somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকা-চেংগ্নী-নাদেংকল-বিরিশিরি-ঢাকা : বাউণ্ডুলের তীর্থযাত্রা - পয়লা কিস্তি

২২ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চুনিয়ার সোহেল মৃ'র লগে বন্ধুত্ব বেশ কয়েক বছরের। মান্দি রীতি মেনে মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের পান্থি (যুবক) সোহেল মৃ এখন গারো পাহাড়ের পাদদেশে নেত্রকোনার চেংগ্নী গ্রামের জামাই। গারো হিলসের স্বাধীনতাকামী সংগঠন-আচিক ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার কাউন্সিল- এএনভিসি‌' র সক্রিয় ক্যাডার ছিল এই সোহেল। সংগঠনের কাজ করতে গিয়েই সীমান্তবর্তী চেংগ্নীর সুপ্তি রাকসামের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সরকারের সাথে চুক্তির পর এএনভিসি তার বৈপ্লবিক চরিত্র হারিয়ে এখন বিভিন্ন সুবিধাভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেমনটা আমাদের পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি। যাইহোক, ওদের বিয়ে হয়েছে গত জানুয়ারিতে। অনেক ইচ্ছে থাকলেও সহযোদ্ধা রাজকুমার ব্যতীত আমাদের সবাই ছিলাম সেখানে অনুপস্থিত। সোহেলের সাথে প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচবার মোবাইলে আলাপ হয় নিয়মিতই। প্রতিবারই ওর আক্ষেপ শুনতে হয়-এখনো ওর ওখানে আমরা যাইনি বলে। একধরনের অপরাধবোধও কাজ করে এজন্য। রোজার শুরুতেই সাহস করে ঠিক করেছিলাম ঈদের পরদিনই চলে যাব চেংগ্নীতে। বন্ধু পরাগ রিছিলকে জানালাম, রাজি হয়ে গেল সাথে সাথেই। জানানো হয়েছিল সোহেলকেও। যাইহোক, ঈদের পরদিন মহাখালী পৌছাতে পৌছাতে সকাল সাড়ে নয়টা। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালের সেবিকা রিমি দিও আর ওর ছোট বোন লুমা-র সাথে আড্ডা মেরে বাসে ওঠতে ওঠতে সকাল সাড়ে দশটা। নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি কর্মী - বন্ধু কৃতি কনিকা, পলল পরাগ, ঢাকা থেকে ডেইলি স্টারের নাজনীন তিথিদেরও আমার ভ্রমনসঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়ে ওঠেনি ওদের কী সব ঝামেলার দরুণ। কথা ছিল পরাগ জয়রামকুড়া থেকে ময়মনসিংহ এসে অপেক্ষা করবে এবং আমার বাসটি ময়মনসিংহ পৌছালে সে ওটাতে ওঠে যাবে। কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত হয়নি। ওর সাথে মিলিত হই জারিয়াতে (ঢাকা থেকে বিরিশিরির বাস যেখানে গিয়ে আটকে যেতে বাধ্য হয়)। যাত্রা পথে সোহেল বেশ কয়েকবার ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল কীভাবে কীভাবে যেতে হবে। জারিয়া থেকে কিছুদূর হাঁটা, তারবাদে নৌকায় করে একটা বদ্ধ জলাশয় পাড়ি দিতে হল। এই জায়গাটার নাম শুকনাকুড়ি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর অমর কীর্তি (!) অসমাপ্ত সেতুর পিলার গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। পরাগ জানাল একসময় সোমেশ্বরী বা সিসমাং নদী ভাঙতে ভাঙতে এই পর্যন্ত নাকি চলে এসেছিল। পরবর্তীতে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করলেও এই জায়গাটাতে পানি জমে একটা স্থায়ী জলাশয় তৈরী হয়েছে। শুকনাকুড়ি থেকে বাসে করে নাজিরপুর পৌঁছতেই রাত প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল। নাজিরপুর থেকে মোটর সাইকেলে গেলাম লেংগুড়া বাজার। সোহেল এই বাজারেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কলমাকান্দা থানাধীন লেংগুড়া বাজারে চা-সিগারেট পর্ব শেষ করে রংদী নদীর পাড়ে চলে এলাম। রংদী নদীর উৎপত্তি গারো হিলসে। এই নদীর উৎপত্তিস্থলে একসময় মান্দিদের রংদী মাহারির লোকজনের আখিং ছিল বলে নদীর নামও হয়ে যায় রংদী। সিমসাং নদীর উৎপত্তিস্থলও সিমসাংদের আখিং ছিল বিধায় তারও নামকরণ হয়ে যায় সিমসাং বলে; যদিও পরবর্তীতে তা ‌সোমেশ্বরী নামের মোড়কে আড়াল হয়ে যায়। যাইহোক রংদী নদীর নাম আজও অপরিবর্তিত আছে বিধায় একধরণের তৃপ্তভাব নিয়ে সোহেলের পিছূ পিছু নেমে পড়লাম নদী পাড়ি দিতে। প্যান্ট গুটাতে গুটাতে হাঁটুর উপর অবধি। অন্ধকারে গভীরতা ঠাওর করা যায় না, তার ওপর বেশ খরস্রোতা। বেশ সাবধানতার সাথেই নদী পার হয়ে ভেবেছিলাম রিক্সা বা ভ্যানে চেপে বসব। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। আবারো হন্টন। প্রায় আট-দশ কিমি হাটার পর চেংগ্নী গ্রামে পৌঁছানো গেল। সোহেল জানালো ওদের বাড়িতে বিদ্যূৎ নেই মোবাইলে চার্জ দিতে হলে ওর খালা শাশুড়ীর বাড়িতে চার্জে দিতে হবে। গেলাম সোহেলের খালা শাশুড়ি সমলা রাকসামের বাড়ি। বারান্দায় বসে সমলা মাসীসহ অন্যান্যদের সাথে পরিচয়- আলাপচারিতা-চা পান শেষে পা বাড়ালাম সোহেলদের বাড়ির দিকে। হাটতে হাটতে একটা পাহাড়ি ছড়ার পার হয়ে আরো খানিকক্ষণ হন্টনের পর দূরের কালচে উচু পাহাড়ে একটা বাতি দেখা গেল। সোহেল জানাল ওটা বিএসএফ-র ক্যাম্প। ক্যাম্পের বাতিকে নিশানা ধরে আরো কিছূক্ষণ হেঁটে ও আরো একটা ছড়া পাড়ি দিয়ে সোহেলদের বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় নয়টা। এদিকে ক্ষিদেয় পেটের অবস্থা বেশ নাজুক। বুঝতে পেরে সুপ্তি-র তাগাদায় সোহেল আমাদের হাতমুখ ধোয়ার জন্য নিয়ে গেল ওদের বাড়ির পুব পাশের এক পাহাড়ি ছড়ার দিকে। স্থানীয়রা এটাকে বলেন চেংগ্নী গাঙ। ছড়াতে পৌঁছানোর বেশকিছু দুরত্ব আগেই সোহেল একটা পিলার দেখিয়ে জানালো আমরা এখন নো ম্যানস ল্যান্ডে। ওহ! এটা জানার পর আমাদের অনুভূতিই অন্যরকম হয়ে গেল। এর আগে নো ম্যানস ল্যান্ডে পা রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০০১ সালে, তামাবিল দিয়ে মেঘালয়ে ঢুকার সময়। সামনে