বিএনপি’র চলমান আন্দোলন প্রক্রিয়া এবং তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি চিন্তা দুএকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মধ্যে এটা নিয়েই কিঞ্চিত আলোচোনা করতেই এই লেখা শুরু করছি।
বিএনপি খুব বেশী পুরোনো ঐতিহ্যবাহী দল না হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বেশ পুরোনো এবং এর বেশিরভাগ সিনিয়র নেতা নেত্রীদের রাজনীতির অভিজ্ঞতা অনেক দিনের, এরা প্রথমবার সেনা শাসনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করলেও একটি বিশেষ নির্বাচন বাদ দিলেও দুই বার জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছিল। তাই বর্তমানে সরকারে বা বিরোধী দলে না থাকলেও এই দলকে ছোট করে দেখার কোন কারন নেই এবং বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন কোন দলও নয়। কিন্তু বর্তমান চলমান আন্দোলনের নামে দেশ জুড়ে যে সহিংসতা হচ্ছে যার কারনে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারন মানুষ, এর কারন কি এবং এর শেষ কোথায় ?
প্রথমতঃ বলে নিতে চাই যে বিএনপি যতই দাবী করুক যে এই সহিংসতায় বিএনপি’র সংশ্লিষ্টতা নেই এবং বিএনপিকে বদনাম করার জন্য সরকার এই কাজ করছে। এই কথাটি কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়, এবং এটি কেউ বিশ্বাসও করে না। তাই বলে বিএনপি এটি স্বীকার করে মেনে নেবে এটা আশা করাও বোকামি, বিএনপির স্থলে অন্য যে কেউ হলেও এইভাবে অস্বীকার করে যেতো। এই চলমান সহিংসতার কারনে সাধারন জনগনের কাছেও বিএনপি’র জনপ্রিয়ত কমছে এটা বোঝার জন্য পিএইচডি’র দরকার নেই, এটা সবাই বুঝতে পারছে। তাহলে কি বিএনপি কি বুঝতে পারছে না ? এরকম একটি বড় দল, যাদের প্রচুর জনসমর্থন আছে তারা এটা বুঝতে পারবে না এটা হতে পারে না, অবশ্যই বুঝতে পারছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বুঝতে পারলেও বিএনপি এই সহিংসতা অব্যাহত রাখার কারন কি? নিশ্চই কোন কৌশল বিএনপি’র কাছে আছে, কি হতে পারে সেই কৌশল ?
আমার নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা আছে, তবে সেটিতে যাওয়ার পূর্বে একটু বিশদ আলোচোনা করে নিতে চাচ্ছি।
২০০৬ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ যখন বিচারপতি কে এম হাসান কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তখন কিন্তু কয়েকটি সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে তারা সরকার বিরোধী আন্দোলনও করছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নিতি, অপুরনীয় বিদ্যুৎ ঘাটিতি এবং মুল্যস্ফিতি। ক্রমাগত লোডশেডিং এবং জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মুল্য বৃদ্ধিতে জনসাধারন ছিল অতিষ্ঠ। মনে আছে তখন তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী বিএনপি’র প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়া সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “দেশ উন্নত হচ্ছে তাই জিনসপত্রের দাম বাড়ছে। দেখেন না উন্নত দেশে জিনিসপত্রের দাম কত বেশী”। মান্নান ভুইয়া সাহেবের বক্তব্য আংশিক সত্য ছিল। উন্নত দেশে জিনিসপত্রের দাম বেশী, কিন্তু তাঁর সাথে সাথে সাধারনের ক্রয় ক্ষমতাও বেশী থাকে। দেশ উন্নত কি না সেটি জিনিসপত্রের দামের উপর নির্ভর করে না, যতটা করে সাধারনের আয় এবং ক্রয় ক্ষমতার উপর।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে প্রায় সত্তর ভাগ লোক দরিদ্র, সেখানে সাধারন মানুষের কাছে দেশের ক্ষমতার শীর্ষে কে অবস্থান করছে তাঁর চাইতে অধিক গুরুত্বপুর্ন হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মুল্য এবং তা ক্রয় করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উপার্জন করা। ১/১১’র পরে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এসে দমনমুলক পদক্ষেপ গ্রহন করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা গেলেও প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা গেল মুল্যস্ফিতি, তখন জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেলেও সাধারনের উপার্জন ছিল সীমিত এবং দুর্নিতি প্রতিরোধের নামে ব্যাবসায়ীদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে গিয়ে ব্যাবসায়ে স্থবিরতা দেখা যায়, এতে মুল্যস্ফিতি শতকরা ১২ টাকায় পৌঁছে যায়। ২০০৮ এর শেষে সালে আওয়ামী লীগ ১০ টাকা সের চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসলেও, তারা এখন পর্যন্ত ১০ টাকা দূরে থাক ২০ টাকায়ও চালের মুল্য নামাতে পারেনি, যদিও ১০ টাকার লোভ কেউ বিশ্বাস করেনি। এর মধ্যেও সাধারন মুল্যস্ফিতি রোধে বর্তমান সরকারের সাফল্য অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে একটি কাজ হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম কমাতে না পারলেও কয়েক দফা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর ফলস্রুতিতে অন্যান্য সেক্টরেও এর প্রভাব পড়েছে এবং এতে সামগ্রিকভাবে সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে।
