১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে, হিটলার, ১ম বিশ্বযুদ্ধে হারানো জার্মান ভূখণ্ডগুলোকে(অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, রাইন-ল্যান্ড, ডানযিগ ইত্যাদি) পুনরায় তার স্বপ্নের third reich এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে সচেষ্ট হন। ইতিমধ্যে তিনি দেশের বেকারত্ব অনেকাংশে দূর করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। দেশকে সর্বকালের সেরা সামরিক শক্তিতে পরিণত করতে অস্ত্রের প্রয়োজন। এই জন্যে তিনি বিশাল অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই সব অস্ত্র কারখানাগুলোতে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষরা কাজ পেয়ে যায়। যুদ্ধাবস্থায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এই কারণে সমগ্র দেশ জুড়ে তৈরি করা হই সুবিশাল ও অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই ভাবে হিটলার দেশের মানুষের মন জয় করেন।
তাছাড়া ততদিনে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ইহুদীদেরকে মানবজাতির মূলশত্রু হিসেবে চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন। সাধারণ মানুষ, তাদের প্রিয় ফিউরারের কথামত এটি বিশ্বাস করে যে, ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মূল কারণই হল, বেজন্মার দল, ইহুদী জাতির বিশ্বাসঘাতকতা।
১৯৩৩ সালে যে হিটলারকে অনেকেই সন্দেহ করত, ১৯৩৮ সালে সেই হিটলারই তাদের আস্থার প্রতীক। তাদের ত্রানকর্তা। তাদের প্রিয় ফিউরার।
এইবার মুদ্রার ওই পিঠ দেখা যাক।
১৯৩৮ সাল। নাৎসিবিরোধী উগ্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থা তখন সঙ্গিন। এই দলগুলোর সদস্যদের অনেকেই আর্মি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কিন্তু দ্য ফিউরারের দীক্ষায় দীক্ষিত বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় এরা খর্ব শক্তির এক দল। তাদের সারাদিন ভয়ে ভয়ে চলতে হত। গেস্টাপোর(এলিট পুলিশ) হাতে একবার ধরা পড়লে সব শেষ। আর তাছাড়া বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর আর্মির জেনারেল স্টাফের মধ্যে উপরের মহলের অনুমতি ছাড়া যোগাযোগ করা যেত না। গেস্টাপোর কড়া নজরদাড়িতে এইসব উগ্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
১৯৩৯ সালে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে জার্মানি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অনেকের তা পছন্দ হয়নি। এই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর যারা হিটলারকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগে হিটলারের অনুরাগী ছিলেন। হিটলার কিন্তু বিনা যুদ্ধে চালাকি করে, ১ম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হারানো ভূখণ্ডগুলোকে, আদায় করে নিয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে আর্মি থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি জার্মানিকে এক দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চিত যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দেন, তখন অনেকেই বিবেকতাড়িত হয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হত্যাচেষ্টাঃ
১) ১৯৩৯, অক্টোবর ৫।
ওয়ার্শ(warsaw), পোল্যান্ড।
পোলিশ আর্মি হিটলারের চলার পথে মাইন পুঁতে রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত(সৌভাগ্যবশত???) হিটলারের গাড়ি সেই বড়সড় মাইন ফিল্ডে একটা মাইনও না ফাটিয়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।
২) হিমলার বম্ব প্লট।
১৯৩৯, নভেম্বর ৮।
বার্গার-ব্রাকেলার(burgerbraukellar), মিউনিখ।
