somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : দুটো খুন এবং কিছু দু:স্বপ্ন

০২ রা অক্টোবর, ২০১১ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি এখন যেখানে আছি তার থেকে ফুট পাঁচেক সামনে পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগে খুন হওয়া একজন মানুষের লাশ। লাশটি একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের । সমস্ত দেহ বিন্যাসের মধ্যে বিশাল ভুঁড়িটা দৃষ্টি আকর্ষণ করত সবার আগে। এখন অবশ্য সেটা নেতিয়ে পড়েছে। একটা প্রকাণ্ড আর ধারালো ছুরি এফোঁড় ওফোঁড় করে চিড়ে দিয়েছে লোকটার ভুড়িটাকে। রক্তে গড়াগড়ি! কী বিশ্রী অবস্থা! আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে ।

মানুষ কি করে খুন হয়, এই নিয়ে মনে বিশ্রী রকমের একটা কৌতূহল কাজ করত। প্রায় প্রতি সকালেই খবরের কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে আশফাককে বলতে শুনতাম- খুনের কথা, হত্যার কথা, ধর্ষণের পরে জবাই করে নির্মম ভাবে মেরে ফেলার কথা। আমি ওর গলায় শুনতে পেতাম হতাশার স্বর, মানুষ কি কোনদিন সভ্য হবে না? কত দিন ভেবেছি- খুন, ধর্ষণ এগুলো কী জিনিস, কেউ যদি বলে যেত, পেপারটা যদি পড়ে দেখতে পারতাম !

আমার সেই আকাঙ্খা আজ মিটে গেছে ভয়ঙ্করভাবে । একটা ভয়াল বিভীষিকা এসে যেন নগ্ন করে দিল অসভ্যতার কালো লোমশ বাহুটাকে । এক সাথে আজ দুটো খুনের দৃশ্য দেখতে হল ! প্রথমটি দেখার পরেই আমার সর্বাঙ্গে শুরু হয় ভীতিপ্রদ কাঁপন । আমি চাইছিলাম ছুটে বেড়িয়ে যেতে । পালিয়ে যেতে এ ঘর ছেড়ে অনেক দূরে । কিন্তু পারিনি, ধরের ধারক আমায় ছেড়ে দেয়নি । আমার নড়াচড়া, আমার আকুতি তাকে একটু স্পর্শ করেনি, সে ছিল নির্বিকার ।

দ্বিতীয় খুনটা ছিল আরো নির্মম, আমার জন্যে আরো বেশি কষ্টের। এই ঘরের কর্ত্রী, আশফাকের স্ত্রী সোমা খুন হল আজ রাত্রে। ওর লাশটা পড়ে আছে শুভ্র চাদরের বিছানাতে। অদ্ভুত রকমের এলোমেলো হয়ে আছে চাদরটা। চিড়ে গেছে বেশ কিছু জায়গায় । অবশ্য তা হবার কথাই ছিল। পাষন্ড খুনিটা যেভাবে খুবলে খেয়ে নিয়েছে সর্বস্ব, যেভাবে মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দিয়েছে নিখুঁত নিপুনতায়; যেভাবে নিথর হয়ে পড়া দেহের ভিতরেও খুঁজে নিয়েছে নিজের আদিমতম সুখের ঠিকানা ; তাতে এই শাদা চাদরের ছেড়া কিংবা বিছানার আলুথালু অবস্থা কোন অর্থই বহন করে না। বরং এই জঘন্য রকমের নোংরা হয়ে থাকা বিছানা পত্র- এটা অনিবার্যই ছিল, ঘটনাক্রমের সাথে।

এ গুলো কি ভাবছি আমি? একটু আগে আমার চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল একটা রক্ত মাংসের মানুষ, আমায় যত্ন দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে আপন করে নেয়া সোমা। আর আমি তার মৃত্যুকে ফেলে সাদা চাদরের ছোপ রক্ত আর চিড়ে ফালাফালা হবার বিষয়টা নিয়ে বকে যাচ্ছি ! আমার ভিতরটা কি বদলে গেছে হঠাৎ এই খুনোখুনি দেখে ? আমার চোখের মনিতে কি এখন অশ্লীল নিস্তব্ধতা, অন্তহীন গভীর প্রশান্তি? খুনিটার মতন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবার মানসিক ধীশক্তি আমিও কি অর্জন করেছি? এখন কি সোমা, মৃত একটা লাশ আর কিছু নয় আমার কাছে? আর দশটা সাধারণ মানুষের মত? কে জানে, কিছুই জানি না আমি । আমি, আমি আর ভাবতে পারছি না, আমার চোখ দুটো বুজে আসছে ভীষণ যাতনায়। আমি মুক্তি চাই- নীরব, অটল তুমি আমায় মুক্তি দাও!

