বর্তমান চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যে কর্মসূচি চলছে তাঁকে রাজনৈতিক আন্দোলোন না বলে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বলাই স্রেয়, এর কারন একদম পরিস্কারঃ উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হলেও যে কর্মসুচি চলছে তা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড (উদ্দেশ্যে করে সাধারন মানুষকে আক্রমন এবং হত্যা করা) সাধারন ভাবে সন্ত্রাস মোকাবেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দরকার হলেও গত এক মাস ধরে চলা সহিংসতায় গতকাল পর্যন্ত ৫৮ জন নিহত হওয়া প্রমান করে শুধুমাত্র আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এই সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব নয়।
এই আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে এর রাজনৈতিক কারন খুজে দেখতে হবে এবং এই রাজনৈতিক কারনটি সমাধানের মাধ্যমেই এই আন্দোলন বন্ধ হবে। তবে কারন যা ই হোক এর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আলোচোনা এবং সমঝোতা। গত প্রায় এক মাস ধরেই প্রায় সবার মুখেই এই আলোচোনা নিয়ে আলোচোনা চলে আসছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় অবধারিতভাবেই এই আলোচোনা শুরুর দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাধে গিয়েই পড়ে। এবং সরকার অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলোচোনার উদ্যোগ না নেয়ায় তাদেরকে সমালোচোনাও শুনতে হচ্ছে। কিন্তু আলোচোনার মাধ্যমে কি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কয়েকটি বিষয়ের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রশ্ন মাথায় আসছে, কারো কাছে কি এই তিনটি প্রস্নের উত্তর আছে ?
প্রথমতঃ বিএনপি’র পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ৫ ই জানুয়ারীর নির্বাচন অবৈধ এবং ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও অবৈধ, এবং তাঁরা এই অবৈধ সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার অবৈধ হলে বিএনপি কার সাথে আলোচোনা করতে চায় ? সরকারের সাথে আলোচোনা করার আগে তো সরকারকে বৈধতা দিতে হবে। বিএনপি কি রাজি সরকারকে বৈধতা দিতে ?
দ্বিতীয়তঃ অনেকেই বলছেন চলমান সহিংসতা (সন্ত্রাস) বন্ধ করতে হলে আলোচোনাই একমাত্র রাস্তা। সত্যিই কি তাই? বর্তমান সরকারের অভিযোগ বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা (সন্ত্রাস) করছে, কিন্তু বিএনপি’র পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে তাঁরা শান্তিপুর্ন আন্দোলন করছেন এবং এই চলমান সহিংসতা এবং সন্ত্রাসের পেছনে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নেই, সরকার গোপনে এই সহিংসতা করে তাঁদের উপর দোষ চাপাচ্ছে। বিএনপি’র নেতাদের কথায় মনে হচ্ছে এই চলমান সহিংসতায় (সন্ত্রাসে) বিএনপি’র কোন হাত নেই। তাহলে বিএনপি’র সাথে আলোচোনায় বসলে এই সহিংসতা বন্ধ হবে কিভাবে ? আর যদি সত্যিই বিএনপির হাতে এই সহিংসতা বন্ধ করার কোন ক্ষমতা থাকে তা তাঁরা স্বীকার করে নেবে কি ? এই সহিংসতার দায় নেবে কি?
তৃতীয়তঃ এই ৫৮ জনের মৃত্যুর পর, সরকার যদি এখন আলোচনার জন্য প্রস্তাব দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে এই সন্ত্রাস বন্ধ করার উদ্যোগ নেয় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে একটি মেসেজ চলে যাবে যে, সরকারকে নমনীয় করতে গেলে পেট্রোল বোমা হামলা করে মানুষ মারতে হবে, তাহলে সরকার আলোচোনা করতে বাধ্য হবে। এর ফলস্রুতিতে ভবিষ্যতে আবার কোন দল তাঁদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য আবার মানুষ হত্যায় মেতে উঠবে, আর দাবি যত বড় হবে তত বেশী মানুষকে হত্যা করা হবে। তাই এই সন্ত্রাসের কাছে নত স্বীকার করে এর সাময়িক সমাধান করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসের পথ উন্মুক্ত করা হবে। এই সন্ত্রাস রোধ করার স্থায়ী উপায় কি ?
তবে এটা ঠিক যে, যে কোন উপায়েই হোক এই সন্ত্রাস বন্ধ করতেই হবে। একটি দাবী আদায়ের জন্য আর কতটি প্রান দরকার, আর কতটি প্রান নেয়ার দরকার। কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম, আমাদের দেশের সাধারন মানুষের জীবনের চাইতেও তাঁদের ভোটের মুল্য রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক বেশী, কারন দেশের মানুষের জীবন তাঁদের কোন কাজে আসেনা, কিন্তু তাঁদের ভোট রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার মসনদে বসতে সাহায্য করে। তাই তাঁরা তাঁদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে ভোটের অধিকারের নামে।
এইসব রাজনীতিবিদদের হাত থেকে মুক্তি চাই আমরা, ফিরে পেতে চাই সেই বাংলাদেশ, সেই অবিসংবাদিত নেতা যার কাছে দেশের মানুষের হাসিমাখা মুখের তুলনায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হবে।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফির কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (সংক্ষেপিত) – নবারুন ভট্টাচার্য