১.
কেউ ওপরে উঠে যাচ্ছে দ্রুত
কেউ নেমে যাচ্ছে ক্রমাগত
ওরা রাষ্ট্রের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়
আমরা নেমে যাই তাদের ঠেলায়
মাঝের ব্যবধানটা বাড়তে থাকে
আর আমাদের নামেই ওরা
মিছিল হাঁকে!
চট্টগ্রাম মহানগরীতে ক্রমান্বয়ে বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে নগরীতে বস্তির সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। অথচ গত পাঁচ বছর আগেও এর সংখ্যা ছিল দশ থেকে পনেরো। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বস্তির সংখ্যা একশ’ হবে। দেশের উদ্বাস্তু মানুষ, যাদের মাথা গোজার কোথাও ঠাঁই নেই, হাতে কাজ নেই সেসব মানুষগুলো কাজের আশায় পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে চলে আসে। এখানে এসে কোনোমতো দিনমজুরি বা অন্যকোন কাজ জুটিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে জীবন নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বস্তিতে আশ্রয় নেয়। রেললাইনের তীর ঘেঁষে কোন প্রকার একটি ছাউনি তৈরি করে ঘিঞ্জির ভেতরে বসবাস করছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের কাছে ওয়াসারা পানি নেই, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। তারা কোন প্রকার অর্ধাহারে-অনাহারে বেঁচে থাকে। তাদের শিশু-সন্তানরা স্কুলে যায় না, ডাস্টবিনের আশপাশের খাবার কুড়িয়ে খায়, কাঁধে বস্তা ঝুলিয়ে কাগজ কুড়ায়। মহানগরীতে ভিক্ষুকের উৎপাতে কোথাও দাঁড়ানো যায় না এখন। রাস্তার মোড়ে যানজটে আটকে পড়েছেন এমন সময়ও পাশ থেকে দুই জন এসে ভিক্ষার জন্য হাত পেতে বসে। রাস্তার পাশে কিংবা কোন পার্কের কাছে কিছু একটা নিয়ে খাচ্ছেন, চারদিক থেকে ভিক্ষুক আর টোকাই এসে ঘিরে ধরে খাবারটি চাইবে। তাদের প্রায় সবার মুখেই একই সুর, ‘বাবা সারাদিন থেকে কিছুই খাইনি, আল্লাহর ওয়াস্তে সাহায্য করেন।’ কেউ কেউ এমন উৎপাত করে যে, তাদেরকে না দিয়ে খাবার কোন উপায় নেই। অনেকেই হাতের খাবারটি জোর করে কেড়েও নেয়। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। ক্ষুধার্ত মানুষের এই চিত্র মহানগরীর সর্বত্র।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাতের বেলায় চলাচল করার সময় দেখা যায়, রাস্তার ধারে, পার্কের পাশে, স্ট্রিট ডিভাইডারের ওপরে, দোকানপাটের সামনে খোলা আকাশের নিচে শত শত ‘ঘরহীন মানুষ’ ঘুমায়। মাথা গোঁজার ঠিকানাবিহীন এই উদ্বাস্তু নারী-পুরুষের মিছিল ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে-গত কয়েক বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারি (আমাকে প্রায়ই রাত বারোটার পর বাসায় ফিরতে হয় বলেই দেখা যায়)। বৃষ্টি হলে এই মানুষগুলো সারারাত ঘুমাতে পারে না। একরাতে বিস্ময়ের চোখে দেখেছি, দুইজন উদ্বাস্তু বৃষ্টির সময়ে স্ট্রিট ডিভাইডারের ওপরে পলিথিনে মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! ওপরের বর্ণনা দেয়া এই মানুষগুলোকে আমাদের সুশীল সমাজ আর এনজিওরা আদর (!) করে নাম দিয়েছে ‘দুস্থ মানুষ।’ এই মানুষগুলোও আমাদের এই স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। অথচ এখন রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাদেরকে ‘দুস্থ মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এরা একটি শ্রেণী, কেউ বস্তিবাসী আর কেউ উদ্বাস্তু বা দুস্থ।