***************

দিন সাতেক আগে আশফাক আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিল এই ঘর থেকে। আমায় বলেছিল অপয়া, একটা অভিশপ্ত জিনিস। আমাকে রাখতে চেয়েছিল বসার ঘরের এক কোনে। সোমা বাধা দিয়েছিল বলেই সেদিন আমাকে বের করা হয়নি। তুমি কি জানতে সোমা, তোমার জীবনের কালরাত্রি ঘনিয়ে আসছে একটু একটু করে। অন্ধকারের প্রেতাত্মা গ্রাস করে নেবে, কালো জগতে? জানতে বোধহয়, তাই রাখতে চেয়েছিলে প্রত্যক্ষদর্শী এই অসাড় আমাকে। হায়, আমার কথা তোমরা কি কোনদিন শুনতে পাবে মানব জাতি, আমার ঈশ্বর ?

সেদিন সকাল থেকেই আমার আনন্দ। ওর মুখে অনেক দিন পরে শুনি চেনা সেই গানটা। প্রতিদিন ধুলোর অনাবশ্যক আক্রমন থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতো সে। সেদিন এল অন্য রকম আনন্দ নিয়ে। তখনই বুঝেছিলাম আজকে আমার সুখের দিন। সত্যিই তাই হল। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দেয়া হল আমার জীবনীশক্তির সর্বশেষ ও চতুর্থ অংশটুকু, যার অভাবে আমি ছিলাম অসাড়, মূঢ়। পৃথিবী টিকে আছে শব্দের খেলায়। শব্দহীন জীবন অনর্থক! সোমার বদান্যতা কথা বলার সুযোগ করে দিল আবারো । এর আগে একমাস, আমার কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছিল আশফাক ! বেচারা আশফাক, সামান্য আমাকে অপয়া ভেবেছিলে! কিন্তু কি অপয়া, কি অভিশাপের খপ্পরে পড়েছে তোমাদের সংসার, তুমি জানতেও পারনি।

আমি সেদিন শেষ বারের মত গেয়ে উঠেছিলাম গানগুলি। গেয়ে উঠেছিলাম চিৎকার করে, প্রাণের সবটুকু শক্তি, সবটুকু আনন্দ নিয়ে। আমি গেয়েছিলাম মধ্যরাতে অর্থাৎ বারোটায় ! গেয়েই চলেছিলাম পরের ঘণ্টা দুটিতেও। এর পরেই শুরু হল সোমার দু:স্বপ্ন ।

ঘুমে অচেতন আশফাক, তার পাশে শয়নরতা সোমা। আশফাকের মত সেও ছিল ঘুমিয়ে। কিন্তু সে ঘুম ছিল না আনন্দের, ছিল না পরিতৃপ্তির। বরং মুখভঙ্গিতে ছিল স্পষ্ট ভয়ের রেখা। নিজের গলায় হাত দিয়ে বারবার অদৃশ্য কোন শ্বাপদের হাতকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিল সে। চিৎকার করে বলতে চাইছিল, বাচাও বাচাও! কিন্তু দম বন্ধ করা অন্ধকারের মাঝে হিংস্র কালো হাতের থাবা, তাকে সেটা বলতে দিচ্ছিল না। ওদিকে মুখোশধারী মূর্তিটা বারবার বলছে-তুই মর, তুই মর। শ্বাস রোধ হয়ে আসছে সোমার। এভাবে ছটফট করতে করতেই হয়ত সেদিন মরেই যেত ।

আমি তখন রাত্রি তিনটায় চিৎকার করে উঠলাম তারস্বরে। তখন সোমার চাপা ঘোঙানি চলছিল অবিশ্বাস্য হিংস্রতার আক্রমণে। আশফাকের গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। আকুতির হাত তার পেটের উপর সশব্দে পতিত হয়। তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি মেলে তার। চেয়ে দেখে নিজের থুতনির নিচে হাত দুটি দিয়ে কি যেন সরিয়ে দিতে চাইছে সে, অভিব্যক্তিতে ভয়ের ছাপ। কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে নিজের অজান্তে, ঘুমের মাঝেই ।

