রান্না বিষয়ক ব্যাপারে একজন পেশাদার শেফের সাথে আলোচনা হচ্ছিলো। শেফের সাথে আলাপ হচ্ছিলো। সুনির্দিষ্ট করে বললে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো কাবাব এবং এর আসল স্বাদের সাথে কিভাবে মানুষকে পরিচিত করানো যায়। বর্তমান সময়ে ভারতীয় খাবার সারা বিশ্বে একটি নিজস্ব সুপরিচিতি বা ব্যান্ডভ্যালু তৈরী করেছে। তাদের এই খাদ্য বিপননে কাবাব একটি বিশাল ভুমিকা পালন করে। মোঘলদের নাম ভাঙ্গিয়ে ভারতীয়রা কাবাবের উৎপত্তিস্থলকে প্রায় নিজেদেরই বানিয়ে ফেলেছে এবং অধিকাংশ মানুষ ও পেশাদার রান্না সংশ্লিষ্ট সকলেই কম বেশি এই তত্বে বিশ্বাস করে।
কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে বাস্তবতা ভিন্ন। কাবাবের উৎপত্তিস্থল কোনভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশ নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আগুন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানুষ যখনই পুড়িয়ে মাংস খাওয়া শিখল, তখনই মুলত কাবাবের ধারনা জন্ম নেয়।
পরবর্তীতে দেখা যে, পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব মশলা এবং তেল ছিলো, সেখানেই এই পোড়ানো মাংসের বিভিন্ন স্বাদ আবিষ্কৃত হয় যা ছিলো প্রকৃতপক্ষে কাবাবের আদিরূপ। তৎকালীন এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবেই নানা রকম স্বাদবর্ধক উদ্ভিদের প্রাচুর্য্য ছিলো। এই সকল স্বাদবর্ধক উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ফল, ছাল এবং পাতাই পরবর্তীতে মশলা হিসেবে সুপরিচিত লাভ করে। একটা সময় পোড়ানো মাংসে এই সকল মশলার ব্যবহার শুরু হয়। এইভাবে সকলের অলক্ষ্যে শুরু হয় 'কাবাব' নামক পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় খাবারের পথচলা।
আসুন এবার সুনির্দিষ্ট ইতিহাসে যাই। ইউরোপ যেখানে এশিয়ায় মিশেছে সেই অঞ্চলটির নাম তুরষ্ক। ভৌগলিকভাবে প্রাকৃতিক আর্শিবাদতুষ্ট এই অঞ্চলে নানা ধরনের মশলার গাছ এবং ব্যবহার ছিলো। এই অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া 'কাইসা-ই-ইউসুফ' নামক একটি প্রাচীন লিপিতে ১৩৭৭ সালে প্রথম কাবাবের কথা শুনতে পাওয়া যায়। তার্কিশ সৈন্যরাই প্রথম সময় বাঁচাতে সদ্য শিকার করা পশুর বিভিন্ন মাংশল অংশ তরবারীর আগায় ঢুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে খেতো।
এটাই ছিলো আধুনিক কাবাবের আদিরূপ। তবে সম্প্রতি স্যান্তোরিনির গ্রিক আইল্যান্ডের আক্রোতিরিতে খননকাজ চালানোর সময় খৃষ্টপূর্ব সতেরো শতাব্দীর একধরনের সমান্তরাল দুই পায়া বিশিষ্ট একটি চুলা আবিষ্কার হয়েছে, যার সাথে বর্তমান কাবাব বানানোর কয়লার চুলার প্রায় শতভাগ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সেই হিসাবে কাবাবের জন্মস্থান নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। সন্দেহটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন মহাকবি হোমার। তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ইডিয়াডে কয়েক পিস ঝলসানো মাংস পিন্ডের কথা উল্লেখ্য করেছেন।
যেহেতু কাবাব খুবই প্রাচীন একটি খাবার, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একে বিভিন নামে ডাকা হয়। কোথাও বলা হয় কেবাপ, কেবোব আবার কোথাও বা কিবোব। আবার কোথাও বলা হয় কেবাভ আর কিছু জায়গায় বলা হয় কেবাবী। কাবাব কথাটার আসলে আরামাইক ‘কারব্ববা’ থেকে এসেছে যার উৎস “আকাদিয়ান কাবাবু” মানে আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো। কাবাবের বর্তমানের রূপ কিন্তু একদিনে আসে নাই, কালের আবর্তনে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন ঘটেছে কাবাবেরও এবং বর্তমানে গোটা পৃথিবী জুড়ে কাবাবের বিভিন্ন রূপ ছড়িয়ে আছে |