এবার ওপরের অবস্থার উল্টো চিত্র দেখা যাক। ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া বস্তির বিপরীতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে হাইরাইজ ভবন এবং পরিচ্ছন্ন আবাসিক এলাকার সংখ্যাও বাড়ছে। ফ্ল্যাট বাড়িতে ভরে যাচ্ছে নগরীর প্রতিটি পরত। প্রপার্টিজ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো একের পর এক গড়ে তুলছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত অভিজাত হাইরাইজ ভবন। একটি ফ্ল্যাটের সর্বনিম্ন মূল্যও সত্তর থেকে আশি লাখ টাকা। আর নগরীতে ফ্ল্যাটের চাহিদা এতই বেড়েছে যে, গত কয়েক বছর ধরে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য প্রপার্টিজ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এখন প্রপার্টিজ কোম্পানির সংখ্যাও অর্ধশত ছাড়িয়েছে। চলছে উঁচু ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা। এসব অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়ি এবং আবাসিক এলাকায় আয়েশী জীবন-যাপন করছেন এক শ্রেণীর মানুষ। তাদের ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা আবাসিক এলাকায় ওয়াসার পানির অভাব নেই, গ্যাস-বিদ্যুতের কোন সমস্যা নেই, পিডিবির লাইন চলে গেলে তারা আইপিএস জ্বালান। টাকার মাধ্যমে তারা সবকিছুই হাতের নাগালে নিয়ে রেখেছেন। তারা প্রাইভেট গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে খান, ইংলিশ মিডিয়ামে ছেলে মেয়েদের পড়ান। এরা উঁচু শ্রেণীর মানুষ, আমাদের সুশীল সমাজ। এইতো দ্বৈত জীবন, দিন দিন দ্বৈত জীবনে ডুবে যাচ্ছি আমরা।
২.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’-এ কথাগুলো গত ৩৮ বছর ধরে সংবিধানের প্রস্তাবনায় কেবল অক্ষর হয়েই পড়ে আছে। বাস্তবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের নাগরিকরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত এখন। একটি শ্রেণী সাঁই সাঁই করে ওপরে উঠে যাচ্ছে, তারা ওপর তলার বাসিন্দা হচ্ছে। আরেকটি শ্রেণী তাদের ঠেলায় নিচে নেমে যাচ্ছে ক্রমাগত, তারা বস্তিবাসী হচ্ছে। মাঝের ব্যবধানটি কেবল বাড়তেই আছে। আর এ ব্যবধানটি তৈরি করে দিচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্রই, শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবেই, রাষ্ট্রের সহায়তায়ই! প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে? তাহলে সাম্প্রতিক উদাহরণটিই দেয়া যাক।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ, সরকারি পদের সংখ্যা ১২ লাখ। এই বারো লাখের মধ্যে প্রায় দুই লাখ পদ খালি, তাহলে চাকরি করছেন ১০ লাখ মানুষ। নতুন পে-স্কেলে এই দশ লাখ মানুষের বেতন সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ‘সরকারি কর্মচারীরা কাজ করেন না, সবচেয়ে বেশিই ফাঁকি দেন, তারা দুর্নীতিতে ডুবে আছে’ এ রকম কত শত অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। শুধু অভিযোগ নয়, বাস্তব প্রমাণও আছে। ওই অভিযোগগুলোর প্রতিফলনই হচ্ছে, অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান অলাভজনক, তাদের রয়েছে ক্রমাগত লোকসানের চিত্র। অথচ এই মানুষগুলোর বেতন ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর নতুন পে-স্কেলের অজুহাতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। মুদ্রাষ্ফীতির নতুন চাপ পড়েছে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর, যাদের আয় একটাকাও বাড়েনি তাদেরকে বাড়তি দামে পণ্যদ্রব্য কিনতে হচ্ছে। দেশের সরকারগুলো বছর বছর সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করে। আর এর চাপে দেশের যে ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ ছিল তারা নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন তাদের নতুন নাম ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’ শ্রেণী। এ কারণে নাগরিকদের জীবনমানে ব্যবধান বাড়ছে, দ্বৈত জীবনে ডুবে যাচ্ছি আমরা। অথচ এই সাধারণ মানুষগুলোর ‘স্বার্থরক্ষার’ ে াগান দিয়ে, মিছিল হাঁকিয়ে তাদের ভোটেই সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে।
৩.
