আজ ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বজিতের বাবা মা এক নতুন দেশ পেয়ে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। একটা সুন্দর সংসার, সবুজ দেশের মাটিতে গড়ে ওঠা তাঁদের কুঠির, আগামী প্রজন্ম এক মুক্ত পরিবেশে বাঁচবে, সংসার সুন্দর সাজে সাজবে-এমন হাজারো স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে চলে তাঁরা। হয়তবা আমি যখনকার কথা বলছি তখন বিশ্বজিতের বাবা মা এক নতুন দম্পতি বা কোন অজানা জায়গায় বাস করা দু’টি মানুষ। যাদের ছিল একরাশ সুন্দর স্বপ্ন, বাঁচার বিস্তৃত আশা। ঘটনার ঘনঘটায় কোন এক মুহূর্তে বিশ্বজিতের পৃথিবীতে আগমন। নতুন শিশু,তাকে ছেড়ে দিল তাঁরা স্থান। ছেলে বড় হল, নিজের পায়ে হাঁটা শিখল, নিজে রোজকার করে মা’কে সন্তুষ্ট করে গড়ে তুলল ছোট্ট একটি সংসার, ছিল ছোট্ট কিছু স্বপ্ন। হ্যা, স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন নেই। এখন সে শুধুই অতীত, শুধুই কানে বাজতে থাকা কিছু নির্মল মুহূর্তের গল্প। বাস্তবতা বীজগাণিতিক সূত্রের মত আবারও প্রমাণ করল-সবার স্বপ্ন পূরণ হয়না।
স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাদেরও, যাঁরা হাজারো ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এনেছিল স্বাধীনতা। যদি কোনওভাবে সেই সাত আর ত্রিশ লাখ মানুষকে কোনওভাবে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা হত-আপনারা কি এমন দেশ চেয়েছিলেন? সবাই একবাক্যে জানিয়ে দিত-না। তাহলে কোনদিকদিয়ে লাভ হল আমাদের? স্বপ্ন কি তাহলে হাত গুটিয়ে বসেই থাকল? হয়তবা তাই।
গণতন্ত্র- মোট ৫টি শব্দ এক হয়ে মিশে গিয়ে গড়ল এক স্বতন্ত্র অর্থ। নামটা মনে পড়লেই মার্কিন ষোড়শ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞাটা সবাই একনিমেষে বলে দেবেন। “DEMOCRACY IS A GOVERNMENT, OF THE PEOPLE,BY THE PEOPLE AND FOR THE PEOPLE”। এখানে জনগণকে বেশি বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হল! আবার গণতন্ত্র=গণের তন্ত্র, অর্থাৎ জণগণের তন্ত্র। জণগণ এর জন্য এবং জণগণ দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থাই গণতন্ত্র। এই সংজ্ঞা যদি ভুল না হয় তবে আমরা কি গণতান্ত্রিক দেশ? না, মোটেই আমরা গণতান্ত্রিক দেশ নই। আমরা শাসনতান্ত্রিক দেশ। এখানে গণতন্ত্র নির্বিকার চিত্তে একদৃষ্টে তাকিয়ে শুধুই কাঁদে। গণতন্ত্রের আপমান হয় এখানে। জনগণ এখানে শুধু বসে থাকা কয়েকটা জনসভার দর্শকমাত্র। শ্রবণ দর্শন আর আমার মত আক্ষেপকারীর সংখ্যা এখানে শতকরা হার ছাড়িয়ে আছে।
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা এই জাত যে কত ভয়ংকর তা বোধকরি একটা পাখিও জানে। আগে জানতাম এই জাতি পাখি শিকার করত, বাঘ শিকার করত। কিন্তু ইদানিং এই জাতি ছোট খাট সব বিষয় বাদ দিয়ে মানুষকেই শিকার করে বসছে! শুনেছি কাক সব ভক্ষন করলেও স্বজাতি কাককে কখন ভক্ষন করে না। এটা ওদের ধর্ম। মানুষ হিসেবে তথা সেরা জীব হিসেবে আমাদের যে কি ধর্ম সে আমার মস্তিষ্কে ধরা পড়ছেনা। এই কাজে নিঊটন, আইনস্টাইনকে নিয়োগ দিলেও তাঁরা হিমসিম খাবে এ আমি নিশ্চিত।
