somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোয়াখালীর গালি

২২ শে মে, ২০১২ রাত ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ: নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি দেশ এবং দেশের গন্ডির বাইরেও ভিন্ন মাত্রায় পরিচিত, সমাদৃত। এ অঞ্চলের মানুষদের ব্যাবহৃত গালিগালাজগুলো এখানকার লোকবিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদির ইঙ্গিত বহন করে। আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যময়তায় ভরা ব্যাবহৃত শব্দগুলো কখনো কখনো একই শব্দের যেমন একাধিক প্রতিশব্দ হয়েছে। অঞ্চলভেদে সেগুলোর বাচনভঙ্গিও নানান ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

এসব কথায় গমক, অনুপ্রাস এবং ব্যবহার শব্দ-প্রক্ষেপণকে যেমন পরিপুষ্ট করে তোলে অন্যদিকে এর অন্তর্নিহিত নিনাদকে বাঙময় করে তোলে। তবে গালি গালাজের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত অশ্লিলতার যোগ থাকাতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভিতরেই এর প্রচলন বেশি দেখা যায়।

আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতজনের ভাষাকে শিষ্টাচার বর্জিত মনে হলেও, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে দৃঢ় অথচ ঋজু ভঙ্গিতে এই গালিগুলো পারস্পরিক কথনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এখানে খুব লক্ষ্ণণীয় বিষয় যে, প্রাচীন কাল থেকে এ অঞ্চলে আরবী, ইংরেজি, অসমীয়, মারাঠী,বর্মী, হিন্দি উর্দূ ইত্যাদি ভাষাভাষি মানুষের অগমনের ফলে স্থানীয় ভাষার সাথে অনেক বিদেশী গালীও মিশে অন্য রকম এক ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে।

পারস্পরিক কথন : ‘এ্য্যাঁ হেতে লাগে যে হ্যাড়ম জাহাজের কচ্ছপ।’
অর্থাৎ- এখানে আক্রমিত ব্যক্তিকে অবজ্ঞাস্বরূপ বড় পদের লোকহিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
শ্বাশড়ি বউকে: ‘এরে হইন্নির ঝি, ইয়ানে তোর তালুকদারী আছে নি।’
অর্থাৎ- শাশুড়ি বউকে এখানে ভিখারিনীর কন্যা বলে অভিহিত করে।
বেয়াইন-বেয়াইনকে: ‘হতিনের ঘরের মিতাইন, তোর মুরত আঁর জানা আছে।’
অর্থাৎ- সতীনের ঘরের মিতাইন তোমার ড়্গমতা আমার জানা আছে।
সামাজিক ঝগড়ার সূত্রে: ‘অডা জিয়ানতুন আইছত এ্যাককারে হিয়ানে হাড়াই দিয়ুম।’
কিংবা ‘অডা ………জিয়ানতুন হইছত, এককারে হিয়নদি ঠেলি ভরি দিয়ুম।’
অর্থাৎ- জন্মের স্থানে পৌঁছিয়ে দেব।
খবরদারী অর্থে: ‘হালুকেলা হাইছত? বাদাইমমার ঘরের বাদাইমমা।’
অর্থাৎ- বেকারকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, তমি কি এখানে মাগনা খাবার পেয়েছ?
পিতা-পুত্রকে: ‘হইন্নির হুত, হুডানী করিচ্চা, মার হাউয়াত বাল আছে নি?’
অর্থাৎ- ভিখারীনির ছেলে, সৌখিনতা করোনা, তোমার মায়ের কোন সঞ্চয় আছে?
নারী পরস্পর: ‘চোদানী ধরি এক্কারে চাঁড়া বাঙ্গি দিয়ুম।’
অর্থাৎ- লজ্জাহীন, তোমার শক্তি ভেঙ্গে দেব।
শ্বশুর বাউ: ‘বেলিকের বাচ্চা বেলিক, আক্কল তবিয়ত কি উডি গেছেনি তোর?’
অর্থাৎ- বেয়াদবের মেয়ে, তোমার কি আক্কেল সালাম উঠে গেছে? কিংবা তোমার কি শ্রদ্ধাবোধ নেই?
শিক্ষক ছাত্রকে: ‘কীয়ারে অড়া, হড়া লেয়া কি তোর টঙ্গো উটছেনি।’
অথবা ‘কীরে অডা, হড়ালেয়া কি তোর গাছের আগাত উঠছেনি।’
অথবা ‘কীরে অডা, হড়ালেয়া কি তোর কাঁড়ে উঠছেনি!’