গত ৬ বছরে সাধারন মানুষের আয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি হলেও জিনিসপত্রের দাম না বাড়ার কারনে দেশের সাধারন মানুষের মধ্যে একটি স্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর সাথে দাম বেশী দিয়ে হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়া এবং অন্যান্য আরো কিছু বানিজ্য বান্ধব সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপোরি কৃষি উৎপাদনে ধারাবাহিক সাফল্যের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন অনেক আশাব্যাঞ্জক। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি অনেক ভালো একটি স্থিতবস্থায় আছে। দেশের মুল্যস্ফিতি (৬,২) এবং মুদ্রাস্ফিতি (৫,৩৯) দুটিই স্বাভাবিক অবস্থায় আছে, ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ ভালো (২২ বিলিয়ন ডলার), মাথাপিছু আয় বেড়ে ৩,৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং গত ৬ বছরে রপ্তানী আয় বেড়ে দিগুনের বেশী হয়েছে।
এই সাফল্যের পেছনে সবচে বড় ভুমিকা আমাদের দেশের ব্যাবসায়ী সমাজের এবং সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের তবে সরকারের ভুমিকা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। তাই এখন সবচে বড় ব্যপার হচ্ছে এরকম একটি পরিস্থিতিতে যখন সাধারন মানুষ কাজ করে তিন বেলা খেতে পারছে এবং খুব বড় ধরনের অস্বস্তি এবং অস্থিরতে নেই সেখানে সরকার পতনের মতো কোন ব্যাপারে সাধারন মানুষকে কাছে পাওয়া দুস্কর, এজন্যই ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের পর গত এক বছরে বিএনপি নানা ভাবে সময় দিয়েও সাধারন মানুষকে তাঁদের চলমান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে ব্যার্থ হয়েছে।
ঠিক একারনেই বিএনপি এই চলমান সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে যার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়বে সাধারন মানুষের উপর। গত ২৪ দিন ধরে বিরামহীন ভাবে চলা অবরোধ এবং এর মাঝে দু এক দিন করে হরতালে দুষ্কৃতিকারীদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় এখন পর্যন্ত ৩৫ জন মারা গেছে। দুরপাল্লার যানবাহন চললেও পথে ঘাটে নিরাপত্তার অভাবে এই চলাচল স্বাভাবিক নয়। এর প্রভাব পড়ছে পন্য পরিবহনে, যার প্রভাবে বেড়ে যাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। ক্রমাগত এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ব্যাবসায় মন্দা দেখা দেবে এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা উপার্জনহীন হয়ে পড়তে থাকবে এবং বেড়ে যাবে বেকারত্বের পরিমান। এর প্রভাব পড়বে দেশের রপ্তানী বানিজ্যেও। আগামী ২ ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হচ্ছে এস এস সি পরীক্ষা, এই চলমান অবরোধকালীন সহিংসতা অব্যাহত থাকলে পরীক্ষার্থীদের মাঝেও দেখা যাবে এর প্রভাব, তাই সর্বোপোরি দেশের এই সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিরবস্থা ধ্বংসের জন্যই বিএনপি সুদুরপ্রসারী কৌশল হিসেবেই এই সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সহিংসতা ক্রমাগত চলতে থাকলে এবং আরো কিছুদিন স্থায়ী হলে ধীরে ধীরে এর প্রভাবে দেশের অভ্যান্তরে অস্থিরতা বাড়বে এবং সরকারের উপর এর চাপ গিয়ে পড়বে। ফলস্রুতিতে বিরোধী দল গুলি পেয়ে যাবে আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্যু এবং একই সাথে বেকারত্ব বেড়ে গেলে বেড়ে যাবে মিছিলে যাওয়ার লোক। তখন মানুষ ভুলে যাবে বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিরবস্থার কথা এবং পেট্রোল বোমায় নিহত ৩৫ জনের কথা। জমে উঠবে সরকার পতনের আন্দোলন।
জানি না, বিএনপি এই কৌশল করছে কি না ? চলমান সহিংসতা চালিয়ে যাবার জন্য এ ছাড়া অন্য কোন কারন আছে বলে চিন্তা করে পাচ্ছি না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি প্রস্তুত এরকম একটি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ?