গায়ের কাদামাটিতে হেসে খেলে মানুষ হলেও মনটা কখনও মাটির মত ছিল কিনা মনে হয়নি।লেখাপড়ার জন্য মনের মাঝে বাল্যকাল থেকেই একটা অন্যরকম টান ছিল।কিন্তু আমার এ টান বাবা কখনই ভাল চোখে দেখতেন না।মা যদিও বর্নমালার পাতার রঙ্গিন ছবিগুলো দেখেছেন কিনা জানিনা তবুও বাবার চোখ এড়িয়ে আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিতেন।টানাটানির সংসার না হলেও পাড়ার মানুষ দিয়ে কাজ করাবেন আর নিজের ছেলে লাটসাহেবের মত স্কুলে যাবে বাবা এটা মোটেও পছন্দ করতেন না।এ নিয়ে মায়ের সাথে বাবার খুনসুটি লেগেই থাকত।তাই মাই ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়।ছোটখাট আবদারগুলো মায়ের কাছেই আদায় করে নিতাম।মায়ের স্নেহমাখা কাজের মাঝে বাবার প্রয়োজনটা অনেকটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল।সংসারের সবচেয়ে গুরত্বপুর্ন কাজ করলেও নিজ পরিবারের কাছে তার গুরত্ব কখনো ছিল কিনা বাবা বেচে থাকতে তা বুঝতে কষ্ট হত।
সময়ের বিশ্রামহীন পথচলায় আজ আমি ৩ সন্তানের বাবা।সরকারী চাকুরী নিয়ে পাড়ি জমাই প্রবাসে।সন্তানদের বুদ্ধি হওয়ার আগেই তাদের ভবিডষ্যত গড়ার স্বপ্নে পাড়ি জমাই দেশ থেকে।বিদেশ বিভুইয়ে শত কষ্টের মাঝেও সুখ খুজে পেতাম আমার অবুঝ শিশুদের মায়ামাখা মুখগুলো চিন্তা করে।দেশে ফেলে আসা নিস্পাপ সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহ প্রতিনিয়ত প্রেরনা যোগাত আরো বেশী কষ্ট করার।এমন অনেক হয়েছে যে ,মাস শেষ কিন্তু বেতন পাইনি।ধার করে ,নিজের খাওয়া খরচটাও পাঠিয়ে দিতাম দেশে।নিজ বাবার মন কখনও বুঝতে না পারলেও তখন বুঝতাম বাবার ভালবাসা কতটা গভীর।দীর্ঘ ১৫ টি বছর কাটিয়ে দিলাম দেশের বাইরে ।নিজ পরিবার থেকে বহু দুরে,আপনজনহীন দুর্গম প্রান্তরে কেবল মাত্র সন্তানদের সুন্দর জীবন গড়ে তোলার জন্য।জীবনের ঘানি টানতে টানতে কখন যে যৌবন ফুরিয়ে শরীরের ভাজে বার্ধক্য বাসা বেধেছে তা টেরই পাইনি।চামড়ার ভাজগুলো কখনো আয়নার দেখার ফুরসত হয়নি।একদিন ডাক্তারের আজব অদৃশ্য রশ্নিতে ধরা পড়ল শিরদাড়ার হাড়ে পচন ধরেছে।ক্ষ্ য়ে যাচ্ছে দীর্ঘ দিনের বোঝা বাহী হাড়্গুলো।বাধ্যহয়ে ফিরে আসতে হল দেশে।নিজ পরিবারের কাছে ,সন্তানদের কাছে একান্ত বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছি তা ভেবে কষ্টের চেয়ে মনের মাঝে আনন্দের অনুভুতিটাই বেশী করে নাড়া দিচ্ছিল।