অর্থাৎ- কী ছেলে তোমার পড়ালেখার কি গাছের মাচায় উঠলো? এখানে দুর্বল ছাত্রটির পড়ালেখার সমাপ্তির বিষয়টি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছে।
বন্ধু-বন্ধুকে: ‘দুই হইসার মুরত নাই, হেতে লাগে জ্ঞান ছেঙের চোদরী।’
অর্থাৎ- দু পয়সা নেই অথচ মনে হয় হাবভাবে বড় কোনো মানুষ।
স্বামী-স্ত্রীকে: প্রবাদ অর্থে ‘মার কোলে নাই কয়ত, ঝির লাগে যে কত মুরদ।’
অর্থাৎ- মায়ের যেখানে কোন শক্তি নেই, সেখানে মেয়ের আছে অনেক লোকবল।
ভগ্নিপতি শালাকে: ‘হঁদির হুত থঁদি, ইয়ানে ব্যাক কিছু মোক্ত হাইছত নি?’
কিংবা ‘সমন্দির ঘরের সমন্দি, মোক্ত … দেয়াই দিয়ুম।’
অর্থাৎ- উপরোক্ত সমূহে ‘শালার পুত শালা’ সম্বোধন করে আলস্নার ওয়াস্তে না খাওয়ার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
উদাহারণ অর্থে: ‘এই বাল আঁর দেআ আছে।’
অর্থাৎ- তোমার শক্তি/সামর্থ্য আমার দেখা আছে।
ঠিকানা অর্থে: ‘মাথার উরপে নাই চাল, হইন্নির হুত দ্যায় হাল।’
অর্থাৎ- যার মাথার উপর কান ছাদ কিংবা আশ্রয় নেই, সে কী না ভিখারীর ছে।ে অথচ সে লাফালাফি বা তড়পায়।
রাগ প্রকাশে: ‘মাগির হুত মাইগ্যা, হাল দেসকা আইজ্যা।’
অর্থাৎ- বেশ্যার ছেলে যেখানে নিজের আয়ে খাবার বন্দোবসত্ম নেই অথচ সেখানে সে শক্তি বা ড়্গমতা প্রদর্শন করছ আজ।
সতীন সতীনকে: ‘হাঙ্গুডির ঘরের হাঙ্গুডি, ভরি দিয়ুম বড়বড়ি।’
অর্থাৎ- সতীনের মেয়ে সতীন, তোমকে ইচত শিড়্গা দেব।
মা মেয়েকে : ‘ছিনাইলের ঘরের ছিনাইল, কাজ কাম বা্যাক হড়ি রইছে ব্যানাইল।’
অর্থাৎ- প্রতারকের ঘরের প্রতারক মেয়ে, কাজকর্ম সব এলোমেলো পড়ে আছে।
একে অন্যকে ধমক অর্থে: ‘হেড়া-আলির হুত, ধরি হাউয়া বাঙ্গি দিয়ুম।’
অর্থাৎ- নির্লজ্জ মায়ের ছেলে তোমার বাসা ভেঙে দেব।তোমাকে উচিৎ শিক্ষা দিব।
ভাই-ভাইকে: ‘হালার হুত হালা, বালা চাসতো আঁর মুয়ুততুন হিরি যা।’
অর্থাৎ- শালার ছেলে শালা, ভালই ভাল আমার সামনে থেকে সরে যাও। এখঅনে ড়্গোভ বশত বাবাকে শালা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
স্ত্রীকে হুমকি অর্থে: ‘হেড়ালীর ঝি হেড়ালী, আঁর লগে করচ বিড়ালী।’
অর্থাৎ- তুমিও তো তোমার মায়ের মতো আমার সঙ্গে প্রতারণা কর? এখানে ‘হেড়ালী’ বলতে শ্বাশুড়ীকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মালিক চাকরকে: ‘এরে চোদাইন্নার হোলা, হাটকি বাজি করচ কা?’
অর্থাৎ- কীরে বেয়াদবের ছেলে, ফাঁকিবাজি কর কেন?
দোকানী খদ্দেরকে: ‘হইসা নাই হকেটে ব্যাড়ার, নয়াবী দেয়ায় দোয়ানে আঁর।’
অর্থাৎ- পকেটে পয়সা নেই অথচ লোকটি নবাবের মত আরচণ দেখায়।