আশফাকের সজোর ধাক্কায় ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে সোমা । তার কণ্ঠে শুনতে পাই ফুঁপিয়ে কান্না আর বিভীষিকাময় দু:স্বপ্নের বয়ান। কেউ একজন মেরে ফেলতে চাইছিল, তার জঠরাগ্রে বেড়ে উঠতে থাকা আগামীর স্বপ্নটাকে। বারবার বলেছে তার মৃত্যুর কথা, শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে যাবে কোন এক কালো হাত। সাথে অনাগত ভবিষ্যত, সোমার ছটি মাসের নিরন্তর সাধনার ফল তার বাবুটার জীবন প্রদীপ অমাবশ্যার অন্ধকারে ডুবে যাবার অশনি সঙ্কেত ।

রহস্যময় কালো মুখোশধারীটার শুধু একই কথা- তুই মর, তুই মর। প্রায় প্রতি রাতেই ওর ধস্তাধস্তি হত মূর্তিটার সাথে । প্রথম দিকে যখন মুখোশধারী গলা টিপে ধরতে যেত, তখন সে মুখোশ ধরে টান দিলেই পালিয়ে যেত। এ রকম হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু আস্তে আস্তে আরো রূঢ় রুদ্র মূর্তি নিয়ে সামনে এল মুখোশধারী। প্রতি রাতের স্বপ্নেই ধস্তাধস্তির সময় বাড়ছিল। যদিও মুখোশ টেনেও খুলতে পারত না সে তবুও এই কাল্পনিক হাতাহাতির ফাকে প্রতিদিনই উন্মোচিত হয়ে আসছিল আড়ালে লুকিয়ে থাকা জ্যান্তব কোন হাসি, পিশাচের পৈশাচিকতার নির্মম রূপ। সেদিন সোমা তার মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলে। ভয়ার্ত কণ্ঠে আশফাকের কাছে বলে, সেই খুনি পশুটা আর কেউ নয় আব্দুল ।

******************

আমার এখন ভীষণ হাসি পাচ্ছে । হা হা করে হাসতে ইচ্ছা করছে। মৃত লাশটির নিথর পাপড়ি গুলো মেলে চোখ খুলে দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, মানুষ চেনো তুমি ? চেনো না। তুমি কিচ্ছু জানতেনা সোমা, কিচ্ছু না। চিৎকার করে বললাম, মনের সবটুকু ক্ষোভ নিয়ে, তুমি নির্বোধ । বোকা, একেবারেই অবলা নারী! মৃত্যু তোমার নিজের আয়োজন! আমার কান্না দমকে দমকে আসে, সোমাকে খুব ভালবাসতাম। তার হাসিতে হেসেছি, তার কান্নায় কেদেছি, এখন নিস্তব্ধ তার নিথর দেহের পানে চেয়ে।

ভারী কাপড়ের পর্দার সুতোর ফাক থেকে ঘরে আসছে দু এক ফোটা আলো। এই আলো আসবার সময়টা দেখার জন্য কত রাত আমি জেগে থেকে পার করেছি! কত স্নিগ্ধ অনুভূতি আমাকে ঘিরে রেখেছে এই ক্ষণটুকুতে! কিন্তু আজ কোন স্নিগ্ধতা নেই, কোন মায়া নেই। কোন কোমলতা নেই – আমার চারিদিকে শুধু কদর্যতা। কাদার মত থিকথিকে হয়ে আছে মেঝের রক্ত। অশ্লীল ভাবে বেড়িয়ে আছে গেলে দেয়া ভুড়ি নাড়ির কিছু অংশ ।

সকাল হচ্ছে। আর একটু পরেই আসবে দু:সহ একটি দিন। কত কান্না কত দু:খ, কত মূল্যহীন শান্তনার বানী একে অপরকে দেবে, আর আমাকে তা শুনতে হবে? আমি সত্যিই জানি না কাল সকালে কে এসে প্রথম দেখবে সোমার লাশ? পুলিশ নাকি আশফাক, আমি জানি না, জানতেও চাই না ।

****************

আশফাকের সঙ্গে সংসার শুরুর পর থেকে সোমা খুব আনন্দেই ছিল। অনাথ সে, স্বামীটিও পিতৃমাতৃহীণ। তাই দুজনার ঘরকন্না চলছিল ভালই। সমস্যা দেখা দেয় তার অন্ত:স্বত্তা হবার তিন চার মাস পর থেকে। আমি রাত দুটোর সময়ে কথা বলে উঠলেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রতিদিন একই স্বপ্ন। ডাক্তারের চিকিৎসায় তেমন কোন ফল পাওয়া যায়নি। বারবার বদল হয়েছে ডাক্তার। কিন্তু দু:স্বপ্ন কমেনি, বরং বেড়েছে।