আমাদের দেশটা গরিব। রাষ্ট্র গরিব বলেই নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে না-এ রকম কথাগুলো এক শ্রেণীর সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মুখ থেকে শোনা যায়। বস্তির মানুষগুলোর অমানবিক জীবনযাপন দেখে ভাবি, ‘আহা আমাদের দেশটা কত গরিব!’ দুর্বল অর্থনীতির কারণে রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলোর ব্যবস্থা করতে পারছে না এ কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রগুলো চোখে পড়লে কিংবা কিছু তথ্য জেনে আৎকে উঠতে হয়। এ দেশের অনেক মানুষ দু বেলা দু মুঠো খেতে পায় না এই তথ্য যেমন সত্য একইভাবে ‘চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত কয়েক বছর ধরে প্রাইভেট গাড়ি আমদানি বেড়েছে’, ‘গাড়ি আমদানি রেকর্ড ছাড়িয়েছে’ বন্দরে এত বেশি গাড়ি এসেছে যে তিল ধারনের ঠাঁই নেই-বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার শিরোনাম হওয়া এই তথ্যগুলোও সত্য। গাড়ির চাহিদা আছে বলেই আমদানি বেড়েছে, অর্থাৎ এ দেশে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের সক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ বেড়েছে। তারা বিলাসী মানুষ, তাদের বিলাসিতা দেখে ভাবতে বাধ্য করে এদেশ কি আসলেই গরিব, এ দেশের অর্থনীতি কি আসলেই দুর্বল?
একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই, চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজারে গত ১৩ নভেম্বর একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করা হয়েছে। কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন বা কেএফসি নামক ওই রেস্টুরেন্টে বিশেষ ধরনের মুরগির রোস্ট এবং ফাস্টফুড বিক্রি হয়। এই রেস্টুরেন্টের সর্বনিম্ন একটি বার্গারের দাম ১৭০ টাকা। যেদিন এটি উদ্বোধন করা হয় সেদিন সন্ধ্যায় লালখান বাজার এলাকা ও এর আশপাশের সড়কগুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। শত শত প্রাইভেট গাড়িতে করে ভোজনরসিকরা ভিড় করেছে ওই রেস্টুরেন্টে! ট্রাফিক পুলিশ যানজট সামলাতে হিমশিম খেয়েছে ওইদিন সন্ধ্যায়। এই রেস্টুরেন্টে দুইজন মিলে একবার নাস্তা করলেও হাজার টাকা বিল আসবে। আর ওই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য আসা মানুষের গাড়িতে যখন এলাকাজুড়ে যানজট তৈরি হয় তখন কি প্রশ্ন আসতে পারে না এই দেশ কি গরিব? না, আমাদের দেশটা মোটেও গরিব নয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থায়-ই আমাদের মাঝে শ্রেণী বৈষম্য তৈরি করেছে, কেউ ‘বস্তিবাসী’ হচ্ছে কেউ ‘আবাসিকবাসী’ হচ্ছে! দ্বৈত জীবনে ডুবে যাচ্ছি আমরা।
৪.
দ্বৈত জীবন নিয়ে এই লেখার শেষ উদাহরণটি একটু অন্যরকম এবং ব্যক্তিগত। একই শিক্ষাবর্ষে এইচএসসি পাশ করেছিলাম আমি এবং বন্ধু ফোরকান। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজে অনার্সে ভর্তি হই আর আমার বন্ধু একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অনেক টাকার দরকার, আমার বাবার সেই টাকা নেই, ফোরকানের বাবার আছে। যাহোক, গত দুই বছর আগে আমার বন্ধুটি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে, আমি এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের কবলে আটকে আছি। আমার বন্ধুটি এখন ভালো একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে, টাকা আয় করছে. তার জীবনযাপন বদলে গেছে। আমি সেশনজটে আটকে আছি, কোনোমতো দিন কাটাচ্ছি। শুনেছি আমার বন্ধু দুই লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে ওই চাকরি পেয়েছে। আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারলেও ঘুষ দেয়ার সামর্থ্য আমার হবে না। সুতরাং ভালো কোন চাকরি পাব এর কোন নিশ্চয়তাও নেই। জীবনটা হয়তো ওই বন্ধুর কাছাকাছি আর যাবে না। অথচ পড়ালেখায় আমি ওই বন্ধুদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম না। এই উদাহরণ কেবল আমার একার নয়, আমাদের চারপাশের আরো অনেকের জীবনের। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও আমাদের দ্বৈত জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা দ্বৈত জীবনে ডুবে যাচ্ছি।