষরিত হয়ে আইনে পরিণত হয়, যা বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বেগবান ও রক্ষার নামে কার্যত ধর্মীয় জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণকে সম্প্রসারণ করার অভূতপূর্ব এক ক্ষমতা প্রধান করে ইউএস ফেডারেল সরকারকে।[৮] আমরা যদি আসাদকে অনুসরণ করে এই আইনের অনুচ্ছেদটি পাঠ করি তবে দেখতে পাব এ আইন সেক্যুলার মতবাদ খর্ব করতে চায়না বরং চায় এর যথাযত সম্প্রসারণ––বিশেষ করে একে যদি আমরা বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার নিজের ‘ব্যতিক্রম সার্বভৌম’র সংজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার অভিকাক্ষা হিসেবে দেখি।[৯]

একইভাবে, সেক্যুলারিজমের মানদণ্ডের দ্বিতীয় দাবিটিও (সেক্যুলার রাজনীতি যেকোন বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি পক্ষপাতহীন থাকবে) সমস্যাসঙ্কুল। কারণটা শুধুই এটা নয় যে (এমত পোষণ আজকাল প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে), যেকোন জাতীয় সংস্কৃতি দানা বাঁধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় রীতিকে প্রাধান্য দিয়ে, তদনুযায়ী আপোষ করে উদার রাষ্ট্রের ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতার দাবীর সাথে।[১০] তার পরিবর্তে আমার বিবেচনা হচ্ছে, সেক্যুলার মতবাদ কতৃক প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণে কিংবা ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুমোদনে অতবেশি নিহিত থাকেনা। এ সমাধান আনেক বেশি পরিলক্ষিত হয় সেক্যুলার সংস্কৃতির সাথে সংগত ব্যক্তিচৈতন্য, আধ্যাত্বিকতা, এবং ইতিহাসের সাথে তার বিশেষ সর্ম্পক নির্মাণের মধ্যে। সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যা বা বিধান’র (rubric) নিচে প্রায়শ উল্লেখিত সেক্যুলার সংস্কৃতির এ বৈশিষ্টগুলো শুধু রাষ্ট্রীয় এজেন্সি দ্বারাই প্রচারিত হয়না বরং এতে নিবেদিত থাকে নানা মাত্রিক সামাজিক সংঘ এবং পাত্র, যারা এমনকি ব্যতিক্রমকে সংজ্ঞায়িত করার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম দাবিকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অন্যদিকে ভিন্নতা ও বৈচিত্রতার প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার মধ্যে যে রাজনৈতিক সমাধান সেক্যুলারিজমে আছে বলে দাবি করা হয়, আমার বিবেচনায়, তা খুব বেশি নয়, যতটুকু আছে উদার রাজনৈতিক শাসনের সাথে নমনশীল (compliant) হিসেবে পেশ করা যায় এমন ধর্মীয় ব্যক্তিচৈতন্য পুননির্মাণে (বল প্রয়োগ দরকার হলেও)।[১১] সেক্যুলারিজমের সহিষ্ণুতার দাবীকে যেসব সমালোচক আরো জোরালো করতে চান, তাদেরকে অবশ্যই বোঝাপড়া করতে হবে সেক্যুলারিজমে অন্তর্গত মাননির্ধারক এ চালিকাশক্তির সাথে, যে চালিকাশক্তি স্বীকৃতি দেয় ঐ সব ব্যক্তিচৈতন্য, যেগুলো “ধর্মীয়ভাবে পক্ষপাতহীন রাজনৈতিক নীতি” হিশেবে বহুকাল কথিত রাজনৈতিক শাসনের মডেলের সাথে সংগত।