প্রথম দিককার কথা, তখন স্বপ্ন দেখতো দু একটি করে। এর প্রাথমিক ফল হিসেবে সোমার প্রতিক্রিয়া হল বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য। নিজের জগতে গুটিয়ে গেল সে। অফিসে আশফাক যাবার পর থেকে প্রচন্ড একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরত তাকে। সন্ধার দিকে ঘরে ফেরার পরেই আবার সব কিছু ঠিক। সোমার এই আচরণ কেমন যেন একটা মায়াহরিণের শিকার হবার ভয়ে সর্বদা ভীত থাকার মত যে কিনা মায়ের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত। দিনকে দিন পরিস্থিতি হল আরো অস্থিতিশীল, জটিল। দিনের একাকীত্ব অদ্ভুত নেশার মত গ্রাস করল তাকে রাতের বেলাতেও। প্রথমে সপ্তাহ, পরে দু একদিন পরে পরেই দু:স্বপ্ন ।

আমার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলির কথা। ওদের নতুন সংসারে আমি নব সংযোজন তখন। আমি যেদিকে আছি তার ঠিক উল্টো দিকে সোমা দুটো তৈলচিত্র ঝোলায়। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ছবিগুলো। আমি মনে মনে ভাবি কি করে আকে এই ছবিগুলো? এত জীবন্ত! আজ সেই ছবি আমার কাছে আর জীবন্ত মনে হচ্ছে না। আজ বিমূর্ত চিত্রকলার নতুন মানে খুজে পেয়েছি আমি। এই ছবিটি একজন মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের বেচে থাকার শেষ আর্তি টুকুর বয়ান, নিথর হয়ে যাবার আগ মুহূর্তের গোঙানি!

সোমার ভয় দূর করার জন্য সেই স্বপ্নদর্শণের পরে আশফাক অফিসে যায়নি দুদিন। এই দুদিনে তারা ঘুরে বেড়িয়েছে পুরোনো দিনের প্রেমিক জুটির মতন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে হাতে হাত রেখে বসেছিল অনেকটা ক্ষণ। পুরোনো দিনের রোমান্সের স্বাদ দেবার জন্যেই লোকের অগোচরে আশফাক নিজের অধর স্থাপন করে বিষণ্ন সোমার উষ্ণতা হারানো ঠোটে। তাদের ক্ষণিক মিলনের সবুজ করুন খেলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই হারানো হাসি ফিরে আসে তার ঠোটে। ঘরে এসে এই কথা বলবার সময়ও সল্লজ ছিল সোমার মুখ ।

সেই ঠোটে এখন আর কোন আকর্ষণ নেই, থাকতে পারে না। মৃত নিথর সোমার লাল ঠোট দুটোতে বিষ ঢেলে দিয়ে অন্তিম সুখ নিয়েছে খুনিটা। মুখে কয়েকটা কামড়, আরো অসংখ্য আচড়ের দাগ। পারলে বোধহয় কাচা খেয়ে নিত। চাকু দিয়ে কেটে নিয়েছে তার সুপুষ্ট স্তন দুটো। কি বীভৎস! মানুষ এত নোংরা হয় আমার জানা ছিল না। আজ সত্যিই অনেক জানলাম, অনেক শিখলাম। তবে এত বেশি আমিতো শিখতে চাইনি! আমার ঈশ্বরের জাতি আমার সামনেই এমন পাপাচারে লিপ্ত হবে আমি কোন দিন ভাবিনি, ভাবতে পারিনি ।

*************

মেঝের দিকে চোখ পড়ে আমার। হায় বোকা আব্দুল! পারলে না তুমি সোমার বিশ্বাস অর্জন করতে। দিন পনের আগে কেন ঢুকেছিলে শোবার ঘরে? আমাকে বাক্য দিতে, মুখে কথা বলার শক্তি, আমার চলনের চাবিকাঠিটা তুলে দিতে? সেদিনের সেই ভুলের মাশুল তুমি দিলে আজকের মৃত্যু দিয়ে। তুমি নিজে হারিয়েছ এ বাড়ির বাবুর্চির পদ, এই সরকারি কোয়ার্টারে ঢোকার প্রবেশাধিকার আর তরান্বিত করেছ নিজের মৃত্যুক্ষণ। কি ভীষণ দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছিলে তুমি? হায় আব্দুল ।

