বিশ্বের ১৩৮ টা দেশ এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু মাত্র ৩৮ টি দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বর্ণ পদক অর্জন করার গৌরব অর্জন করেছে। কয়েক দিন পূর্বে আপনারা জেনেছেন যে স্বাধীনতার পরে ৪৭ বছরে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক জিতেছে জাওয়াদ নামে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের ছাত্র আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। কিন্তু আপনারা কি জানেন বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াডের কোচ বা প্রশিক্ষকের নাম? তার নাম মাহবুব মজুমদার।
১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জেতার পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমে অনেক কোচ পেয়েছে তাদের কয়জনের নাম আমরা জানি? কিন্তু হাতুরে সিং এর নাম আমরা সবাই জানি। কেন জানি? হাতুরে সিং এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম যে সফলতা পেয়েছে তা আর কোন কোচের নেতৃত্বে পায় না। অথচ পূর্বের কোচের সময়ই বাংলাদেশ টিমে সাকিব-মাশরাফি-তামিম-মুশফিক খেলেছে। একই কথা প্রযোজ্য গণিত অলিম্পিয়াড এর ক্ষেত্রে। শুধু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী হলেই হয় না দরকার হয় যোগ্যতা সম্পন্ন গণিত প্রশিক্ষক বা কোচের। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক বিজয়ীদেরকে মনে করা হয় ভবিষ্যৎ ফিল্ডস মেডেল বিজয়ী। এই ফিল্ডস ম্যাডেলকে বলা হয়ে থাকে গণিতের নোবেল পুরষ্কার। গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক বিজয়ীদেরকে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সম্পূর্ণ স্কলারশিপ দিয়ে ভর্তি করিয়ে থাকে।
মাহবুব মজুমদার স্যারের গনিত অলিম্পিয়াডের গুরুত্ব নিয়ে একটি নিবন্ধ: গণিত কেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গুরুত্বপূর্ণ?
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগীতায় স্বর্ণ পদক বিজয়ী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী এর একটি নিবন্ধ: আমরা পেরেছি
কয়েক মাস পূর্বে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের থিসিস সুপারভাইজার কে ফোন দিলে স্যার আমাকে জানান যে স্যার ঢাকায় যাচ্ছেন নিজের মেয়েকে নিয়ে। এখানে বলে রাখি আমার থিসিস সুপারভাইজার এর মেয়ে প্রত্যাশা গতবছর আন্তর্জাতিক পদার্থ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে পদক জিতেছেন। মাহবুব মজুমদার স্যার প্রত্যাশার সাথে দেখা করতে চান কারণ উনি চান প্রত্যাশা যেন অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনার্স পড়ার জন্য দরখাস্ত করেন। এই বিষয়ে পরামর্শ দিতে চান। গ্রাম বাংলায় আমরা যেটা বলে থাকি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এবারে আপনাদের সুংবাদটি দেই যে প্রত্যাশা বিশ্বের ১ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য মনোনীত হয়েছেন আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাস শুরু করবে। এই মাহবুব মজুমদার গত ১৩ বছর ধরে এই ভাবেই বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সম্পূর্ণ স্কলারশিপ দিয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সাহায্য করতেছেন তাদের জন্য সুপারিশ পত্র লিখে। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি প্রায় ৫০% নির্ভর করে সুপারিশ পত্রের উপর। এই সুপারিশ পত্র কোন অধ্যাপক লিখেছে? সেই অধ্যাপকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি? সেই অধ্যাপক সুপারিশ পত্রে ছাত্র-ছাত্রী সম্বন্ধে যা লিখেছে তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? আপনি হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তো অনেক অধ্যাপক আছে তাদের থেকে মাহবুব মজুমদারের যোগ্যতার পার্থক্য কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক স্যার ৫ই আগষ্ট, ২০১৮ মাহবুব মজুমদার স্যার সম্বন্ধে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সেই স্ট্যাটাস তুলে দিলাম সকলের জন্য। এই স্ট্যাটাস পড়লেই বুঝতে পারবেন কেন অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাহবুব মজুমদার স্যারের সুপারিশ পত্র বিশ্বাস করে?