তারপর এ প্রবন্ধে আমি সেক্যুলারিজমের এসব মানদণ্ডসমূহ, জাতি-রাষ্ট্রই যাদের স্বাভাবিক নিবাস, অনুপুঙ্খ পরিক্ষণ করতে চাই। বিশ্বব্যাপী ইসলামকে নতুন আকার দেয়ার ও সংস্কার করার যে মার্কিন প্রকল্প তাকে বিবেচনায় নিয়ে, আমি ভেবে দেখতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র কতৃক অনুসৃত সাম্প্রতিক আধিপত্যবাদী কৌশলের সাথে সেক্যুলারিজমের সম্পর্ক কোথায়। গত দু’বছর ধরে “সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে (সামরিক) যুদ্ধ” ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সংবেদনশীলতা তৈরি করার মানসে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধর্মতাত্ত্বিক প্রচারণা হাতে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মতে, এসব সাধারণ মুসলমান বিপজ্জনকভাবে ইসলামের মৌলবাদী ব্যাখ্যা দ্বারা অনুপ্রাণিত। আসলে এটা হচ্ছে ব্যাপক মুসলিম জনসমষ্টিকে বশে আনা ও নিয়মানুবর্তি করার সামরিক অভিযানের এক ভাবাদর্শিক অস্ত্র। এই মুসলিম জনসমষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ এবং “ওয়েষ্টার্ণ ভ্যালুজ” বলে শিথিল শব্দ চয়নে ধৃত ভাবাদর্শের বিরূদ্ধে ইসলামি প্রতিবাদের যেসব চরমপন্থি ও মৌলবাদী রূপ আছে সেগুলোর সদস্য সংগ্রহস্থল হিসেবে বিবেচিত হয়।

এই বিস্তৃত কর্মযজ্ঞে, মার্কিন সরকার সহজাত মৈত্রি খুঁজে পেয়েছে মডারেট বা লিবারেল মুসলিম প্রকরণে। এসব মুসলিম, পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিকল্পকদের মতে, “পাশ্চাত্য দর্শনজাত সভ্যতা, রাজনীতি ও সমাজ” [১২] -এর প্রতি সবচেয়ে বেশি মুক্তমনা। বিস্ময়কর ব্যপার হল, ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয় যে এই সব নানা মতের মুসলিম সংস্কারক ও বুদ্ধিজীবী স্বস্ব অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অনুমোদন করার মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হন। এসব ভাবুকদের অনেকেই ইরাকের মার্কিন সামরিক দখলদারিতার সমালোচক এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডায় তাদের অংশগ্রহণ খুব সরলও নয়। যে বিষয়টা এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে এসব ভাবুকদের একত্র করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাবিক মিত্রে পরিণত করে, অস্বাভাবিক হলেও, তা হল ধর্ম ব্যাখ্যার (spiritual hermeneutics) এমন এক তত্ত্ব যাতে এসব মুসলিম ভাবুক ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ অংশীদারি ভূমিকা আছে। ইউএস বিশ্লেষকদের পরিপ্রেক্ষিতে, মূল সমাস্যা জঙ্গিবাদ নয় বরং ধর্মব্যাখ্যা। যেহেতু ধর্মব্যাখ্যাই ধর্মীয় ব্যক্তিচৈতন্য নির্মাণ করে, অতএব ধর্মভাষ্য নির্মিতিই মানব মুক্তির বা সেক্যুলার মানব গড়ার চাবিকাঠি। এ-বোঝাপড়ার কারণেই মার্কিন কুশলীগণ আত্নস্বীকৃত সেক্যুলার লিবারেল মুসলিম সংস্কারকদের সাথে একই বীণার তারে সুর বেঁধেছে। এইসব সংস্কারকগণ বহুদিন যাবত প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশণের ধারায় ইসলামকে নতুন আকার দিতে চেষ্টা করে আসছেন।[১৩] তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও সেক্যুলার লিবারেল মুসলিম এজেন্ডার ঐকতান কেবল কতক রাজনৈতিক লক্ষ্যের দৈব মিলন হিসাবে বুঝতে চাইলে হবেনা বরং বুঝতে হবে আদর্শ সেক্যুলারিজমের অবস্থান হতে এবং এটা কোন ধরণের ধর্মীয় ব্যক্তিচৈতন্য অনুমোদন করে সেখান থেকে।