দেশে ফিরে শুরুতেই ধাক্কা খেলাম আমার মনের গহীনে আকা ছবির সাথে সবকিছুর গড়মিল দেখে।নিস্পাপ চেহারার আধো আধো বুলিতে বাবা ডাকা সন্তানদের উচ্চতা আমার চেয়েও বেশী।তাদের এ প্রাপ্ত বয়স্ক চেহারা আর পুর্ন কন্ঠের বাবা ডাকে আমার বিদেশ বিভুইয়ে প্রেরনাদায়ী সন্তানদের ছবি কেমন যেন কষ্টের শীতল পরশ বইয়ে দিচ্ছিল মনে।নিজের বয়সের দিকে এতদিন নজর দেয়ার সুজোগ না পেলেও স্ত্রীর কাচা পাকা চুল দেখে বুঝতে দেরী হলনা মানব জীবনের সুখের যৌবন নিসংগ হারিয়ে এসেছি প্রবাসের পথে প্রান্তরে।যাইহোক নিজ কে সান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম এই বলে ,আমি যাদের জন্য সব বিসর্জন দিলাম সেই সন্তানরা তো আজ বড় হয়েছে।তাদের ভালবাসার মাঝেই কাটিয়ে দিব বাকী জীবন,হারানো আনন্দ গুলো ফিরিয়ে নিব সন্তানদের ভালবাসা আর সম্মানের মধ্য দিয়ে।
আমার সেই কল্পনার স্বর্গরাজ্যের সবগুলো সুখপ্রাচীর উড়িয়ে নিতে লাগল অকল্পনীয় কিছু ঝড়।কিছুদিন যেতেই বুঝতে পারলাম আমার ভালবাসা পুর্ন সরব উপস্থিতির চেয়ে সন্তান্দের কাছে রিয়ালের চেকের মাঝে লেখা নামসর্বস্ব বাবাই বেশী প্রিয় ছিল।নিঃস্ব ,জীর্ন ,ভালবাসাকাংখী এ বাবার পাশে বসে একটি মিনিট নষ্ট করাটাও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে বাধা মনে হত।আমার উপস্থিতি তাদের আনন্দমুখর আড্ডাগুলোকে নিমিষেই চুপসে দিত।দীর্ঘদিন মানের মাঝে একে রাখা সন্তানদের কিছুতেই আপন করে পাইনি।দীর্ঘদিন ধরে জমানো কিছু টাকা ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব তাদের কাছে আছে বলে মনে হয় না।তাদের সকল সুখ দুঃখের অনুভুতিতে মায়ের স্থান হলেও আমি ছিলাম নিতান্তই অবান্সিত একজন।নিজের রক্ত পানি করে গড়ে তোলা পরিবারে আমার নিজের কোন স্থান আমি খুজে পাচ্ছিলাম না।নিজেকে বড় অসহায় মনে হত।ভাবতাম হায় এরচেয়ে কল্পনা নিয়ে বেচে থাকা প্রবাস জীবনের না খেয়ে রাতদিন খাটনিও অনেক ভালছিল।অনেক দিনের গড়ে তোলা সুখের পরিবারের যে ছবি মনের ফ্রেমে বাধাই করে রেখেছিলাম তা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল।
বছর খানিক যেতে যেতে আমার ভংগুর হাড়ের চিকিৎসায় ফুরিয়ে গেল হাতের জমানো সব টাকা।আমার নিরস যৌবনহীন দেহের ভার বইতে না পেরে আমার একমাত্র ভালবাসা প্রাপ্তির স্থল স্ত্রীও চলে গেল পরপারে।সন্তানরা এখন পুর্নবয়স্ক ,বিবাহিত।বিবেকের তাড়নায় না হলেও সমাজের শিকলে বাধা পেয়ে তারা এখনও মুল্যহীন এ বাবার পিছনে কিছু টাকা নষ্ট করে বলেই এখন হুইল চেয়ারে বসে নিঃশ্বাস নিতে পারি।জানিনা কতদিন তাদের কে এ কষ্ট সইতে হবে??
আজ আমি বুঝতে পার আমার বাবার অনুভুতিগুলো।। এভাবেই কি তবে সব বাবারাই জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ভালবাসাহীন ,বেদনাময় অন্তর নিয়ে জীবনের সময়টুকু পাড় করে দেয়?আমার এ লেখা কোন সন্তানের বিবেক কে নাড়া দিবে সে উদ্দেশ্যে নয়,কেবল কোন বাবা যেন তার রক্ত পানি করে পরিশ্রমের বিনিময়ে শেষ জীবনে কোন এক সুখের সংসারে স্ত্রী সন্তানদের ভালবাসায় মাখা সময়ের কল্পছবি মনের কোনে না আকেন তার জন্য।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