সোমার রাগত ভঙ্গি এখনো মনে পড়ে। আব্দুলকে সে কখনোই পছন্দ করেনি। আব্দুলের রান্না আশফাকের পছন্দ বলেই কখনো কিছু বলেনি তাকে। অনাবশ্যক ছোক ছোক, খাজুরে আলাপ করতে আসা- এসবই তাকে অপ্রিয় ছিল তার। আর এই ঘটনার পরে আব্দুলকে বদলি করা হল পাশের বাড়িতে। আর আব্দুলের বিদায় বাগানের মালির জন্য হল শাপেবর। এমনিতেই সোমা তাকে পছন্দ করত কম কথা বলার স্বভাবের কারণে ।

প্রায় সকালেই ফুল দিয়ে যেত মালি বাহারউদ্দিন। সংসার ছিল না বাহারের। বিয়ে যাও করেছিল, বউ মরেছে অনেক আগেই। তবে এখন আমার সন্দেহ বউ কি সত্যিই মরেছিল? না কি সে মেরেছিল? কেউ জানে না। তবে নিরাসক্ত নির্বিকার ভাব ধরার অভিনয় করেছিল সে চমৎকার ভাবে। সে নিপুন অভিনয় দিয়ে জয় করে নিয়েছে সোমার মন ।

ওর দিয়ে যাওয়া ফুল সাজাত বসার ঘর থেকে শুরু করে শোবার ঘরটুকু। স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে বাহার উদ্দিন বশ করেছিল তার মন, হিংস্রতার মরণ কামড় দেবার জন্যে। প্রথম প্রথম ফুল দিয়েই চলে যেত সে। দিনে দিনে অবস্থিতি বেড়ে গেল। ফুল দিতে এসে এ কথা, সে কথা তুলত সে। অবশ্য গত কিছু দিন থেকে সোমার শরীর মন খারাপ যাবার কারণে এতে ভাটা পড়েছিল। গত দুদিন সে কাজে যোগ দেয়নি। কাউকে কোন খবর না দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোথায় ছিল কেউ তা জানে না । আজ ফিরে আসে সে, চরমতম আক্রোশ চরিতার্থ করতে ।

****************

সকাল আটটা। পাশের বাড়ির কেউ এখনো টের পায়নি খুনের কথা। অবশ্য পাবেই বা কি করে? এত দূরে দূরে কোয়ার্টার গুলো, রীতিমত বাংলো। তাই কখন পুলিশ আসবে, কখন এই দু:স্বপ্নের সমাপ্তি হবে, আমি জানি না। আশফাকের কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচারা, তুমি তোমার সন্তানের, স্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে রেখে গেলে তাকে, কিন্তু কি হল ?

গতকাল আশফাক ঢাকা যায় অফিসের কাজে। কাল রাতে সোমার খুব ভাল ঘুম হয়েছিল নতুন ডাক্তারের চিকিৎসায়। তাই সকালে উঠে সে বলেছিলে আশফাকের সাথে সেও যেতে চায়। রাতের বেলা, এত বড় দোতলা বাড়িতে একা একা, তার জন্যে অস্বস্তির। কিন্তু অদ্ভুত শব্দের হাসি শোনা, দমবন্ধ ভাব কিংবা মৃত্যু সঙ্কেত সব তুচ্ছ করে দিল আশফাক। কিচ্ছু হবে না– এই চিরকালীন সান্তনার বানী দিয়ে গেল চলে। তার স্ত্রীকে সে চিরতরে হারাবে কি না, সে ভাবনা তার ছিল না। অবশ্য আমিও ভাবতে পারি নি এমন কিছু হবে। হায় দু:স্বপ্নের রাত !

রাত্রি এগারোটায় দুটো কড়া ঘুমের অষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। বোধ করি আব্দুল কিছু টের পেয়েছিল বাহারউদ্দিনের গতিবিধি। সে ছিল বাড়ির দরজার ধারে। বাধা দেয়ার শব্দ, আব্দুলের প্রতিরোধ টের পাচ্ছিলাম ভেতর থেকেই। কিন্তু সোমা ছিল গভীর তৃপ্তির শেষ জাগতিক ঘুমে। এমন করে ঘুমুতে দেখিনি অনেক দিন। কি আশ্চর্য, ক মিনিট পরেই যার ঘুম হবে সর্বশেষ, যখন আর জেগে উঠতে হবে না, তাকে এমন ঘুম মানায়? আমি কত চিৎকার করেছি কিন্তু সে শুনতে পায়নি। আমার জীবনচালিকা ছিল না, ছিল না কোন উপায়। আমি লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে ছাড়েনি মহাকালের মত স্থানু হয়ে থাকা ধূসর দেয়ালটা। মূঢ় আমি কেদে গেছি অনবরত। কিন্তু আমার কোন ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি নেই তাই দেখা যায়নি আমার চক্ষু জল।