"কতজন জানেন মাহবুব মজুমদারকে? Well, উনার বাবাকে হয়ত অনেকেই চিনেন। উনার বাবার নাম বদিউল আলম মজুমদার। মাহবুব মজুমদারের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত বেড়ে উঠা এবং পড়াশুনা আমেরিকাতে। উনি এমআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট, স্ট্যানফোর্ডে মাস্টার্স আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে পিএইচডি ও ইম্পেরিয়াল কলেজে পোস্ট-ডক করেন! এরপর বাবামা সহ দেশে চলে আসেন। এই যে সাবজেক্ট পরিবর্তন করে সফল হওয়াই প্রমাণ করে ওর পড়াশুনার গভীরতার স্পেকট্রামটা কত বড়। এরকম versatile এবং প্রচণ্ড মেধাবী স্বেচ্ছায় আপন দেশে ফিরে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি কিন্তু এসে আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরীকে নিজের অনেক বই খুবই নীরবে দান করেছিলেন। বাবার পীড়াপীড়ি আর কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষের অনুরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন কিন্তু হাস্যকর অজুহাতে তাকে নেওয়া হয়নি। এরপর প্রথমে নর্থ সাউথ ও বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
সবচেয়ে বড় কথা হলও উনি টাকার পেছনে ছুটেননি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোড়ানোর বাহিরে উনার সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে উনি গত ১৩ বছর যাবৎ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের প্রধান কোচ।কিছুদিন আগে রোমানিয়ায় অনুষ্ঠেয় ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ প্রথমবারের মত স্বর্ণপদক জয় করেছে। কথা হলো এই গোল্ড মেডেল প্রাপ্তিটার পেছনে কিছু কারিগর আছে। এই কারিগরদের অন্যতম একজন হলো মাহবুব মজুমদার। বাংলাদেশের ভাগ্য যে এমন একজন কারিগর আপনা আপনি পেয়ে গেছে। তাকে বিশাল সেলারি দিয়ে কোচ হিসাবে কেউ নিয়োগ দেয়নি। আমাদের ক্রিকেট ফুটবলে অর্জনের পেছনে যেমন কোচের ভূমিকা আছে এই ক্ষেত্রে কোচের ভূমিকা আরো বেশি ছাড়া কম নয়। কিন্তু এরকম একজন কোচ আমাদের ছেলেমেয়েরা পেয়ে গেছে রাষ্ট্রের কোন প্রকার আনুকুল্য ছাড়া। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে প্রায় নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত করে প্রচুর সময় দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিরামহীনভাবে trainup করে যাচ্ছেন। এটা আরো একবার প্রমাণ করলো একজন নিবেদিত শিক্ষক কি করতে পারে। মাহবুব একটি মেজিক্যাল ক্যারেক্টার। ওর প্রতিভা এমনি যে তার চারপাশের ছাত্রছাত্রীরা এই প্রতিভা দেখে দারুণভাবে আকর্ষিত হয়, শ্রদ্ধায় অবনত হয়।
বিনিময়ে কি পেলেন? নর্থ সাউথে চাকুরী করার সময় ওখানে প্রতিকূল পরিবেশ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিকুল পরিবেশ। আসলে একজন শিশুর মত নির্ভেজাল মানুষের জন্য এই বাংলাদেশে বসবাস করা বড়ই কঠিন। শুধুই কি তাই। সম্ভবত দুই বছর আগে একবার ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন যে "উনার বাবাকে সাদা পোশাকের লোকজন ফলো করছেন"! এতে উনি বিচলিত হন। কিছুদিন আগে আবার লেখেন "“I am regretting coming back to Bangladesh right now. If a person like me gets routinely humiliated in their workplace, why would any of my students even dream of coming back?” আজকের পত্রিকায় আবার সংবাদ "সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িতে রাতে হামলা"! কি ভাষায় মাহবুবকে সমবেদনা জানাবো? কেন সে আর এই দেশে থাকবে?"
যে কারণে আমার এই লেখাটা সবাইকে শেয়ার করতে করজোড়ে অনুরোধ করেছি তার কিছুটা স্যারের স্ট্যাটাসেই শেষের কয়েক লাইন পড়েই জেনেছেন। কিন্তু আজকে মাহবুব মজুমদার স্যারের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না মাহবুব মজুমদার স্যারের পরিবার কোন পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করতেছেন। মাহবুব মজুমদার স্যারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের বাসায় হামলা নিয়ে কোন কথা বলা যাবে না।
কারা হুমকি দিয়েছে সেটা নিশ্চয় অনুমান করে নিতে রকেট বৈজ্ঞানিক হতে হবে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন পাক হানাদার বাহিনী নিশ্চিত হলও যে এই যুদ্ধে তারা কোনদিনও জয়লাভ করতে পারবে না তখন তারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে-খুঁজে হত্যা করা শুরু করলো; এই হত্যার সমাপ্তি টানলো ১৪ই ডিসেম্বর। এই হত্যার একটাই উদ্দেশ্য ছিলও যে স্বাধীন বাংলাদেশ যেন কোন মেধাবী মানুষ না পায় দেশ পুনর্গঠনে। এই ২০১৮ সালে মাহবুব মজুমদার স্যারদের বাসায় হামলা ও সেই হামলার সংবাদ প্রকাশ না করার হুমকি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে দেওয়ারই পুনরাবৃত্তি।
এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন এই বাংলাদেশ আপনার কি না? মাহবুব মজুমদার স্যারের মতো মানুষদের বাংলাদেশের দরকার কি না? এমআইটি (অনার্স) > স্ট্যানফোর্ড (মাস্টার্স) > কেমব্রিজ (পিএইচডি) > ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন (পোষ্ট ডক্টরাল) করা ছেলেকে নিয়ে বদিউল আলম মজুমদার এর মতো পিতারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ফিরে যাবে কি না দেশের সেবা করার জন্য?
যদি মনে করেন মাহবুব মজুমদার স্যারের মতো মানুষদের বাংলাদেশের দরকার তবে এই লেখা শেয়ার করে মানুষকে জানানোর ব্যবস্হা করুন স্যারের পরিবার কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৫০