ছোটবেলায় পড়তাম মানুষের কিছু অধিকার আছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক। একটা গণতান্ত্রিক দেশে এ অধিকার সবার জন্য সমান। এর কোনএকটি ক্ষুন্ন হলে তাকে গণতন্ত্র বলা চলে না। সে দিকথেকে বিচার করলেও কি আমরা ডেমোক্রেসিক হতে পারি? না তাও সম্ভব না। আমাদের দেশে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাই পূরণ হয়না। জীবন ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হলেও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শংকিত। মনে হলেই থরকম্প শুরু হয়ে যায় বুকের ভেতর। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক- কেঊ বাদ পড়েনি গুম হত্যা সহ নারকীয় তান্ডবলীলার হাত থেকে। ঘর থেকে বের হলে কে জীবন নিয়ে ফিরবে আর কে ফিরবেনা সে বলা অসম্ভব এমনকি কুসম্ভব! কোন অশরীরী শক্তি বা রূপকথার কোন দস্যু যে করছে তাও না। করছে আমাদের চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু অমানুষ। এদের মানুষ বললে মানবজাতিকে গলা টিপে হত্যা করা হবে। এদের জন্ম হয় সভ্যতার আতুরঘরে আর আচরণ করে অসভ্য কালসাপের মত। সংস্কৃতিক ভাষায় এদের বলা যায় পাপিষ্ট আর অর্থনৈতিকভাবে বলা যায় ক্ষতিকারক...এবং গণতন্ত্রের আলোকে বলব-গণতন্ত্রের হত্যাকারী। এরা একটা মানুষের সাথে হত্যা করে পুরো জাতিকে, হত্যা করে আশা ভরশা আর তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নকে।
“আমি সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রোন্দনরোল আকাশে বাতাশে ধ্বনিবেনা...”- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমি একটা শান্তনার বাণি দিতে চাই-হে কবি আগামী এক হাজার বছর পর্যন্ত আপনাকে অশান্ত থাকতেই হবে। অত্যাচারীর খড়গ এখন রণভূমিতো দূরের কথা ফুটপাতেও শোনা যায়।
অত্যাচার,অত্যাচারী আর অত্যাচারিত-তিনটে কাছাকাছি শব্দের রয়েছে ভিন্ন অর্থ। একটা ঘটলে বাকি দুটিও বর্তমান থাকে। আজ অত্যাচার চলছে হাজারো বিশ্বজিতের উপর। অত্যাচার চলছে পুরো জাতির উপর। অত্যাচারিত হচ্ছে পুরো গণতন্ত্র।
বিশ্বজিত হত্যা নিয়ে মিটিং মিছিলের অভাব হচ্ছেনা। পত্রিকার পাতা জুড়ে আসছে বিশাল বিশাল খবর। এ দোষী সাব্যস্ত ওদোষী সাব্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের উপযুক্ত বিচার হয়ত হবে, হয়তোবা ফাঁসিও হবে। একটা প্রশ্ন- এদের ফাঁসি কেন, হাজারবার কোটি কোটি গুলি করে হত্যা করলেও কি এই দেশ থেকে সকল অত্যাচার দূর হবে? আর কোন অনাচার হবেনা এমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন? প্রশ্ন করুন বিবেককে,সেই মরা বিবেক যে বিবেক হাজার অন্যায় মুখবুজে সহ্য করে, সেই বিবেক যে বিবেক আর্তের কান্না শুনে তাকে না শোনার ভান করে এগিয়ে চলে। আমাদের বিবেক আজ ফরমালিন দেওয়া বিবেক। এর কোন গুণ নেই। এটা কোন কাজের না। ভাবছেন আমি বোধহয় বিচার হোক সেটা চাইনা। না। অপরাধীর বিচার না হলে অপরাধ বেড়ে চলে। কিন্তু তার আগে যার বিচার হওয়া দরকার সে হল এই পাপিষ্ট জাতির, এই জাতির ফাসি হোক-আমি এটাই চাই। এ জাতি কোন মানব জাতি নয়, মানুষ সেজে বেড়ান পশুর মত। এ জাতির মূল্যবোধের ফাঁসি হোক, মানসিকতার ফাঁসি হোক, বিবেকের ফাঁসি হোক এককথায় এই জাতির ফাঁসি হোক।