ভারতীয় উপমহাদেশে সনাতন ধর্মাবলীদের জীবন আচার এখানে প্রচলিত বিভিন্ন খাবারের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে একটা সময় যখন ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের যখন বিকাশ ঘটে - তা একদিকে যেমন সমাজ ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনে, তেমনি প্রচলিত খাবার ব্যবস্থায়ও কিছুটা পরির্বতন আসে। ভারতীয় সমাজে প্রচলিত মাংস গেঁথে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার এই রেওয়াজ পরবর্তীতে মোঘলদের হাতে পড়ে একটি শিল্পে পরিনত হয়।
এবার চলুন ১৮'শ থেকে ১৯'শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে তুরুষ্কের বুরসা শহরে যাওয়া যাক। এটা তুরষ্কের আনাতোলিয়ার অন্যতম বড় শহর। আনাতোলিয়াকে বলা হয় কাবাবের রাজ্য। তো এই আনাতোলিয়ার বুরসা শহরে ইস্কান্দার এফেন্দি নামক এক ভোজন রসিক ব্যক্তি ছিলেন যিনি পোড়ানো মাংসের একটি চমৎকার রেসিপি আবিষ্কার করেন।
(ইস্কান্দার এফেন্দি)
এই পদ্ধতিতে কচির ভেড়া অথবা গরুর অথবা মুরগীর মাংসকে সামান্য কিছু উপাদান দিয়ে মেরিনেশন করে লম্বা একটি কাঠির ভেতর প্রবেশ করিয়ে উলম্ব বা খাড়াভাবে স্থাপিত একটি কয়লার চুলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোড়ানো হতো। পোড়া মাংসগুলো সাইড থেকে কেটে ফেলার পর পাওয়া যেত ভেতরের নরম ও সুস্বাদু অংশ। এই নরম মাংসের কিছু টুকরোকে বেকড রুটির ভেতরে দিয়ে সালাদ, লেটুস, পার্সলে টমেটো, পেঁয়াজ ইত্যাদি ও সস দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। এইভাবে শুরু হয় দুর্দান্ত স্বাদের এক কাবাবের যা পরবর্তীতে তুরুষ্কের অন্যতম আইকনিক খাবারে পরিনত হয়। একদম শুরুর দিকে এই কাবাবকে ইস্কান্দার কাবাব হিসেবেই লোকে জানত। পরবর্তীতে এর নাম হয় ডোনার কাবাব যা চাহিদার দিক থেকে বর্তমান বিশ্বে শীর্ষে। উল্লেখ্য, তার্কিশ ভাষার ডোনার মানে ঘুর্ণয়মান। ডোনার কাবাব মানে ঘুর্ণয়মান কাবাব।
কাদির ন্যুম্যান নামে জনৈক ব্যক্তির হাত ধরে ১৯'শ সালের শেষের দিকে ডোনার কাবাব ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানী এবং ইংল্যান্ডে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
যাইহোক, কাবাব নিয়ে এত কথা যখন ভাবছিলাম তখন সেই পরিচিত শেফ আমার রসনা বিলাসে এগিয়ে এলেন। কিমা করা মাংসে কুচি করা ধনে পাতা, লেবুর রস, অলিভ ওয়েল আর সামান্য কিছু গুপ্ত মশলা ব্যবহার করে ভালো করে মাখিয়ে ছোট ছোট বল আকৃতিতে শিকে পুড়ে যখন গনগনে কয়লার আগুনে পুড়তে দিলেন, তখন নিজের অজান্তেই আমার নিচের ঠোঁট নিজের জিভের ভেতর চলে গেল। কিছুক্ষন পর যখন কাবাবের গন্ধ বের হলো, তখন মিথ্যে ভদ্রতার মুখোশ খুলে করুন দৃষ্টিপাত করতেই, শেফ একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, আপনার জন্যই বানাচ্ছি।
পরিবেশিত কাবাবের উপর সামান্য লেবু চিপে, পেঁয়াজ, শসা আর টমেটো সহ পুদিনার চাটনিতে ডুবিয়ে মুখে ঢুকাতেই, আমি হারিয়ে গেলাম, অদ্ভুত আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। চারিদিকে শুধু আহ! আহ! ধ্বনি। কি চমৎকার নরম কোমল স্বাদ। উপযুক্ত অভিজ্ঞতা আর হাত ছাড়া এই জিনিস বানানো সম্ভব নয়। আরেক প্লেট চাইবো, তার আগেই শেফ মুচকি হেসে বললেন, বস! আজকে আর হবে না, এই গুলো তো বিজ্ঞাপনের জন্য বানিয়েছি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আঙ্গুল চাটতে চাটতে অতৃপ্ত মনে বাড়ির পথ ধরলাম।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ
কুয়ারা ডট কম, উইকিপিডিয়া
দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য ইন্ডিয়া ইন।
ইউটিউব,
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৪