এটা ভাবার কোন কারণ নাই যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প সরলভাবে অধর্মীয় অর্থে সেক্যুলার। প্রকৃতপক্ষে, এটা ডানপন্থি খ্রিস্টান রাজনীতির (Christan Right) স্বার্থ, কর্মসূচি এবং আকাঙ্খার সাথে জড়িয়ে আছে। আমার মত হচ্ছে সেক্যুলারিজম যদি একটা রাজনৈতিক শাসনের মডেল হিসেবে ধর্মীয় ব্যক্তিচৈতন্য রূপান্তার করতে এবং তাকে একটা বিশেষ কোঠা-ভিত্তিক (modular) আকার দিতে চায়, তবে সাম্প্রতিক মার্কিন এ প্রকল্প ইসলামকে সংস্কার করার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তার সেক্যুলার রূপ প্রদর্শন করে। এভাবে মুসলিম বিশ্বে সাম্প্রতিক মার্কিন সাম্রজ্যবাদী অভিযানের পরিপ্রেক্ষিত হতে দেখলে, সেক্যুলারিজম নিজেকে ধর্মের সীমা নির্ধারণী বা জাতিরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে রাজনীতিকে ধর্ম হতে সুরক্ষাকারী কোন ব্যাপার হিসেবে প্রকাশ করার চেয়ে বরং তার সভ্য বানানো ও শৃঙ্খলানুবর্তী করার চরিত্রটা প্রকাশ করে। তারপর আমি সেক্যুলারিজমের অনুষঙ্গী নৃবিজ্ঞান দিয়ে পরখ করে দেখতে চাই সেক্যুলারিজমের আদর্শ কাঠামোটা, যেটা সাম্প্রতিককালে মুসলিম সংস্কারকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কিন কৌশলগত স্বার্থকে যোজন করার পটভূমি নির্মাণ করেছে। এই যুথবদ্ধ অবস্থান একটা সাধারণ ঐক্যমতে পৌছায় সমকালীন মুসলিম সমাজের রোগগুলো (পশ্চাৎপদতা, সনাতনবাদ ও গোঁড়ামী) সনাক্ত করার অভিপ্রায়ে এবং এই সব পীড়া দূর করার ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণে। আমি আরো দেখাব, কিভাবে এই সব সমাধানে নিহিত থাকে ধর্মতাত্ত্বিক পথ্য এবং নিহিত থাকে একটা বিশেষ ধরণের ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যা––এই সব কিছুর উদ্দেশ্য হল “ধর্মীয়ভাবে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক নীতি” অনুধাবনে সক্ষম আলোকিত ধর্মীয় ব্যক্তিস্বত্বা নির্মাণ।

লেখক পরিচিতি: সাবা মাহমুদ অধ্যাপনা করছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্ণিয়া’র নৃবিজ্ঞান বিভাগে। Anthropology of subject formation, liberalism, and secular modernity; feminist and poststructuralist theory; religion and politics; Islam, the Middle East, and South Asia ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অনুরাগ আছে। প্রকাশিত গ্রন্থ Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject (Princeton University Press, 2005)। অনুবাদকৃত প্রবন্ধটির শিরোনাম, Secularism, Hermeneutics, and Empire: The Politics of Islamic Reformation। লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে লগ ইন করতে পারেন: http://anthropology.berkeley.edu/mahmood.html

লেখকের নোট: প্রবন্ধটির উপর মন্তব্যের জন্য আমি ধন্যবাদ দিতে চাই তালাল আসাদ, চার্লস হির্সচ্কিন্ড ও এলিজাবেথ পোভিনেলি’কে। গবেষণা সহযোগিতার জন্য মিশেল এলান ও কিন্ডি হুয়াও’দের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা।

সনদ ও শরাহ:

