আতাহার মিয়া আমাদের অফিসের পিওন। ছোটখাট মানুষ, থুতনির নীচে সামান্য একগোছা দাঁড়ি আর তেল চপচপে কাঁচা-পাকা চুল ছাড়া তার আর কোন বৈশিষ্ঠ্য আমার চোখে পড়েনি কখনো। রোজ সাড়ে নয়টায় আমার টেবিলে এক কাপ চা দিয়ে উচ্চস্বরে আমাকে সালাম দেয়। আমি খবরের কাগজের পাতা থেকে চোখ না তুলেই বলি, খবর ভালো আতাহার মিয়া? আতাহার মিয়াও প্রতিদিন একই উত্তর দেয়, আল্লাহ রাখছে। তারপর সে পাশের টেবিলের আলী সাহেবকে চা দিতে এগিয়ে যায়; এরপর বেনু ম্যাডামের টেবিলে এবং এক সময় হারিয়ে যায় টেবিল-চেয়ারের জঙ্গলে।
আমি চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দেই, ইচ্ছে করে দীর্ঘায়ু দেই এক কাপ চায়ের। আলী সাহেব, যিনি সারাক্ষণ জগতের নানান দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত এবং বা কানের লতির পেছন দিকটা চুলকাতে ব্যস্ত- তিনি প্রতিদিনের মতো জিজ্ঞেস করেন, প্রত্রিকায় বিশেষ কোন খবর আছে কিনা! আমি যথারীতি রসিকতা করে বলি, রুমকি বৃত্তি পেয়েছে; খোকন সোনার জন্মদিনে তার দাদা-দাদী দোয়া চেয়েছে- এ দু'টোই বিশেষ খবর বলে মনে হলো; বাকি সংবাদগুলো গতকাল কিংবা পরশু'র মতোই। এরপর আমি পত্রিকাটা আলী সাহেবের টেবিলের দিকে ঠেলে দিয়ে বলি, পড়ুন। আলী সাহেব পত্রিকাটা হাতে নিতে নিতে বলেন, আর ভালো লাগেনা ভাই। ওপাশের টেবিল থেকে বেনু ম্যাডাম বলে ওঠেন, আলী সাহেব, সবই বয়সের দোষ। আমরা তিনজনে অফিসে প্রাতঃকালীন গল্পে মনযোগী হই; আলী সাহেবের ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে ঠাট্টা করি- বলতে গেলে অফিসে এটি আমাদের প্রতিদিনের রুটিন।
আজ সকালে আমাদের রোজকার রুটিন গল্পে ছেদ পড়ল।
সকালে আতাহার মিয়া যথারীতি আমাকে উচ্চকণ্ঠে সালাম দিয়ে টেবিলে চা রেখে গেল। আমিও অভ্যাসবশত তার কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। আতাহার মিয়াও একই উত্তর দিল; তারপর আলী সাহেবের টেবিলে চা রাখতে রাখতে বলল, এমডি স্যার দেখা করতে বলেছেন। পাশের টেবিল থেকে বেনু ম্যাডাম ঠাট্টা করে বললেন, আলী সাহেব, এইবার আপনার প্রমোশন ঠেকায় কে! যতই ঠাট্টা হোক, আমি নিজের ভেতর ঈর্ষার কাঁটা টের পাই। প্রায় বছর দশেক আগে আমি আর আলী সাহেব এই অফিসে কাজে ঢুকেছি । দু'জন একই সাথে জুনিয়র অফিসার পদ থেকে অফিসার হয়েছি। যে আমার পাশের টেবিলে বসে চা খায়, যার সাথে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরি- তার প্রমোশন, হোক না আমরা আলাদা ডিপার্টমেণ্টে কাজ করি, হোক না সে বেনু ম্যাডামের নিরিহ ঠাট্টা- আমাকে ঈর্ষান্বিত করে। আমি কিছু না বলে আলী সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাই, তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি- বেনু ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন। আলী সাহেব চা শেষ না করেই উঠে পড়েন।
আমি আলী সাহেবের ফিরে আসার অপেক্ষায় এক কাপ চায়ের আয়ু সুদীর্ঘতর করি। চা ঠাণ্ডা সরবত হয়ে তলানিতে ঠেকলে আলী সাহেব এমডি স্যারের রুম থেকে বের হয়ে আসেন। আমি আর বেনু ম্যাডাম আলী সাহেবের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমি ঠাট্টার সুরে বলি, আলী সাহেব, আতাহার মিয়ারে মিষ্টি আনতে পাঠাই? বেনু ম্যাডাম কি বুঝলেন জানিনা, বললেন, আলী সাহেব, সবকিছু ঠিক আছে তো! বেনু ম্যাডামের কথায় আমি হঠাৎ করেই বুঝে উঠি কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, এটা তামাশা করার সময় নয়। আমি চেয়ারটা আলী সাহেবের টেবিলের দিকে টেনে আনি। তারপর নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করি, কোন সমস্যা হয়েছে? আলী সাহেব আজকের পত্রিকার পাতায় কলম দিয়ে দাগ কাটেন, আঁকিবুকি করেন, উত্তর দেন না। এক সময় আতাহার মিয়া এসে জানিয়ে যায়, এমডি স্যার দেখা করতে বলেছেন আমাকে। আমি বেনু ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে, কিছু বুঝতে পারছিনা জাতীয় চেহারা করে এমডি স্যারের রুমের দিকে এগিয়ে যাই।
- স্লামিকুম স্যার; ডেকেছেন?