হঠাৎ দরজায় ভীষণ আঘাত, ভেঙে গেল শোবার ঘরের প্রবেশদ্বার । অসুরের মতন শক্তি বাহারের শরীরে, সেটা কখনোই জানতে পারিনি। অবশ্য জানবার কথাও নয়। এর আগে আমি দেখিনি কখনো তাকে। সোমার দিকে এগোবার আগেই আব্দুল আবার এসে ধরে ফেলে তাকে । আব্দুলের মুখে রক্ত, ঘুষিতে ঠোট ফাটা । বোধহয় সহকর্মী বলেই তাকে মারতে চায়নি প্রথমে । এ ঘরে প্রবেশের পরেই আব্দুলকে সে শুইয়ে ফেলে লাথির আঘাতে। অন্ডকোষ বরাবর প্রচন্ড লাথি, ককিয়ে ওঠে আব্দুল। এর পরেই ছুরি বের করে খুনিটা। এফোড় ওফোড় করে চিরে দেয় আব্দুলের বড় ভুড়িটাকে। আমি আর্তনাদ করে উঠ । আব্দুলের চিৎকারে ঘুম ভাঙে মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া সোমার ।

বিহ্বল সোমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই কণ্ঠনালী চেপে ধরে অসভ্য, বর্বর লম্পটট । কয়েক মিনিটেই নেতিয়ে পরে এসে। এর পরে মৃতের চরিত্রহরণ আমায় হতবাক করে দেয় । আমি কি করে সেসব সহ্য করলাম আমি জানি না। আমি, সামান্য একটা দেয়াল ঘড়ি! বেজে চলতে হয় মহাকালের আজ্ঞা নিয়ে জীবনকালের সবটুকু ব্যাপী। কত স্মৃতি যোগ হয় জীবনে, কিন্তু এমন অপঘাত সহ্য করে যেতে হবে এমনটা ভাবিনি। চোখ দুটো এখনো বন্ধ করে রেখেছি। জানি না আর কতক্ষণ রাখতে হবে ।

যাবার আগে খুনিটা নির্মম রসিকতা করে গেল আমার সাথে। খাটের পাশের টেবিলে রাখা একটা পেন্সিল ব্যাটারী পেয়ে লাগিয়ে দিয়ে গেল। ইচ্ছে করেই করে গেল, কেননা লাগাবার পরে অসভ্য কণ্ঠের হাসি আর চোখে কৌতুকের ঝিলিক দেখতে পাই। রক্ত মাখা কালো হাতটা, আমার গায়ে লাগতেই ঘিন ঘিন করে উঠল দেহ। এখনো আমার পিছনে রক্ত, সোমা আর আব্দুলের। কি হবে মৃত্যুর পরে এখন আর গান গেয়ে! আমি গাইতে চাইনা এখন আর। কিন্তু নিয়তি আমাকে বাধ্য করে। আমি মুক্তি চাই নিয়তির কাছে।

সকাল নটা। আমি চিৎকার দিলাম। আজকের দিনের শেষবারের মত। দরজায় খুটখাট শব্দ! কে এল আশফাক না পুলিশ? আমি তা নিয়ে ভাবিত নই। আমি শুধু ভাবছি, যেই আসুক এ লাশ সরিয়ে নেবে । আমি খুলতে পারবো আমার বন্ধ করা চোখ দুটো ...

******************..............................****************

উৎসর্গ : বাংলা ব্লগিঙে ব্লগ পাঠ আনন্দদায়ক করার জন্য যে কজন ব্লগারের ভুমিকা অপরিসীম, তাদের একজন হাসান মাহবুব । বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ভঙ্গি ইতিমধ্যেই দিয়েছে তাকে স্বতন্ত্র পরিচয় । ইতিমধ্যেই ছোট গল্পে তার যে দক্ষতা প্রতিভাত হয়েছে তা বৈপ্লবিক । শ্রদ্ধেয় এই ব্লগারকে আমি এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১:১৮
৭০টি মন্তব্য ৭০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×