১.
৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে আম্লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিভাবে পায় আর তার বিপরীতে জাশির ভরাডুবি হয় কি করে? এতে কি প্রমাণিত হয়? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যায় মুসলিমরা বেশি হলেও জাশির কোন গ্রহণযোগ্যতা কেন ছিলো না? যে পাকিস্তান নামক বেহেস্তখানা ৭১ এ ভেঙে যাওয়ায় জাশি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দুঃখিত ব্যথিত মর্মাহত স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সেই বেহেস্তখানাতেও ওদের কোনো খানা ছিলনা। সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ওদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকা আর জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি এসবও কি ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র ছিল?
কোটির ওপর শরণার্থী অন্য দেশে আশ্রয় নেয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কিভাবে? সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ছিল বিধায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপ্তিও ছিলো বিশাল। ১ কোটিরও কয়েকগুণ আক্রান্ত না হলে ওই ১ কোটি সংখ্যক শরণার্থী হবে কি করে? শুধু ঢাকা শহরেই ১ লক্ষ ৭০ হাজার বীরাঙ্গনার গর্ভপাত করানো হয়েছিল আর ৩০ হাজার বীরাঙ্গনা যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই শিশুর অনেককেই বিদেশী সাহায্য সংস্হার সহায়তায় বিদেশের কোন নিঃসন্তান পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই সরকারী হিসাবের বাইরে তাহলে কত সংখ্যক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল যা অনিবন্ধিত/অপ্রকাশিত? মুক্তিযুদ্ধে মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ (সরাসরি যুদ্ধই করতে হবে এমনটা নয়-এক মুঠো মুড়ি না এক গ্লাস পানি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেও অনেকে নির্যাতিত হয়েছিল) না থাকলে ৭১ এ এত শরণার্থী আর নির্যাতিতা বীরাঙ্গনার উদ্ভব হতো না।
২.
৭১ এ যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো তাদের সামগ্রিক বিকাশ হয়েছিল ৫০, ৬০ এর দশকে আর আমাদেরটা গড়ে উঠেছে ৮০, ৯০ এর সময়কালে। নিশ্চিতভাবেই তখনকার বাঙালীদের মনস্তত্ত্ব আর আমাদের মনস্তত্ত্ব এক রকম হবে না।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে ৭১ এ বিজয় অর্জনের পরপরই আমাদের সদ্য অভ্যুদয় হওয়া বাংলাদেশের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে যে সকল ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো বা পাকিস্তান সরকারের সময় থেকে বহাল ছিলো, তা ছিলো সম্পূর্ণ বাছবিচারহীন। মুক্তিযুদ্ধের গোটা ৯ মাস যে সব ব্যক্তি যুদ্ধে যোগ না দিয়ে বা অফিসে অনুপস্থিত না থেকে দিব্যি তৎকালীন দখলদার পাকিস্তান সরকারের বেতন ভাতার সুবিধাদী নিয়েছিলো, বিজয় অর্জনের পরও স্বাধীন বাংলাদেশে তারা তাদের স্বপদেই বহাল ছিলো। আবার পাকিস্তান ফেরত সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদেরও স্বপদে আত্তীকরন করা হলো, এমনকি যেসব বাঙালী সেনা অফিসার মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলো তাদেরও।
এরপর ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত তো রাজাকার বান্ধব সরকারের সময়কাল। এ সময়ে আমাদের সমাজে পূর্ণ উদ্যমে রাজাকার ও রাজাকার বান্ধব বয়ানের আত্মীকরণ করা হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রজন্ম ও পরবর্তী প্রজন্মদেরও ৭১ এর মুক্তিসংগ্রামের কাহিনী শুনতে হয়েছে রাজাকার পুনর্বাসনকারীদের মুখ থেকেই। নিশ্চিতভাবেই সেই সব কাহিনী জানি, যা রাজাকারদের জন্য সুবিধাজনক আর যা তাদের জন্য অস্বস্তিকর তা হয়তো আমরা কেউ আজ পর্যন্ত জানিনা।
আমাদের প্রজন্ম ৭১ এর মুক্তিসংগ্রাম দেখেনি কিন্তু বহির্বিশ্বে ঘটা ইসরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, ইরাক-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ, সার্বিয়া-বসনিয়া যুদ্ধ, লিবিয়া সিরিয়ায় পশ্চিমাদের আগ্রাসন দেখেছে। মোটা দাগে মুসলিম রাষ্ট্র সমূহ পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের শিকার এরকম ঘটনার ভিত্তিতেই তাদের মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছে।
আবার ৫৪ টা আন্তর্জাতিক নদীতে ভারত বাঁধ দিয়েছে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সাথে আলোচনার তোয়াক্কা না করেই। ভারত নামমাত্র মূল্যে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি দিয়ে তাদের উত্তর পূর্বাঞ্চলীও রাজ্য সমূহে পণ্য পাঠায় আর আমরা সেই রকম সুবিধা পাইনা বিধায় নেপাল ভুটান পাকিস্তানে কম খরচে রপ্তানি করতে পারিনা। আমরা ভারত হতে আমদানিকৃত পণ্যে অন্যায্য শুল্ক আরোপ করিনা কিন্তু আমাদের পণ্য ওদের দেশে রপ্তানি করতে গেলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, জটিল সব আমদানী শুল্কের বাধায় পড়ে। সীমান্তে প্রতিনিয়ত যে মানুষগুলো বি এস এফ এর গুলিতে নিহত হয় তারা মূলত: গরু চোরাচালানী কিন্তু তারপরও তো তারা মানুষ, আমাদের বাংলাদেশের মানুষ। সুতরাং ওই নিহত চোরাচালানীর ভুক্তভোগী পরিবার কি স্বজ্ঞানে ভারত বিদ্বেষী হবে না? আর বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের অনুভূতি কি আঘাতপ্রাপ্ত হবে না? স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অবকাঠামোগত বিবিধ উন্নয়নের শরিক দেশগুলো ছিলো মূলত: জাপান, কোরিয়া আর চীন। এখানে ভারত ওইসব দেশে ধারে কাছেও নেই। এ কেমন বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ?
এছাড়াও ৭১ এর মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে ভারতীয়দের বয়ান অনেকটা এরকম যে, ওরা মাত্র ১০-১৫ দিন যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাংলাদেশীদের দয়া করে দান করেছে, "দয়া করে"। তাহলে ৭১ এ ডিসেম্বরের আগে ৯ মাস বাংলাদেশীরা কি করলো? ভারতীয়রা না আমাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল? শরণার্থীরা তো শরণার্থী শিবিরেই ছিল আর আমাদের গেরিলারা কি অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯ মাস যাবৎ বাংলাদেশেই সুবিধা জনক অবস্থানে থেকে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল যে কখন ভারত যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে? শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য প্রস্তুত করবেন কিন্তু পরীক্ষা তো শিক্ষার্থীদেরই দিতে হবে। তাই ৯ মাসের যুদ্ধ বাংলাদেশীদেরই করতে হয়েছিলো। আর ডিসেম্বরের ১০-১৫ দিনের কথিত ভারতীয় যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ জনগণ আর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলনে গঠিত একটি যৌথ বাহিনীর যুদ্ধ। সুতরাং দান করে দান গ্রহিতার (বাংলাদেশের) প্রতি দাতার (ভারতের) এরকম আচরণ চূড়ান্ত অপমানজনক, ভারত-বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালার সামিল।
সবকিছু মিলিয়ে ভারতের এরকম আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী মনোভাব দেখে বিকশিত হয়েছে ৭১ পরবর্তী প্রজন্ম সমূহ (এখানে আমার ব্যাক্তিগত মত এটাই যে আমি ৭১ এ ভারতের সাহায্য সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞ এবং তা কখনোই ভুলব না। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার স্বতন্ত্রবোধ ও ন্যূনতম আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে পারবো না)।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ভারতের দাদাগীরির নিদর্শন আর চলমান বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ঘটনার সুযোগে (যা আমাদের প্রজন্ম দেখে অভ্যস্ত) রাজাকাররাও সংক্ষেপে এটিই আমাদের হজম করানোর চেষ্টা করে যে ৭১ এ পাকিস্তান নিছক হিন্দু ভারতের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলো আর ৯ মাস ব্যাপি ওই যুদ্ধ ছিলো মুসলিম পাকিস্তান বনাম হিন্দু ভারতের যুদ্ধ।
৩.
৭১ পরবর্তী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৭১ কে বিশ্লেষণ বা উপলব্ধি না করে আমাদের উচিত ঠিক ওই সময়ে চলে যাওয়া।
যেখানে আমি দেখবো যে,
/শুধুমাত্র উর্দূ ভাষায় সাবলীল না হওয়ার কারণে আমি চাকরি ক্ষেত্রে নিজের ভালো কোনও অবস্থান তৈরি করতে পারছি না বা চাকরিতে আমার জন্য উচ্চমান সহকারীর ওপর সবচেয়ে নিচের অধস্তন কর্মকর্তা হওয়ারও কোন সুযোগ নেই।
সেই সময় জন্মসূত্রে বাঙালী হওয়া তো পাপ আর ধর্মীয় ভাবে যদি সনাতনী হই, তবে তো তা মহা পাপ।
/আমার দেশের মানুষের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষরা তুলনামূলক কম মূল্যে চাল কিনতে পারে অথচ পূর্ব পাকিস্তানেই সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদিত হয়।
/শুধু পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পাট রপ্তানি করে এককভাবে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার আয় হত সমগ্র পাকিস্তানের। কিন্তু সে আয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন শহর তৈরি ও অন্যান্য উৎপাদনশীল শিল্প খাত গড়ে উঠতো পশ্চিম পাকিস্তানে।
/মনে করি ২৫ শে মার্চের পর কোন এক দিন আমার কিশোরী ছোট বোনকে শান্তি কমিটির লোকজন ধরে নিয়ে এলাকার পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওই অনুভূতি দিয়েই কিন্তু আমি ৭১ কে বোঝার চেষ্টা করবো।
৪.
ঐতিহাসিক সত্য তো এটাই যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জাশির কোনও ভূমিকা ছিলো না। “ভূমিকাই” ছিলো না, আপাদমস্তক অবদান তো দূরের কথা। আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এরা ছিলো সশস্ত্র বিরোধী, তাও সরাসরি মুক্তিবাহিনী/যৌথ বাহিনীর বিরুদ্বে এদের সম্মুখ যুদ্ধের কোন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে রাতের আধারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা বা পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পে বাঙালী নারী সরবরাহের কাজটা ভালোই করেছে এই সকল তথাকথিত ইসলাম বেচে খাওয়া ধর্ম ব্যবসায়ী রাজাকাররা, এসব বীরত্বই এরা দেখিয়েছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




