১৯৯০ সাল থেকেই আমি নিয়মিত বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে জোগ দেই। তখন রমনা এবং সোহরাওয়ার্দীতে এতো ভিড় হতো না। প্রতি বছরই আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকলেও এই ভিড় ব্যাবস্থাপনা উন্নত হয়নি কোন কালেই। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথেই এক সাথে কয়েক হাজার মানুষ রমনা থেকে টিএসসি যাবার জন্য বের হলে ভিড়ের মাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠে রমনার পশ্চিম দিকের গেটে (পরে এর নাম দেয়া হয় অস্তাচল) সেই শুরু থেকেই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে এসেছি যে কিশোর বয়সী কিছু জন্মগত ভাবে নপুংসক ছেলে ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার চেস্টা করে, এবং এদের শাসাতে কিছু মহিলা পুলিশ লম্বা লাঠি নিয়ে নজরদারিতে দাড়িয়ে থাকলেও এরা তার তোয়াক্কা করে না। এর মধ্যেও যে কেউ হেনস্তা হয় না সেটা কেউ বলতে না পারলেও শুধুমাত্র বিব্রত বোধ করার কারনেই এই ঘটনা নিয়ে যেমন কেউ কখনও মুখ খোলেনি ঠিক তেমনি ঘটনাটিও কখনই মাত্রা ছাড়ায়নি।
আমাদের সমাজে কিছু পুরুষ রুপী কিছু নোংরা খচ্চর আছে যারা নিজেদের বিকৃত যৌন তৃপ্তি লাভের জন্য, ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার চেস্টা করে। এরা কখনই কাউকে রিপ্রেজেন্ট করে না। এসব বিকৃত রুচির ছেলেপেলে সব স্থানেই আছে এবং এদের সংখ্যাও কম না। এর শুধু পহেলা বৈশাখ না, যে কোন ভিড়ের মধ্যেই এরা সুযোগ খুজে বেড়ায়, সেটা ঈদের শপিংয়ে হোক আর বাসের ভিড়েই হোক, তাই এটা নতুন কিছু না। তাই বলে আমি এর পক্ষেও সাফাই গাচ্ছি না। এটা অবশ্যই অন্যায় এবং এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া দরকার। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিম বিব্রত থাকে বলেই অভিযোগ করা হয়না এবং অপরাধীকে সনাক্ত করে কোন ব্যাবস্থাও নেয়া হয়না। তাই বিষয়টি নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে কিছু করাও সম্ভব না। এর প্রতিকার হিসেবে আমাদের মা, বোন, ভাবী এবং সন্তানেরা ব্যাক্তিগত নিরাপত্তাই বেছে নেয় এবং সতর্কভাবে ভিড় এড়িয়ে চলে।
কিন্তু এবারের অভিযোগটির ব্যাপকতা অনেক তাই অনেকেই উদ্যোগী হচ্ছেন। কিন্তু কিছু প্রশ্ন উকি দিচ্ছে বারবার তাই প্রায় সবগুলি নিউজ পড়ে এবং ছবি দেখে একটু কনফিউজ হয়ে পড়ছি। আর একটু ভিন্ন ভাবে হিসেব মেলানোর চেস্টা করছি। দেখি মেলে কি না।
ঘটনাস্থল দুটিঃ এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের পূর্ব দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন গেট (কাকতালীয় ভাবে অভিজিত রায়কেও এখানেই হত্যা করা হয়েছিল) দ্বিতীয়টি চান খাঁ'র পুল মোড়।
প্রথমতঃ প্রায় যতগুলি মিডিয়াতেই এটা প্রচারিত হয়েছে তাদের সবগুলির ভাষা এবং কাহিনি বর্ননা হুবুহু এক। এটা কেন হবে ? যে কোন ঘটনা বর্ননা করার সময় একেক জনের বর্ননা একেক রকমের হবে কোন অবস্থাতেই এক রকম হবে না।
দ্বিতীয়তঃ চানখার পুল মোড়ের ঘটনায় একজনকে ধরা হয়েছে এবং তাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুলিশে দেয়া হয়েছে। সেই একজনের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি কিন্তু টিএসসির ঘটনায় কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি বরং মার খেয়েছে যারা উদ্ধার করতে গেছেন তারা।
তৃতীয়তঃ এই ঘটনাগুলি প্রচারে একটি বিশেষ পক্ষকে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে এবং খবরের সাথে চানখারপুলের ঘটনার তোলা একটি ছবি দেখানো হচ্ছে এবং তারা কৌশলে দুটি কাহিনিকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যাতে দুটি ঘটনাকে একই সুত্রে গেথে এটিকে একটি সংঘবদ্ধ উদ্যোগ এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে।