সামাজিক ঝগড়ার সূত্রে: পুরম্ন েষর প্রতি পুরম্নস-‘চোদানীর হুত যিয়ানদি অইচত হিয়ানদি ঠেলি বরি দিয়ুম।’
অর্থাৎ- নির্লজ্জ মায়ের ছেলে, যেখান দিয়ে জন্ম নিয়েছো সেস’ান দিয়ে ঠেলে প্রবেশ করিয়ে দেব।
ননদ-ননদী: ভাবিকে‘খানকির ঝি খানকি হাজি লই যাই হিরা করগই।’
অর্থাৎ- বেশরমের মেয়ে, টুকরি নিয়ে ভিড়্গা করে এসো।
মোড়ল: জনৈক গ্রামবাসীকে-‘ঘাঠুত নাই হেতার টাট্টিখোলা হেতে আইচে ইয়ানে মাতবরী কইততো।’
অর্থাৎ- যার বাড়িতে ঠিকমতো ভালো পায়খানা নাই, সে এসেছে মোড়লগিরি করতে।
চোরকে উদ্দেশ্য করে: ‘তুই অইচত অইচত, কয়ন্নারগার মারেও চুদি।’
অর্থাৎ- তোমার জন্ম হওয়ার কতা যে বলেছে, তার মায়েরও সম্ভ্রমহানি করি।
কিংবা: ‘ঐ খানকির পোলা তোর চোরের মারেও চুদি।’
অর্থাৎ- ঐ বেয়াদপ নারীর ছেলে, তোমার চোরের মায়ের লজ্জা হরণ করি।
মৌলভী/ইমামকে উদ্দেশ্য করে: ‘তুঁই কিয়ের ইমাম অইচ? তুঁইত হোলা হোন্দাইন্না ইমাম।’
অর্থাৎ- তুমি কিসের ইমাম? তুমিতো ছেলের সঙ্গে সমকাম কর।
নাপিতকে উদ্দেশ্য করে: ‘কীরে অড়া, হারা জীবন তো নপতামি কইলস্না, অন এককানা টাল্টিবাল্টি কম করনা।’
অর্থাৎ- কিরে ব্যাটা, সারাজীবন তো নাপিতের কাজ করেছ, এখন একটু ফাতরামি কম করনা।
মাঝিকে উদ্দেশ্য করে: ‘অহন দাঁ ধরতি জানছ নাই বাড়া কী বালের মাঝি হইছত, ঠেঁয়া ঠেঁয়া করছ লাত্তি মারি দৈজ্জার বিতরে হালাই দিয়ুম।’
অর্থাৎ- এখনো ঠিকমতো বৈঠা ধরতে জানো না বেটা, কী লোমের মাঝি হয়েছ? শুধু টাকা টাকা কর, একেবারে লাথি মেরে দরিয়ায় ফেলে দেব।
কামারকে উদ্দেশ্য করে: ‘এই মাগির হুত কী কাম কইচ্চত? এইডা এককান দা অইছে! ধর তোর দা, তোর মার শাউয়ার বিতরে বরি দিয়ুম।’
অর্থাৎ- ঐ বেশ্যার ছেলে কী কাজ করেছো? দা খানা ঠিকমতো তৈরি হয়েছে? ধর তোমার দা, তোমার মায়ের লজ্জাস’ানে ভরে দেব।
মুদি দোকানীকে: ‘অডা, বাইন্নার গরের বাইন্না, হিসাবের খাতায় ব্যসকম কইরছ কা।’
অর্থাৎ- কীরে বনিকের ঘরের বণিক, হিসেবের খাতায় গরমিল হলো কেন?

শব্দার্থ-টীকা:
এ্যাঁ- হ্যাঁ, হ্যাড়ম-যৌনাঙ্গ মতানত্মরে শক্তি/ড়্গমতা কিংবা ড়্গেত্র বিশেষে অপব্যবহার, হইন্নির ঝি- ভিখারীনির মেয়ে, হতিন- সতীন, মিতাইন-মিতা/বন্ধু-বান্ধবী, মুরত-শক্তি, মুরদ-পুরম্নষত্ব, যিয়ানতুন- যেখান থেকে, অড়া- বিশ্রী সম্বোধন, হিয়ানতুন- সেখান থেকে। হালুকেলা- সসত্মাকলা, বাদাইম্মা-বেজন্মা, হুডানী- গর্ব/অহংকার করা। হাউয়া- নারীর যৌনাঙ্গ, বেলিক-বেয়াদপ, আক্কল-জ্ঞান, তরিয়ত-শ্রদ্ধা, হোয়ালেকা- পড়ালেখা।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
ইমেইল: [email protected]
৩৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×