এমডি স্যার কী একটা ফাইল মনযোগ দিয়ে দেখছেন; সেটি থেকে চোখ না সরিয়ে আমি আতাহার মিয়াকে যেভাবে কুশল জিজ্ঞাসা করি, সে ভাবে আমাকে বললেন, খবর ভালো?
- জ্বী স্যার।
- পার্চেজটা কয়েকটা দিন দেখতে পারবেন, নতুন লোক না নেয়া পর্যন্ত?
- আলী সাহেব তো পার্চেজ দেখেন।
- কতদিন চেনেন তাকে?
- এই বছর দশেক; আমরা একই সাথে জয়েন করেছি স্যার।
- এ লোক তো মহা ধুরন্ধর!
- কি হয়েছে স্যার? আমাকে বলা যাবে?
- আমাদের অফিস সাল্পাইয়ারের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছে। গতমাসে টেণ্ডার হয়নি জানেনতো? আলী সাহেব সাপ্লাইয়ারকে বলেছেন, আগের রেটে মাল নেয়া নাকি সম্ভব না; সাপ্লাইয়ের কাজে টিকে থাকতে হলে টাকা-পয়সা ঢালতে হবে, এইসব আরকি!
- আলী সাহেব ঘুষ নিয়েছেন!
- তাও আবার মাত্র দেঢ় হাজার টাকা। এর আগে আর কি কি করেছে কে জানে! যাহোক, আমি এইসব চোর রাখব না অফিসে। আমি তাকে রিজাইন করতে বলেছি; আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সরাসরি বরখাস্ত করত।
গতমাসে আলী সাহেব আমার কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন; খুব নাকি টানাটানি যাচ্ছে তার। আমি ধার দিতে পারিনি; আমার নিজেরই টানাটানি! অফিস থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ী ফেরার প্রস্তাবটা মাস দু’য়েক আগে আলী সাহেবই আমাকে দিয়েছিলেন; আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম এই বলে, যাক, ব্যায়ামটা হয়ে যাবে। আলী সাহেব খুশি হয়ে বলেছিলেন, তা ঠিক। পথটা একটু বেশী, ঘণ্টা দেড়েক লাগে; তাতে কী! যত হাঁটা তত ব্যায়াম, কি বলেন? আমরা কেউই বলিনি- এভাবে এত অনটন নিয়ে চলা যায়না; অফিসে আসা যাওয়ার খরচ বাঁচলে ছেলেমেয়ের মুখে কিছু জুটবে। কয়েকদিন হলো বেনু ম্যাডামও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। আমাদের দেড় ঘণ্টার পথ দুই ঘণ্টায় ফুরোয় না এখন। তারপরও আমরা হাঁটি, জগৎ-সংসার, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গল্প করি; ভুলে থাকার চেষ্টা করি- এই শহরের এত বিশাল আয়োজনের মধ্যে আমরা কত তুচ্ছ; অথবা কত বিশাল আমাদের এই স্বাস্থ্য সচেতনতা!
- স্যার একটা কথা বলব? মানবিক দিক বিবেচনা করে কি আলী সাহেবের চাকুরিটা রাখা যায়? এই অসমেয়র বাজারে আরেকটা কাজ খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব তার জন্য!
এমডি স্যার আমাকে ছোট একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, আপনি হলে কি করতেন? আমি চুপ করে থাকি, এক সময় নিজের টেবিলে ফিরে আসি। পথে একাউণ্টস ডিপার্টমেণ্টের হাবিব সাহেব দেঁতেল হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, 'কথা সত্য নাকি?' আমি ঘাড় নাড়ি। হাবিব সাহেবের উৎসাহ বাড়ে, 'কথায় বলে না- চোরের দশদিন আর গেরস্তের- হা হা হা'। পরে কথা হবে বলে আমি নিজের ডেস্কে ফিরে আসি। বেনু ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন; আলী সাহেব শব্দ করে কেঁদে উঠেন, আমাকে বাঁচান ভাই।
অফিস শেষে সেদিন আমি আর বেনু ম্যাডাম হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। বেনু ম্যাডাম চাপা গলায় বার কয়েক বললেন, আলী সাহেবের মতো মানুষ! আমার বিশ্বাস হয় না! আমি চুপ করে থাকি। হঠাৎ সিগারেটের তেষ্টা পায়। মাস খানেক হলো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি; আলী সাহেবের পরামর্শেই। ব্যায়াম আর ধূমপান নাকি এক সাথে চলেনা। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলেছি, বাড়তি খরচ। আলী সাহেব ধূমপান বিরোধী বক্তব্য শেষ করে বলেছিলেন, ভাবছি টেলেভিশনটা বেঁচে দেব, ছেলেমেয়ের পড়ালেখা নষ্ট করে।
- বুঝলেন, ছাত্রজীবন অধ্যাবসায়ের, টেলিভিশন দেখার না। ওরা বাচ্চা মানুষ এসবের কি বুঝবে বলুন!