“আমি খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলি”- মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী’র আদর্শ ছিল এটা। আজ সেই খেটে খাওয়া মানুষ একএকটা কার্টুন, যাদের ইচ্ছামত হত্যা করা যায়, ইচ্ছামত নিয়ে খেলা করা যায়। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কত আশা নিয়ে। সেই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি? নিজের দেশেই আমরা আজ পরাধীন। “প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ,জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ”- শুনেছি গানটা পছন্দ করতেন জিয়াউর রহমান। সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা কি পেয়েছি? কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বলছিনা, মনে প্রাণে আমি এঁদের ভালবাসি,শ্রদ্ধা করি।
সোনার বাংলাদেশে আজ খাঁদে ভরে গেছে। আজ হাজারো বিশ্বজিৎ মায়ের কোল ছাড়া হচ্ছে। মায়ের বুক বিনা কারণে খালি হচ্ছে অহরহ। ভবিষ্যৎ নামে যে কিছু আছে তা বোধকরি কেউ মনে করতে চাইবেননা। গাঁ শিউরে ওঠে। মূল্যবোধ আজ শুণ্যের কোটায় দাঁড়িয়েছে। বাংলার পতাকা আজ সবুজ লাল এর পরিবর্তে শুধুই লাল রঙ্গে ভরে গেছে। নির্বাক জীবন তার আশা ছেড়ে দিয়ে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদে। আর কত, আর কত বিশ্বজিৎ প্রাণ দিলে অত্যাচারীর খায়েশ মিটবে? আর কত মা কাঁদলে অত্যাচারীর পিয়াস মিটবে? জানিনা। মনে হয় আল্লাহও জানেননা। তিনি শুধু দেখছেন। আর সহ্যই করে চলেছেন।
জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে, এ যেন ফিশান বিক্রিয়া, যা শেষ হবার নয়। এ চলবে আর, ধ্বংসের পর ধ্বংস চালিয়ে যাবে। আর আমরা শুধু দেখব। মানবীয় গুণাবলী লোপ পেয়েছে আমাদের। এই কি বাংলার মানুষ?
অত্যাচার মুখবুজে সহ্য কম কোন অপ্রাধ নয়। আর সেই অপরাধে দোষী আমি আপনি আমরা সবাই। একবার চিন্তা করুনতো, আপনি বাঁচার ভিক্ষা চাইছেন আর আপনাকে ঘিরে সবাই হাসছে আর চাপাতি দা ছুরি দিয়ে আপনাকে আঘাত করছে! খুব মজা লাগছে কি? স্বপ্নের ঘরে নয়, একটু চোখ বুজলেই দেখুন আপনার হার্ট পাম্প বেড়ে গেছে। শীতের দিনে শরীর গরম রাখতে গিয়ে সব গাছ যদি শেষ হয়ে যায়,সকল কাঠ খড় যদি পোড়ান হয়ে যায় তখন মানুষ পুড়িয়ে শরীর গরম রাখবেন, আর সেই পোড়াতে পোড়াতে যখন হাজারো বিশ্বজিৎ পুড়ে আর পোড়ানোর কিছু থাকবেনা তখন? তখন আপনাকে পোড়ানো হবে। পোড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা? যদি না নিয়ে থাকি তবে যাতে না পুড়তে হয় তার জন্য কিছু করা এখন সম্ভব কিনা অলস বিবেককে প্রশ্ন করে দেখা যাকনা।
যে দেশে গুণীজনের কদর হয়না সেখানে গুণীমানুষ জন্মায়না। এখানেও যে গুণীজনের সংখ্যা দিন দিন কমেই চলেছে তা পাগলেও জানে। মেধাশুন্য জাতি হতে চলেছি আমরা।
ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যের বাণী যারা শোনাবে তারাই যদি হয়ে ওঠে ভবিষ্যতহীন তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয় বলুনতো? হাস্যকর? না, কষ্টকর?
বিশ্বজিতের পরিবারকে বোঝানোর মত তেমন কিছু আমি জানিনা। শুধু বলব,”মা’গো, দোয়া করো যেন আর কোন বিশ্বজিৎ প্রাণ না হারায়, আর কেউ যেন সন্তানহারা না হয়।“
অনেক কথা বলে চলেছি। হয়ত পাগলের প্রলাপ। ভয় পাচ্ছি, হয়ত সামনে আমার কপালে যে কি লেখা তিনিই জানেন। আমায় নিয়েও হয়ত এমন করে কেউ লিখে ফিলবে অনেক কিছু। হায়রে মানুষ, হায়রে মানবিকতা!
লেখাটি আমার নিজস্ব ব্লগেও পেতে পারেন। আমার ব্লগের ঠিকানা>> ভোরের ব্লগঃবাঁধনের মুক্তআকাশ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:১০