তাই হিসেব মেলাতে পারছি না। কিছু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছেঃ
প্রথমতঃ কোন ঘটনার একাধিক বর্ননা হুবুহু এক হবে শুধুমাত্র তখনই যখন কোন একজনের বর্ননাই সবাই ব্যাবহার করে থাকেন। এরকম প্রকাশ্যদিবালকে ঘটে যাওয়া ঘটনার অন্য কোন বর্ননা পাওয়া যাচ্ছে না কেন। টিএসসির ঘটনার ব্যাপকতা যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে সে তুলনায় অভিযোগকারী কিন্তু একজন (এবং তার সঙ্গী দুজন) আর কারো কাছ থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না কেন ?আর এখন প্রায় সবার পকেটেই স্মার্টফোন থাকে, কারো কাছেই তো টিএসসির ঘটনার কোন ছবি দেখা গেল না।
দ্বিতীয়তঃ টিএসসির ঘটনার ব্যাপকতা অনেক হলেও ঘটনার বর্ননা একজনের এবং তার ভাষ্য মতে তারা কয়েকজন এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন। সবচে অবাক ব্যাপার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি। টিএসসি চত্বরে তার গায়ে হাত তোলার ঘটনা চিন্তা করতে গেলেও চিন্তাটা একটু আটকে যায়। তার উপর তার সাথে ছিলেন তার সংগঠনের আরো দুই নেতা। তাহলে হামলাকারী কারা ? আর প্রকাশ্য দিবালোকে এধরনের ঘটনার প্রতিবাদে উপস্থিত কাউকে তিনি সাথে পাননি তা বিশ্বাস করতে কস্ট হয়, এটা মব এটিটিউডের সাথে যায় না । চানখার পুলের ঘটনা এর প্রমান। উত্যাক্তকারীকে উত্তম মধ্যম বেশ ভালো মতোই দেয়া হয়েছে।
তৃতীয়তঃ কয়েকটি মিডিয়া চানখার পুলের ঘটনার ছবি ব্যাবহার করে এমনভাবে খবরটি উপস্থাপন করেছে যাতে যে কেউ কনফিউজ হয়ে যাবে যে ছবিটি টিএসসি'র এবং এতে একজনের জামা ছিরে নগ্ন করে ফেলা হয়েছে। এবং ঘটনার বর্ননায় মহিলাদের জামা ছিরে ফেলার ঘটনার সাথে ছবি মেলাতে গেলে একজন সাধারন মানুষ তাই ভেবে নিবে। আসলে ছবিটি চানখারপুলে গনপিটুনি খাওয়া সেই যুবকের (যার জামা ছিরে ফেলা হয়েছে) যাকে গনপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়া হয়েছে, (এই ছবিগুলি আছে অনলাইনে)। এভাবে মেক আপ করে (ফটোশপের মাধ্যমে) ছবি দিয়ে বিভিন্ন ঘটনা প্রচারের সাম্প্রতিক কিছু উদাহরন আমরা দেখি। মজার ব্যাপার সেই একই মাধ্যম থেকে এই ছবি ব্যাবহার করে খবর প্রচার করা হচ্ছে, এবং একইভাবে। তাই ঘটনা সত্যি হলেও কিছু সন্দেহ থেকে যাচ্ছে মনে।
আসলে ঘটনা কতটুকু ঘটেছে এবং কিভাবে ঘটেছে সেটা বুঝতে পারছি না তবে এটা বুঝতে পারছি যে এই ঘটনাকে ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে একটি ভবিষ্যৎ রেফারেন্স রেখে দেয়ার জন্য। জানি না এর পেছনে কারা কিভাবে জড়িত।
পাঠকেরা বিভ্রান্ত হবেন না, আমি কোন অবস্থাতেই বলার চেস্টা করছি না যে সেদিন বর্ষবরণ উৎসবে বখাটে কর্তৃক নারীদের উত্যাক্ত / হয়রানি করা হয়নি। অত্যান্ত দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে এই ঘটনা বহুকাল ধরেই ঘটে আসছে। ২৫ বছর আগে গাওয়া ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদের গাওয়া গানেও এর রেফারেন্স আছে।
মেলায় যাই রে , , , , মেলায় যাই রে , , , ,
বাসন্তী রঙ শাড়ী পরে ললনারা হেটে যায়
মেলায় যাই রে , , , , মেলায় যাই রে , , , ,
বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই
আমাদের ব্যার্থতা যে আমরা এখনো এটা বন্ধ করতে পারিনি। এটা বন্ধ করার জন্য কিছু সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন, আশা করছি এবার অনেকেই এটা নিয়ে নড়ে চড়ে বসবে। হয়তো সামনে কিছু সুফল পাওয়া যাবে।
আমি শুধু প্রশ্ন করতে চাচ্ছি এর ব্যাপকতা নিয়ে এবং অভিযোগ করতে চাচ্ছি যেভাবে এই ঘটনার বিবরন প্রদান করা হচ্ছে সেই বিবরনের ভাষা নিয়ে। একই সাথে প্রতিবাদ জানাচ্ছি যেন এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে পুজি করে রাতারাতি কেউ হিরো না বনে যায় এবং আহবান জানাচ্ছি সর্ব স্তরের সবাইকে, যেন এই ঘটনা নিয়ে আমাদের আর কোনদিন কথা বলতে না হয়।