একাত্তরে বিজয়ের দিনে সন্ধ্যায় কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে প্লাটুন কমাণ্ডার রাজ্জাক সাহেবের খোঁজে বের হলাম। গত কয়েকদিন থেকেই তাঁর দেখা পাচ্ছিলাম না। সেকসন কমাণ্ডার আব্দুর রহিম নানান ব্যস্ততা দেখিয়ে আমার ওপর সব ম্যানেজমেন্টের দায় চাপিয়ে কমাণ্ডে অনুপস্থিত। তাই ডেপুটি হিসেবে আমাকেই সব দেখতে হচ্ছিল বাধ্য হয়ে। ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে কুষ্টিয়ার পতনের পর পলায়ণপর শত্রুবাহিনীর সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পূর্বপাড় থেকে ঈশ্বরদী শহর পর্যন্ত সব সড়ক ও রাস্তায়। এসব যুদ্ধের পরবর্তী পর্যালোচনাও কমাণ্ডারদের কারো সাথে করার সুযোগ হয় নি সময়ের অভাবে। শুধু শুনেছি, যুদ্ধে আমাদের এক বন্ধু মাজদিয়ার মোস্তফা চোখে গুলি লেগে মারা গেছে। অন্যান্য হতাহতের অথেন্টিক খবরও জানি না। ইতোমধ্যে ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের ভেতর দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।সুতরাং পথে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে চলতে আগের মত আর গায়ে চাদর জড়ানোর প্রয়োজন কেউ বোধ করছে না। অন্যান্য সাধারণ নিয়ম-কানুনও শিথিল।
সন্ধ্যা নাগাদ চরবহরপুরে কমাণ্ডার রাজ্জাকের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম। তাঁর ছোটভাই বললো, ভাইয়া ঘরে।
আমরা তার সাথে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। উঠোনে দাড়াতেই কোন ঘরে তা জিজ্ঞাসা করলে সে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল। দরজা খোলাই ছিল। আমার সঙ্গে যারা এসেছে তাদের কেউ বাড়ির বাইরে আর কেউ উঠোনে দাড়িয়ে কথা বলতে লাগলো, আর আমি একাই ঘরের ভেতর যেতেই কমাণ্ডার রাজ্জাক উঠে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, মতি, তুমি কোত্থেকে?
বললাম, দু'দিন ধরে আপনার কোনো খোঁজ নেই, তাই চলে এলাম।
ঘরে দু'জন অপরিচিত লোককে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, এদেরকে তো চিনলাম না, ভাই?
হঠাৎ আমাদের আগমনে কমাণ্ডার রাজ্জাককে একটু বিব্রত দেখালেও উনি মুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন, এরা দু'জন আমাদের গেস্ট আর কি।
বললাম, তা তো বুঝতে পারলাম, কিন্তু কি ধরনের গেস্ট?
ওই দু'জনই ঘরোয়া পোশাকে বিছানায় বসে ছিলেন। কিন্তু আমার প্রশ্নের পর উত্তরের আগেই ওদের একজন নিচে পা নামিয়ে জুতোয় পা ঢুকাতে শুরু করলেন এবং রাজ্জাক ভাইকে বললেন, তাহলে উঠি, খুব তাড়াতাড়িই আবার দেখা হবে।
অবাক হলাম, ওই দু'জনের জুতো দেখে, চকচকে পলিশ করা বুট শেপ ব্লাক কালার দু'জনের জুতোই একই রকম, আয়রন করা জামা-কাপড়। হঠাৎ মনে হলো, এরা কোনো বাহিনীর লোক কিনা। কয়েকমুহূর্ত আগে আমাকে এখানে দেখে রাজ্জাক ভাইও ভেতরে ভেতরে একটু বিব্রত হতে দেখলাম। আমি কিছু বলতে যাবো এসময় রাজ্জাক ভাই তার মেহমানদের কথার জবাব না দিয়ে আমাকে বললেন, এ দু'জন বাঙ্গালি পাক আর্মি।
- পাক আর্মি তো এখানে কেন?
- কাজ শেষ, কমাণ্ডও ডিজলভ্ড। রাজ্জাক ভাই আমতা আমতা করে বললেন।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, রাজ্জাক ভাই, এদেরকে কোথায় পেলেন?
উনার সংক্ষিপ্ত উত্তর, পেয়েছি।
আমার আর বেশি কিছু জানার দরকার মনে হলো না। শরীরের ভেতরে রক্ত চলাচল হঠাৎ করেই কেমন যেন একটু বেড়ে গিয়েছিল বোধহয়। আমার দু'কান দিয়ে মৃদু গরম বাতাস বের হচ্ছিল অনুভব করলাম। কাঁধে ঝুলানো এসএলআর (সেলফ লোডিং রাইফেল) ঠিকই ঝুলছে কিনা তা একবার পরখ করে দেখলাম। তাহলে এদের সঙ্গেই কি এই ন'মাস যুদ্ধ করেছি?
এ ঘটনার মাস খানেক পর একদিন বিকাল বেলা নিজের গ্রামে বড়ইচারা হাটের ওপর বিকেলে বসে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আবার জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। শহরের দিক থেকে একটা গাড় সবুজ রঙের জীপগাড়ি এসে আমাদের পাশেই মেইনরোডে থামলো। এ ধরনের জীপগাড়ি এখন সবাই চিনে, আর্মির জীপ। গাড়ির আরোহীরা সকলেই ইউনিফর্ম পরিহিত, স্বাধীন বাংলাদেশের আর্মি। আমাদের গৌরবের আর্মি।
ওই গাড়ি থেকে দু'জন আর্মি নেমে এসেই অামার দিকে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দন করার জন্য। আমি একটু হতচকিত হয়ে গাড়ি এবং তাদের দিকে মনোযোগ দিতেই খেয়াল করলাম, এরা সেই দুই পাক সেনা ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন সন্ধ্যায় রাজ্জাক ভাই তাঁর বাড়িতে যাদের আশ্রয় দিয়েছিল। বললো, ভাই, চাকুরিতে জয়েন করেছি, দোয়া করবেন।