somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাচীন সভ্যতার নিরব সাক্ষী ফুলবাড়ীয়ার লাল চিনি

১১ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আখ

অভিধান মতে ঐতিহ্য কথাটির অর্থ হলো-পরস্পরাগত কথা; পুরুষানুক্রমিক ধারা; ঐতিহাসিক কথা, কিংবদন্তী, লোকপ্রসিদ্ধি। আর গবেষকদের মতে গৌরব-গর্বের পরস্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ, দেশ-জাতি মাটি ও মানুষের গৌরবময় কীর্তি, লোক বিশ্বাস, প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক-পুরাতাত্ত্বিক বিষয়ের চলমান প্রক্রিয়া হলো ঐতিহ্য। ঐতিহ্য সন্ধানের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি অন্যান্য দেশ-জাতির সাথে আমাদের অতীত সম্পর্ক, আমাদের পূর্বপুরুষের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থা। সেই সাথে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবোজ্জল ভূমিকা।
ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশ পূর্বে এক সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে সেকালে সমৃদ্ধশালী এ অঞ্চল থেকে ভিনদেশে যে সকল পণ্য রপ্তানী হতো তার মধ্যে অন্যতম ছিল চিনি। প্রাচীন বাংলায় আগত বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমন বিবরণীতেও চিনি শব্দটির উল্লেখ লক্ষ্যণীয়। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অর্থনীতিক ভূগোল গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি এরকম-
“চিনি মারফত দেশে বেশ অর্থাগম হত। মার্কো পোলো উল্লেখ করেছেন যে, ত্রয়োদশ শতকে বাংলাদেশ থেকে প্রধান প্রধান রপ্তানীকৃত দ্রব্যের মধ্যে চিনি ছিল অন্যতম। পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা-র বিবরন থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতকের গোড়াতে ভারতের বিভিন্ন দেশে, শ্রীলঙ্কায়, আরবে, পারস্যে বাংলাদেশ চিনি রপ্তানী করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলাদেশে প্রস্তুত চিনি প্রচুর পরিমানে বৃটেনে রপ্তানী হত।”
চিনির বিস্তারিত বিবিরণ পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন গুড় থেকে গৌড় শব্দের উৎপত্তি। তাই আমাদের মনে হয় প্রাচীন ইতিহাসে যেখানে চিনির উল্লেখ পাওয়া যায় সেটা বঙ্গদেশেরই রপ্তানি পণ্য ছিল। এ প্রসঙ্গে “চিনির বলদ” প্রবাদ বাক্যটি লক্ষ্যনীয়। এ প্রবাদ বাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে আমাদের দেশে চিনির প্রচলন বহুকাল আগেই ছিল। অনেকেই ভাবতে পারেন প্রাচীনকালে হয়তো গুড়ের মত একটা কিছু ছিল যাকে চিনি বলা হতো। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। চিনির স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গাঁলীর ইতিহাস আদি পর্বের এই উদ্ধৃতি থেকে-
“সুপ্রাচীন কালেই প্রাচ্যদেশের ইক্ষু ও ইক্ষুজাত দ্রব্য-চিনি ও গুড়-দেশে-বিদেশে পরিচিত ছিল। গ্রীক লেখক ঈলিয়ন(অবষরবহ) ইক্ষুদণ্ড পেষণ-জাত একপ্রকার প্রাচ্যদেশীয় মধুর(পাতলা ঝোলা গুড় ?) কথা বলিতেছেন। ইক্ষুনল পেষণ করিয়া একপ্রকার মিষ্ট রস আহরণ করিত গঙ্গাতীরবাসী লোকেরা, একথা বলিতেছেন অন্যতম গ্রীক লেখক লুক্যান (খঁশধহ); এ-সমস্তই খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীর কথা।”
আমাদের ধারণা সভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক চিনি এখনও তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কালের বিবর্তনে লাল চিনি নাম ধারণ করে সভ্যতার সাক্ষী হয়ে ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল এলাকায় কৃষকের ঘরে ঘরে বেঁচে আছে।
লাল চিনি তৈরী প্রক্রিয়া এরকম-প্রথমে আখ থেকে রস বের করা হয়। রস বের করারপর মাটিতে গর্ত করে তৈরি চুলায় কড়াই বসিয়ে রস জ্বাল দেওয়া হয়। রস পূর্ণ জ্বাল হওয়ার পর কড়াইসহ চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের ডাং বা কাঠি আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় ‘ডোভ’ দিয়ে বিরামহীন ঘুটতে থাকে যতক্ষন না শুকনো ধূলার মত আকার ধারন করে।