এসএস(ss) তথা হিটলারের কুখ্যাত বডিগার্ড বাহিনীর আলোচনা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচনা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, SS এর ইতিহাস হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির যুদ্ধপরাধের ইতিহাস। আর SS এর নেতা ছিলেন Heinrich himmler। নাৎসিদের মধ্যে অতি বর্বর, পাষাণ, কসাই বলে যদি কারো নাম বলতে হয় তবে হিমলারের নামই সবাই বলবে। কিন্তু যখন এই খর্বাকৃতির, গোল চশমা পড়া মানুষটি, ১৯৪৫ সালে, ব্রিটিশদের নিকট ধড়া পড়া থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করেন, নিজের সাথে তখন তিনি অসংখ্য, অসংখ্য, অজানা তথ্য নিয়ে যান। এর মধ্যে পরবর্তীতে কিছু কিছু সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হল বোমা মেরে তারই অতি প্রিয় নেতা, যার জীবন বাঁচানোর রক্ত শপথ তিনি নিয়েছিলেন, তথা হিটলারকে উড়িয়ে দেওয়া।
Heinrich himmler
১৯৩৯ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখ, বার্গার-ব্রকেলার নামক স্থানে, একটি বিয়ার হলে, হিটলারের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সে সময় হিটলার ছিলেন খুব উৎফুল্ল, কারণ ততদিনে পোল্যান্ড দখল সম্পন্ন হয়েছে। চার্চিল, রুজভেল্টকে একেবারে দেখিয়ে দেওয়া গেল।
চ্যান্সেলর হওয়ার পর থেকেই, হিটলারের নিরাপত্তার উপর মারাত্মক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কোন স্থানে হিটলারের বক্তৃতা দেওয়ার কথা থাকলে, কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সে জায়গায় কড়া নজরদাড়ি রাখা হত। নিয়মিত সবকিছু খুঁতিয়ে দেখা হত। বার্গার-ব্রকেলারের সেই বিয়ার হলটিতেও এরকম কড়া নিরাপত্তা রাখা হয়।
কিন্তু এত কিছুর পরও, জর্জ এলসার(georg elsar) নামে একজন লোক গার্ডের দৃষ্টি এড়িয়ে বিয়ার হলে ঢুকে যেতে সক্ষম হন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রী ও দক্ষ ইলেকট্রিসিয়ান। কমিউনিস্ট হিসেবে কয়েক বছর তার জেল খাটার রেকর্ড ছিল।
হিটলারের বক্তৃতা দেওয়ার দু মাস আগে থেকে এলসার একই পদ্ধতিতে সিকিউরিটির লোকদের ফাঁকি দিয়ে হলের ভিতর ঢুকে যেত। হিটলারের বক্তৃতা দেওয়ার স্থানে একটি বড় আকারের পিলার ছিল। প্রতি রাতে, সে এসে পিলারে গায়ে, একটি ছোট খুপরি তৈরি করার কাজে লেগে পড়ত। এলসারের একটাই ভয় ছিল। যদি কেও সকালে এসে সেই খুপরিটা দেখে ফেলে? যদিও সে খুপরিটি ঢেকে দিয়ে যায়, কিন্তু ভালভাবে খুজলে খুপরিটি পেতে কারো সমস্যা হবার কথা না।
হিটলারের বক্তৃতা দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে, তার খুপরির কাজ, কোন ধরণের ঝামেলা ছাড়াই শেষ হয়ে যায়। খুপরিটি তৈরি করা শেষ হলে, সেখানে সে একটি টাইম বম্ব রাখে। টাইম বম্বটি এমন ভাবে তৈরি ছিল যে তা এক সপ্তাহ পর ঠিক রাত ৯টা ২০মিনিটে(হিটলারের বক্তৃতা শুরু হওয়ার কথা ছিল রাত ৯টায়) ফাটবে। এভাবে একটি অতি সেরা পরিকল্পনা করে, সন্তুষ্ট এলসার, সুইটজারল্যান্ড পালিয়ে যাওয়ার জন্যে রওনা হন।
১৯৩৯ সাল, ৮ নভেম্বর।
বক্তৃতা দেওয়ার দিন।
কথা ছিল হিটলার রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বক্তৃতা দিবেন। এরপর তার বিশেষ ট্রেন তাকে পুনরায় মিউনিখ নিয়ে যাবে।
কিন্তু হিটলার বাংলাদেশের মন্ত্রীদের মত আমুদে ছিলেন না। তিনি জানতেন তার ট্রেনের কারণে পাবলিক ট্রেন সার্ভিসে বিঘ্ন ঘটবে। এই কারণে পাবলিক ট্রেন সার্ভিসের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে, তিনি বক্তৃতা দেওয়ার সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে আনেন। অর্থাৎ বক্তৃতা শুরু হবে রাত ৮টায়!!!!!!
রাত ৮টায় হিটলারের বক্তৃতা শুরু হয়। সেখানে heinrich himmler সহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক নাৎসি ও সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বক্তৃতায় হিটলার তীব্র ভাষায় ব্রিটেনের বিশদ্গার করেন। তিনি বলেন যে ব্রিটেনের সাথে জার্মানির কোন বিরোধ ছিল না। তারা কেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল? ব্রিটেনকে ইউরোপের অভিভাবক সাজতে কে বলেছে? কই, তারা তো প্রায় অর্ধ পৃথিবী জয় করে বসে আছে। আমরা কি তাদের ব্যপারে নাক গলিয়েছি?............