পেছনে বিএসএফ আর বিডিআরের শ্যেণ দৃষ্টির মধ্যে। এবার সেরকমটা নয়। কোনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচাল নেই, নেই কোনো ধরনের খবরদারি। পাহাড়ে বিএসএফ-র ক্যাম্প এতটাই দূরে যে ওখান থেকে ছোঁড়া গুলিতে প্রাণনাশ হওয়ার সম্ভবনা নেই এতটুকুও। আর বিডিআর ক্যাম্পতো রেখে এসেছি সেই লেংগুড়া বাজারের কাছে। অন্ধকারে সোহেলের পিছু পিছু নেমে পড়লাম চেংগ্নী গাঙে। হাঁটু পানিতে নেমে পাহাড় থেকে নেমে আসে স্রোতধারায় হাত-মুখ ধুয়ে আবারো চলে এলাম বাংলাদেশের সীমানায়। ওদিকে সুপ্তির ডাকাডাকিতে আমরা তিনজন চলে এলাম রান্নাঘরে। মেন্যু পুরোপুরি মান্দিদের প্রথাগত। বিকেল বেলা সোহেল ভারতের রঙ্গরা বাজার থেকে মিচেং (একধরণের পাহাড়ি লতানো কন্টকময় গাছ, এর পাতা,ডাটা মান্দিরা শাক-সবজি হিসেবে খায়) এনেছিল সেটা নাখাম (শুটকি মাছ) দিয়ে রান্না করা হয়েছে। বেশ ভালোই লাগলো। মিচেং এর নাম আগে শুনলেও এর স্বাদ নেওয়া হয়নি। স্বাদ একটু কড়া ধরনের। মনে মনে সোহেল আর সুপ্তিকে ধন্যাবাদ জানালাম। খাওয়া শেষে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ঘরের বারান্দায় চলে এলাম। দেখি আশপাশের বাড়ির অনেকেই চলে এসেছে নতুন অতিথিদের দেখতে। সুপ্তির বাবা-মা, খালাসহ অন্যান্যদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ জমলো কুপির আলোতে। জমায়েত কিছুটা পাতলা হলে সোহেল আবার রান্না ঘরে ডাকল। দেখি চকচকে গ্লাস তিনটি আমাদের অপেক্ষায়। পাশেই দুটি হুইস্কিও ছোট বোতল। লাজুক হেসে সোহেল জানাল-‍দাদা এইটাতো ব্যাপ্টিস্ট বাড়ি তাই চু রান্না হয় না, রঙ্গরা থেইকা আইনা রাখছি। এইটা দিয়াই আপাতত চালান, আগামীকাল দেখা যাইব-কী করা যায়। পানপর্ব বেশ ভালোই জমে গেল। কত প্রসঙ্গ এলো! ওয়ান্না, রংচুগালা,গালমাকদুআ,এএনভিসি, মিশনারী আরো কত কি! মান্দি চু'তে মোটামুটি অভ্যস্ত হলেও এগুলো তেমন টানতে পারি না। পরাগ রিছিল আর সোহেলকে রেখেই ঘোর নিয়ে আমি চলে এলাম ঘরে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা বুজে আসে। এই সুযোগে চলে আসে ওয়ালজান,পাশে হাতধরা শেরেনজিং। বাজছে দামা, রাং, আদুরি; গাইছে শেরেনজিং-

সিমসাং চি চি দোগিপ্পা চিরিং নাথোক নিকগিজা
দাদা নাঙ্খো নিকগিজা রোনা মানজা দিক দিকসা।

( সিমসাং নদীর জল বিনে মাছ বাঁচে কেমন করে,
তোমায় ছাড়া এই অভাগী সদা ধড়ফড়িয়ে মরে।)

ওমা, একি! বচন নকরেকও যে আবার চলে এলেন। না, বচনদা যা করে করুকগে; আমি আবার দৃষ্টি-মন দিলাম ওয়ালজান আর শেরেনজিং এর দিকে। ওয়ালজান বলছে-

জাকসিওনা জাকসিদেম নাছিল অনা ইয়ারিং
ছাসং গিসিক রানাদে গানবো মিচিক শেরেনজিং।

( কানে দিলাম কানের দুল,আঙুলে আংটি
মনে রেখো অভাগাকে তুমি শেরেনজিং)

৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×