†. সেক্যুলার ও সেক্যুলারিজম শব্দ দুটোর বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার না করে ইংরেজি (ফরাসিও বটে) ব্যবহার করা হয়েছে। একটা কৈফিয়ত দেওয়া দরকার। সেক্যুলারিজম খাঁটি অর্থেই একটা ইউরোপীয় প্রপঞ্চ। ইউরোপে সেক্যুলারিজম একই সাথে রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন দর্শন নির্দেশ করে। একটা আরেকটার থেকে পৃথক কোন ব্যাপার নয়। ফলে একই শব্দ দিয়ে দুই ভাবই বুঝানো সম্ভব। প্রথিতযশা নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ তাঁর Formation of the Secular: Christianity, Islam, Modernity (Stanford, Calif.: Stanford University Press, 2003) কিতাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইউরোপে তার নিজ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আলোকসম্পাত পর্বে খ্রিস্টধর্ম প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশনের প্রতাপে সেক্যুলার রাষ্ট্রের সাথে নমনশীল একটা রূপ লাভ করেছে। সেখানে একই ব্যক্তি চৈতন্যে সেক্যুলার জাতি-রাষ্ট্রের-নাগরিকতা ও খ্রিস্ট-ধর্মে-নিষ্ঠতা বিরাজ করে কোন দন্দ্ব ছাড়াই। কিন্তু বাঙাল অঞ্চলে সেক্যুলারিজম অনেকটা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং কিছুটা ইউরোপ থেকে ধার নেওয়া। ফলে এটা রাজনৈতিক দর্শন কিংবা জীবন দর্শন কোনটাতেই পূর্নাঙ্গতা লাভ করেনি। কারণ হিসেবে অনেকে এতদ অঞ্চলের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাথে সেক্যুলারিজমের সম্পর্কহীনতাকে চিহ্ণিত করেন। কেউ কেউ একে ধর্মহীন দর্শন (রাজনৈতিকই হোক বা জীবন দর্শনই হোক) হিসেবে বুঝেন। আবার সেক্যুলার অনেক রাজনীতিবিদকে দেখ যায় সর্বদা টুপি পরে থাকতে। তাদের অনেকে আন্তরিকভাবে ধর্মকর্মও পালন করেন। আবার শিক্ষানীতি’২০১০ থেকে সরকার “সেক্যুলার” শব্দটা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে ইসলামপন্থিদের প্রবল চাপে। অনেক ভুল-বোঝাবুঝি ও ফাঁকি সহ সেক্যুলারেজম টিকে আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার গুণে। এ কারণে বংলা ভাষায় সেক্যুলারিজমের প্রকৃত ভাব নিদের্শক কোন শব্দই তৈরি হয়নি। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘লোকায়ত’ কিংবা ‘ইহজাগতিকতা’ এ শব্দগুলো দিয়ে সেক্যুলারিজমের প্রকৃত ভাব ধরা যায়না। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা নিছকই রাজনৈতিক ভাববাহী, অন্যদিকে ‘লোকায়ত’ বা ‘ইহজাগতিকতা’ কেবল জীবন দর্শন নির্দেশ করে। এতদ কারণে অত্র প্রবন্ধের অনুবাদে সেক্যুলার বা সেক্যুলারিজম শব্দগুলোই ব্যাবহার করা হয়েছে।

অনুবাদকের শরাহগুলো [†] চিহ্ন যুক্ত করে দেয়া হয়েছে মূল লেখকের সনদ ও শরাহ হতে পৃথক ভাবে বুঝার জন্য।

১. এটা অতি সাধারণ এক ঐতিহাসিক বিবরণ। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক এক চমৎকার উপস্থাপনার জন্য দেখুন, Charles Taylor, “Modes of Secularism,” Secularism and Its Critics, সম্পাদনা Rajeeb Bhargava (New Delhi: Oxford University Press, 1998), পৃষ্ঠা: ৩১-৫৩।