হিটলার যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন তার পাশে অবস্থিত একটি বিশাল পিলারের ভিতরে একটি শক্তিশালী বোমা নীরবে টিকটিক করে যাচ্ছিল।
কিন্তু, এবারো হিটলার বেঁচে যান। ঠিক ৯টা ৭ মিনিটে তিনি বক্তৃতা শেষ করে ট্রেন ধরার জন্যে ছুট লাগান। ৯টা ১৭ তে ট্রেন ছাড়ে। আর ঠিক তিন মিনিট পর বোমাটি ফাটে।
ট্রেনে হিটলারের সাথে ছিল তার প্রেমিকা এভা ব্রাউন, তার অতি বিশ্বস্ত প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার ডক্টর জোসেফ গোয়েবল্স্ এবং আরও অনেকে। মিউনিখগামী ট্রেনটি নূরেম্বার্গ ষ্টেশনে পৌঁছালে, গোয়েবল্স্ ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশন মাস্টারের অফিসে যান, সিকিউরিটির নিয়মিত ডিসপ্যাচ(আপডেট) জানার জন্যে। সেখানে প্রথম তিনি বোমা হামলার খবরটি জানতে পারেন। স্তব্ধ গোয়েবল্স্ দ্রুত ট্রেনে ফিরে গিয়ে হিটলারকে খবরটি দেন। খবরটি শুনে হিটলারও তাজ্জব বনে যান।
বোমা হামলার ফলে ৮ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়।
হিটলার এই ভয়ানক বোমা হামলার দ্রুত ও কার্যকরী তদন্তের নির্দেশ দেন। এর ফলস্বরূপ দুজন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের লোককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তারা ছিলেন নির্দোষ। তাদেরকে ভয়ানকভাবে জেরা করেও কোন তত্থ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু প্রোপাগ্যান্ডা মিনিস্টার ডঃ জোসেফ গোয়েবল্স্, নির্দোষ ব্রিটিশ এজেন্টদের গ্রেফতারের ঘটনার পূর্ণ সুবিধা নেন। গণমাধ্যমে এই খবর প্রচার করা হয় যে ব্রিটিশরাই এই বোমা হামলা ঘটিয়েছে। তারা হিটলারকে হত্যা করতে চায়। এতে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যারা যারা ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারাও মত পালটে ফেলে। চমৎকার প্রোপাগ্যান্ডা।
অন্য দিকে গেস্টাপোর অপর একটি দল এলসারকে সুইটজারল্যান্ড যাওয়ার পথে গ্রেফতার করে। তীব্র জিজ্ঞাসাবাদের পর সে বোমা হামলার কথা স্বীকার করলেও তাঁর কাছ থেকে এই ঘটনার সাথে জড়িত অন্য কারও নাম জানা যায়নি।
বিতর্কঃ
অনেকে সন্দেহ করেন যে, এই বোমা হামলার ঘটনা ছিল সম্পুর্ণ সাজানো। হিটলার, হিমলার থেকে শুরু করে অনেকেই এই ঘটনার কথা আগে থেকে জানতেন। তাদের মতে, এই বোমা হামলা করে ব্রিটেনকে দায়ী করা হয়েছে আর স্পষ্টতই এটি করা হয়েছে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্যে। কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। অধিকাংশ ইতিহাসবিদই মনে করেন যে হিটলার এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, আর সামান্য প্রোপাগ্যান্ডার জন্যে এত বড় ঝুঁকি তিনি কখনই নিতেন না।
তাছাড়া স্বয়ং এলসার যুদ্ধের পরে স্বীকার করেন যে হিটলার এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।(এলসারকে গ্রেফতারের পর হত্যা না করে ডাখাউ কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে special prisoner হিসেবে আটক রাখা হয়, তিনি যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন।)
কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদ আছেন যারা মনে করেন যে, হিটলার না জানলেও, Heinrich Himmler, বোমা হামলার কথা জানতেন। তারা বলেন যে এলসারকে এই হামলার নির্দেশ স্বয়ং হিমলার দিয়েছিলেন। হিমলার ছিলেন প্রচন্ড উচ্চাকাঙ্খী। হিটলারকে সরিয়ে চ্যান্সেলর হওয়ার জন্যে তিনি এমনটি করতে পারেন।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, heinrich himmlerএর যখন মৃত্যু হয়, তাঁর সাথে অনেক অজানা, গোপন তথ্যেরও অপমৃত্যু ঘটে। এসব তথ্য সম্পর্কে জানতে পারলে, তাঁর এবং তাঁর কুখ্যাত ss বাহিনী সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যেত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখার লিঙ্কস্।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:৩১