লাল চিনি তৈরী হচ্ছে
আখের গুণগত মান খারাপ হলে ধূলারমত না হয়ে গুটি গুটি আকার ধারণ করে। ধূলারমত বা গুটির মত যাই হোক, ফুলবাড়ীয়ার ভাষায় এটাই লাল চিনি। চিনি তৈরী করার জন্য যে অস্থায়ী গৃহ নির্মাণ করা হয় তাকে বলা হয় জ্বাল ঘর। দেখতে ধূসর খয়েরী হলেও সাদা চিনির বিপরীতেই হয়তো লাল চিনি নামকরণ। বয়স্ক ব্যক্তিদের মতে আজ থেকে ৭০-৮০ বছর পূর্বেও অত্র এলাকায় চিনি বলতে বর্তমান লাল চিনিকেই বুঝাতো। কালের বিবর্তনে মেশিনে উৎপাদিত চিনি (ফুলবাড়ীয়ার মানুষের ভাষায় যা সাদা চিনি) প্রসার লাভ করায় অত্র এলাকায় উৎপাদিত চিনি হয়ে গেছে লাল চিনি। এখও অবশ্য ফুলবাড়ীয়ার কোনমানুষ চিনি প্রসঙ্গ উঠলে জিজ্ঞেস করে নেয় লাল চিনি-না সাদা চিনি।
লাল চিনি মাড়াই মৌসুম শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসে-চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত। মাড়াই মৌসুমে ঐ এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে। এ ক্ষেত্রেও নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গাঁলীর ইতিহাস আদি পর্বের এই উদ্ধৃতিটি মনে হয় এখনও প্রযোজ্য। তিনি বলেছেনÑ

“এটি একটি অজ্ঞাতনামা(বোধহয় বাঙালী) কবির রচনা, এবং ধান্য ও ইক্ষুসমৃদ্ধ বাঙলার অগ্রহায়ণ-পৌষের অনবদ্য, মধুর বাস্তব চিত্র।
শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোৎপল-
স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ-সীমোদেরাঃ।
মোদন্তে পরিবৃত্ত-ধেম্বনডুহচ্ছাগাঃ পলালৈনবৈঃ
সংসক্ত-ধ্বনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রাম্য গুড়ামোদিন ॥ [সদুক্তিকর্ণামৃত, ২/১৩৬/৫]
কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে [আঁটি আঁটি কাটা ধান আঙিনায় স্তুপীকৃত হইয়াছে-পৌষ মাসে এখও যেমন হয়] ; গ্রাম সীমন্তের ক্ষেতে যে প্রচুর যব হইয়াছে তাহার শীষ নীলোৎপলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম ; গোরু, বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নুতন খড় পাইয়া আনন্দিত ; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনিমুখর [ আখ মাড়াই কলের শব্দে মুখরিত] গ্রামগুলি [নুতন ইক্ষু] গুড়ের গন্ধে আমোদিত।”
লাল চিনির কিছু লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে। যে কোন আখ থেকেই গুরু উৎপন্ন হয়। কিন্তু যে কোন জাতের আখ থেকে লাল চিনি উৎপন্ন হয় না। এমনকি একই এলাকার একই জাতের আখ ভিন্ন ভিন্ন মাটিতে চাষ করলেও চিনির গুণগত মানের তফাৎ হয়। অন্য দিকে চিড়া, মুড়ি প্রভৃতির মোয়া তৈরিতে লাল চিনির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। লাল চিনির মত এত সুন্দর মোয়া আর কিছুতেই হয় না। লাল চিনি অর্ধপোড়া করে এক প্রকার শিশু খাদ্য তৈরী হয় যা অত্র এলাকায় কটকটি নামে পরিচিত। বাংলা অভিধানে কটকটি শব্দের যে দুটি অর্থ দেওয়া আছে তার একটি-কটকট শব্দে দাঁতে কেটে খাবার মিঠাই বিশেষ। আমদের ধারণা লাল চিনির তৈরি কটকটিই সেই মিঠাই।
উপরের আলোচনার আলোকে আমরা বলতে চাই ফুলবাড়ীয়ায় উৎপন্ন লাল চিনি হয়তো প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছে। যান্ত্রিক সভ্যতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকবে হয়তো আরো কিছুকাল। প্রযুক্তির কল্যাণে চাষিরা আখ মাড়াই কাজে এখন গরু বা বলদ ব্যবহার করেন না। চিনি সংক্রান্ত প্রবাদ বাক্যটি ইতিমধ্যেই মিথ্যে হয়ে গেছে। আখ মাড়াই প্রক্রিয়া অত্যান্ত পরিশ্রমী প্রক্রিয়া। আখ থেকে রস বের করার জন্য ব্যবহার করা হয় একটি যন্ত্র যার তিনটি শলা থাকে লোহার, তারমধ্যে দু’টি শলা আকারে বড়-একটি ছোট। এটাকে বলা হয় ওক (আখ) গাছ। শলাগুলো ঘুড়ালে আখ থেকে রস বের হয়। পূর্বে শলাগুলি ঘুরানোর কাজে ব্যবহার করা হতো চারটি শক্তিশালী গরু। সে যাই হোক-কষ্টর উৎপাদন পদ্ধতি, দীর্ঘমেয়াদে মাঠ দখল করে রাখা, বিকল্প ফসলের সম্ভাবনা প্রভৃতি কারণে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে ইতিহাসের মূল্যবান এ উপাদান। তাই গবেষকদের নিকট আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের দাবীর যুক্তিকতা প্রমাণে হারিয়ে যাওয়ার পূর্বে লাল চিনির উপর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করুন।

৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×