২. আইনের পণ্ডিত নোয়াহ ফেল্ডমেনের আমেরিকার ‘সংস্কৃতি যুদ্ধসমূহ’র সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ ও সমাধান উদার সেক্যুলারিজমের এ দুই নীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাঁর যুক্তি হল ‘value evangelicals’ এবং ‘legal secularists’ দের মধ্যে দ্বন্দ্বের শিকড় নিহিত আছে: একদিকে যেমন ইভানজেলিক্যালদের আছে ধর্মীয় প্রকল্পে রাষ্ট্রীয় কোষাগার কাজে লাগানোর অভিপ্রায়, অন্যদিকে সেক্যুলারপন্থি (সাধারণত আইনত প্রক্রিয়ায়) লোক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় প্রতীক প্রদর্শনকে সীমিত করার সংকল্প। ফেল্ডমেন প্রস্তাব করেন: এই অচলাবস্থা ঘুচানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ইভানজেলিক্যালদের ধর্মীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহার পরিত্যাগ করে লোক পরিমণ্ডলে ধর্ম প্রকাশের জন্য সেক্যুলারপন্থিদের পক্ষ হতে অধিকতর সহিষ্ণুতার দাবি করা। যেখানে প্রথমোক্তদের রাষ্ট্র ও ধর্মের আনুষ্ঠানিক পৃথকীকরণ রক্ষা করতে হবে, দ্বিতীয়োক্তদের নিশ্চিত করতে হবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনে প্রকাশ্যে ধর্মীয় নিবিড়তা প্রকাশে স্বাধীনতার অনুভূতি। দেখুন Noah Feldman, Divided by God: America’s Church-State Problem–and What We Should Do About It (Newyork: Farar, Straus and Girox, 2005)।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের উপর দেখুন Sacvan Bercovitch, The American Jeremiad (Madison: University of Wisconsin Press, 1978), এবং James Morone, Hellfire Nation: The Politics of Sin in American History (New Haven, Conn.: Yale University Press, 2004)। বৃটেনের উপর দেখুন Peter Harrison, “Religion” and Religions in the English Enlightenment (Cambridge: Cambridge University Press,1900), এবং Peter van der Veer, Imperial Encounters: Religion and Modernity in India and Britain (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 2001)। ফ্রান্সের উপর দেখুন Jean Bauberot’র “The Two Thresholds of Laicization,” Bhargava, Secularism and Its Critics, পৃষ্ঠা: ৯৪-১৩৬।

৪. দেখুন Winnifred Sullivan’র Paying the Words Extra (Cambridge, Mass.: Harvard University Press, 1994) এবং The Impossibility of Religious Freedom (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 2005)।

৫. শব্দবন্ধটি চয়ন করেছেন পার্থ চ্যাটার্জি, টপডাউন মডেল হিসেবে ভারতে গৃহীত state secularism বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে উদারনৈতিক রাজনৈতিক শাসন সহজ করতে হিন্দুত্ব ও ইসলাম’র মতবাদ ও চর্চায় কতিপয় রূপান্তর ঘটানো হয়েছিল উপনিবেশী ও উত্তর-উপনিবেশী পর্বে। দেখুন Chatterjee, “Secularism and Tolerance,” Bhargava, Secularism and Its Critics, পৃষ্ঠা: ৩৪৫-৭৯।

৬. এই যুক্তিতর্কের জন্য দেখুন, Kirstie McClure’র “Difference, Diversity, and the Limits of Toleration,” Political Theory 18 (1990), পৃষ্ঠা: ৩৬১-৯১। এ ধারার যে বিকাশ ভারতে হয়েছে তার জন্য দেখুন Partha Chaterjee, “Secularism and Tolerance”; মিসরে এই রূপান্তরের উপর দেখুন Talal Asad’র “Reconfigurations of Law and Ethics in Colonial Egypt,” Formation of the Secular: Christianity, Islam, Modernity (Stanford, Calif.: Stanford University Press, 2003), পৃষ্ঠা: ১৮১-২০৪।

††. দেখুন জার্মান রাজনীতি বিজ্ঞানী Carl Schmitt, Political Theology (Massachusetts: The MIT Press, 1985)।

৭. Talal Asad, “Trying to Understand French Secularism,” Political Theologies, সম্পাদনা, Hent de Vries (New York: Fordham University Press, প্রকাশিতব্য)।

৮. International Religious Freedom’র উপর মার্কিন কমিশন। International Religious Freedom Act of 1998 (22 U.S.C. 6401 note)। দেখুন Click This Link (অগাষ্ট ৮, ২০০৫’এ অভিগমন)।