- তা ঠিক।
- কথাটা শুনে বড় মেয়েটা একটু কান্নাকাঁটি করেছে, তা করুক। যদিও ইংরেজী খবরটা শুনলে বাচ্চাদের ইংরেজীটা ভালো হত! পাশের বাসায় মাঝে মধ্যে খবরটা দেখলেই হবে, কি বলেন?
মাস তিনেক হলো আমার টেলিভিশন সেটটি বিক্রি করে দিয়েছি। বাচ্চারা কান্নাকাটি করেছে কয়েকদিন। মোবাইল ফোনটিও অচল হয়ে আছে বেশ কিছুদিন। আমার স্ত্রী মুখভার করে বসে থাকে সারাক্ষণ, ছেলে মেয়েদের সাথে সামান্য বিষয় নিয়েও তুমুল বকাঝকা করে; আমি না দেখার ভান করে অফিস থেকে নিয়ে আসা পত্রিকাটা আবার পড়তে শুরু করি। সুদিনের আশায় এভাবেই চলছে আমাদের।
পথে আতাহার মিয়ার সাথে দেখা হয়। দু’হাত ভর্তি বাজার সদাই তার। আমরা না দেখার ভান করে এগিয়ে যাই। কিন্তু আতাহার মিয়া ঠিকই আমাদের উচ্চস্বরে সালাম দেন; ভারি ব্যাগ টানতে টানতে কাছে আসেন; তারপর সমবেদনার সুরে বলতে থাকেন, আলী স্যারের মতো ভালো মানুষ হয়না, সে কেন এমন কাজ করল! বেনু ম্যাডাম প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন।
- এত বাজার! কতদিনে খাবেন আতাহার মিয়া?
- আপা, একটা দোকান চালাই। এগুলি দোকানের মালপত্র।
- আপনার দোকানও আছে নাকি?
- এই সন্ধ্যার পর অফিস শেষে বাড়ীর সামনে চা-বিড়ি বেচি। না হলে তো বাঁচতে পারব না।
একুটু বলে আতাহার মিয়া চুপ করে থাকেন; তারপর আবার শুরু করেন, বলতে লজ্জা নাই, কয়েকদিন রিক্সা চালানোরও চেষ্টা করছি; শরীরে কুলায় না, বয়স বাড়ছে তো!
- আপনিতো অতিমানব আতাহার মিয়া!
অতিমানব কথাটির মানে আতাহার মিয়া জানে কিনা জানিনা। উত্তরে বলে ওঠে, আজকের ব্যাগটা বেশী ভারী।
প্রতিদিন জ্যামে আটকে থাকা বাসের দিকে তাকিয়ে- আমরা হেঁটে হেঁটে বাড়ীতে ফেরার কষ্টে খানিকটা হলেও সাত্বনা পাই। আমাদের অস্বস্তিটাকে বাড়িয়ে দিতে আজ পথে জ্যামও নেই। বেনু ম্যাডাম বলেন, এখন না হয় কোনভাবে দিন কেটে যাচ্ছে, এভাবে আর কিছুদিন চললে কী হবে বলুনতো!
- খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে।
- আপনার তো একটা গতি হল! পার্চেজের এক্সট্রা দায়িত্ব নিলে বেতনও তো বাড়বে, তাইনা?
আমি আশার আলো দেখি; আমার কিশোর-কিশোরী সন্তানের মুখ দেখি। দেখতে পাই ওরা আমাকে ঘিরে টিভি দেখতে বসেছে, হাসছে গল্প করছে। আমি আলী সাহেবের কথা ভুলে যাই, যার অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়েছিল। আমি নিজেকে মার্কেটিং আর পার্চেজের দায়িত্ব নেয়া বিশাল কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে দেখি, যে অভাব কি জানেনা, স্ত্রীর দিশেহারা শুকনো মুখ কোনদিন দেখনি, টাকার অভাবে যাকে ব্যায়ামের নামে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়না।
কিন্তু আলী সাহেব আবার ফিরে আসেন মাথার মধ্যে। অভাব আমার চেতনাটাই কি নষ্ট করে দিচ্ছে! আমিতো আতাহার মিয়ার মতো অতি-মানব নই। বাড়ী ফেরার পথটিকে বড় দীর্ঘ মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০০৮ রাত ১১:০৫