আপনাকে আমি লাঠিপেটা করলে আপনার কেমন লাগবে? যদি বিনা কারণে আপনাকে মেরে ফেলি তবে কি তার বিচার হবে? যদি সবাই আপনার বিপক্ষে কথা বলে? তখন আপনার আত্মীয় স্বজন কি কিছুই করবেনা? বা ধরুন আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে যদি কেউ বিদায় করে দেয় এবং তার কোন বিচার আপনি না পান তখন কি আপনি মুখ বুঁজে সহ্য করবেন? ক্ষমা করবেন, এই প্রশ্ন আমার নয়, আপনার বিবেকের, তাকিয়ে দেখুন বিবেকের দিকে। আসুন কথায় আসি...
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোড়লগিরির পরিধি বাড়ানোর জন্য তিন ইউরোপীয় দেশ- ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানীর মধ্যে প্রতিযোগীতা চলছিল। পুরো পৃথিবীকে নিজেদের দখলে আনার জন্য নানা অপকৌশল শুরু হয়েছিল। যে আপকৌশল এর শিকার আপনি আমি আমরা সবাই।
এই অপকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ফিলিস্তিন। কারণ এই অঞ্চলটি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। জনপ্রিয় সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাজত্ব কালীন সময়ে ফিলিস্তিনকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করার জন্য ব্যপক চেষ্টা চালায় ফ্রান্স। কিন্তু তার আগে থেকেই শুরু হয় ইংরেজ ষড়যন্ত্র!
কথিত আছে পৃথিবীর এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে ইংল্যান্ড বা ব্রিটেনের শাসনসূর্য ওঠেনি। যার হাত থেকে বাদ যায়নি ভারতীয় উপমহাদেশ ও। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু ফিলিস্তিনকে দখলের জন্য তাই নেমে পড়ে দুই বাদ- সাম্রাজ্যবাদ(ব্রিটেন) ও ইহুদি বাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’ বিঘা জমির মত হারিয়ে যেতে থাকে কালের সাক্ষী ফিলিস্তিন।
উসমানীয় সাম্রাজ্য (১২৮৮-১৯২৪) যখন ধ্বংস হচ্ছে তখন দাবার গুটিগুলোকে সামনের দিকে চালনার জন্য ইউরোপগোষ্ঠীর দু’টি ঘোড়ার দরকার হয়, ১) মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের একাংশকে বিশ্লিষ্ট করা এবং ২) বিশ্লিষ্ট অংশের প্রতিটাতে একজন প্রতিনিধি বসানো যারা জি স্যার জি স্যার করবেন।
মুসলিম বিশ্বের পাকা ধানে মই দিতে ১৮৯৭ সালে থিওডোর হার্জেল (১৮৬০-১৯০৪) সুইজারল্যান্ড এ এক সমাবেশে ইহুদিবাদ সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে তাকে ইহুদিবাদের জনক ধরা হয়। তখন কোথায় সংস্থাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি ফিলিস্তিনকে বেছে নেন। জল্পনার শুরু সেখানেই!