৯. এর অর্থ এ নয় যে, বিশ্বের উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। মার্কিন সামরিক দখলদারিতার বিরূদ্ধে আজকের ইরাকে চলমান গরিলা যুদ্ধের আকারেই হোক বা মার্কিন করপোরেট হেজিমোনির বিরুদ্ধে বিশ্বায়নবিরোধী প্রতিবাদের প্রকরণেই হোক, বিশ্বব্যাপী কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার আমেরিকান আকাঙ্ক্ষা অপ্রত্যাশিত চ্যালেণ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

১০. এ মন্তব্যের সাথে প্রায়শঃ এ দাবিও করা হয় যে, ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতিকে বাস্তবিকভাবে আরও বেশি বেগমান করা হোক এবং সব ধর্ম ’কেই (শুধু সংখ্যাগরিষ্টের ধর্মকে নয়) লোক পরিমণ্ডলে সমান জায়গা দেয়া ও কথা বলতে দেয়া হোক। উদাহরণ হিশেবে দেখুন William Connolly, Why I Am Not a Secularist (Minneapois: University of Mennesota Press, 1997), এবং Janet Jakobson ও Ann Pellegrini, Love the Sin: Sexual Rgulation and the Limits of Religious Tolerance (New York: New York University Press, 2003)। যাহোক এ সুপারিশে লোক পরিমণ্ডেলে একটা ধর্মগোষ্ঠীর “অন্তর্ভুক্তি”র শর্তাবলী অবিবেচিত থেকে যায়। এটা আমলে নেয়া হয়না যে একটা বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি বা স্বীকৃতির দাবি গৃহিত হবে কিনা সেটা নির্ভর করে লিবারেল ন্যাশনাল ডিসকোর্সের পরিভাষার মধ্যে এরূপ একটা দল নিজেকে সনাক্ত করতে পারছে কিনা এবং আত্মস্বীকৃতি অর্জন করতে কতটুকু সক্ষম তার উপর। আত্নপ্রকাশের এসব বিধানে আত্নসমর্পন না করলে সেসব ধর্মীয় সংবেদনশীলতা লোক পরিমণ্ডলে অশ্রুত থাকে যায়। বহুস্তরিক উদারনৈতিক সংস্কৃতিবাদ’র (multiculturalism) বয়ানে অর্ন্তনিহিত অস্পষ্টতার পরিধি বিষয়ে দেখুন, Eliazbeth Povinelli, The Cunning of Recognition: Indigenous Alterities and the Making of Australian Multiculturalism (Durham, N.C.: Duke University Press, 2002)। সহিষ্ণুতার উদারনৈতিক ধারণা, বিশেষ করে সমকালীন যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রাবল্য ও সাম্প্রতিক বিস্তারের উপর, দেখুন Wendy Brown, Regulating Aversion: Tolerance in the Age of Identity (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 2006)।

১১. অনেকে এটাও বলেন যে, সেক্যুলারিজম প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান “ধর্মীয় হানাহানি পরিহার” করতে চাওয়ার মধ্যে নয়, বরং সমাধানটা তারা দেখেন সেক্যুলার-রাজনৈতিক মূল্যবোধের সাথে অসংগত ধর্মীয় জীবনধারা সমূহ অন্তত মুলতবি (provisional) করে রাখা, যদি বিলুপ্ত করা না যায়। এরূপ কৌশল [লেখকের মতে] ধর্মীয় হানাহানি কমানোর পরিবর্তে বরং বাড়িয়ে দেয়।

১২. ঠিক এ ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে Rand Corporation’র National Security Division কতৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে, যেটা নিয়ে পরে আমি আরও বিস্তারিত ভাবে বলব। দেখুন Cheryl Benard, Civil and Democratic Islam: Parners, Resources, Strategies (Pitsburg: Rand Corporation, 2003), পৃষ্ঠা: ৪।

১৩. বাস্তবিকই, লিবারেল ইসলামের জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখালেখি করেন যেসব পণ্ডিত তাদের অনেকেই মডেল হিসাবে প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশনকে বিবেচনা করেন। এদের কেউ কেউ লুথারস অব ইসলাম হিসেবে খ্যাত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১০ রাত ১১:৩৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×