উসমানীয় সাম্রাজ্য এই প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় হার্জেল এর সেই আশা তিনি বেঁচে থেকে দেখে যেতে পারেননি। তবে ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায় সূচনা হয় এর পরে, যা কিনা মুসলিম জাতিকে দেশেহারা করে দিয়েছিল এবং সূচনা হয়েছিল এক অদ্ভূত ক্ষমতা বদলের।
১৮৮৮ সালে মিশর ও ১৮৫৭ সালে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজবাহিনী জেঁকে বসে। কিন্তু এই দুই এর মাঝে থাকে ফিলিস্তিন যেটা কিনা পবিত্রভূমি জেরুজালেম এর ধারক। ব্রিটিশ সরকার তাই বহু আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল ফিলিস্তিন দখলের কিন্তু সুযোগ তথা উসমানীয় সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তারা পেরে উঠবেনা এটা তারা জানত। এই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে।
বাংলা সিনেমার মত এক অভূত ট্রাজেডির সূচনা হয় মুসলিম ইতিহাসে। ব্রিটেনের মদদে মাতাল হয়ে মক্কার গভর্নর শরীফ হুসেইন উসমানী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শর্তে বৃটেনের সাথে চুক্তি করেন । বদলে ইরাক ও সিরিয়া সহ গোটা আরব উপদ্বীপ মিলিয়ে একটি বিশাল আরব রাজ্য শাসন করতে দেয়া হবে এই শর্তে হুসেইন রাজী হন নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যা আমরা জানতে পারি McMahon-Hussein Correspondence এর মাধ্যমে।
১৯১৬ সালে হুসাইন এর আক্রমণ এবং পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এর মধ্যখানে(১৯১৭+১৯১৮ এর প্রথম দিকে) ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের সহায়তায় উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে তবে টিনটিনে মুসলিম সাম্রাজ্য টিকে ছিল ১৯২৪ পর্যন্ত।
এদিকে ১৯১৮ সালে নবপ্রস্তাবিত বা নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসংঘ (League Of Nations) ফিলিস্তিনের উপর ব্রিটেনের একাধিপত্যকে স্বীকৃতি দেয়! ফলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ছিল। জোঁকের মত ফিলিস্তিনের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে নিঃশেষ করে ব্রিটিশরা।
শুধু নিঃশেষ করা নয়, ৩০ বছরে(১৯১৮-১৯৪৮) ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি এনে ফিলিস্তিন ভরতে থাকে আর ইহুদিরা নতুন উদ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভিটেমাটি ছাড়া করতে থাকে। আর তা চলতে থাকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদদের মদদে।
রাষ্ট্রসংঘের ইশতেহারে ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্ধেক ভূখণ্ড বরাদ্দ রাখা হয় কিন্তু তা আজও Under construction. সেই সময় এই ইশতেহার এর পক্ষে ভোট দেয় ৩০ টি দেশ, বিপক্ষে দেয় ১৩ টি দেশ এবং ভোট থেকে নিজেদের বিরত রাখে ১০ টি দেশ। ফলে অবাধে ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের রোহিংগাদের মত অবস্থা করে।
কিন্তু হায় তৎকালীন মুসলমান দেশগুলোর এ নিয়ে ছিল ব্যাপক মতভেদ! মুসলমান হিসেবে না হলেও মানবতার খাতিরেও শোনা যায়নি কোন প্রতিবাদ। ’৫০ এর দশকে তৎকালীন ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনের সেই প্রজন্মকে উচ্ছেদ করার ঘোষণা দেন যাতে করে পরবর্তী প্রজন্ম বাপের নাম ভুলে যায়। মনে হতে পারে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হল কবে? হ্যাঁ, ১৯৪৮ সালের ১৫ মে প্রতিষ্ঠা হয় ইসরাইলের যা “নাকাবা” বা “বিপর্যয়” দিবস নামে পরিচিত।
তবে প্রতিবাদী ফিলিস্তিনের রক্তের তেজে ইহুদিদের স্বপন পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি। যার ফলে হয়েছে অসংখ্য যুদ্ধ। ১৯৬৭, ১৯৮২, ২০০৬ আর বর্তমানে ২০১৪ সালে চলছে গণনিধন কার্য। না না! ইসরাইলী নয়, ফিলিস্তিনি নিধন কার্য।
ইসরাইলের বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ কানে সইতে না পেরে জাতিসংঘ দুইটি ইশতেহার জারি করে কিন্তু দুঃখের বিষয় ইসরাইল একটিতেও কান দেয়নি। বরং ২০০২ সালে ৭০০ কিমিঃ দীর্ঘ এবং ৬ মিঃ উঁচু দেয়াল দিয়েছে।
মুসলমান হিসেবে নয়, একটি জাতি হিসেবে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করা এই মানুষগুলোর প্রতি কি আমাদের কিছুই করার নেই? পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ নিয়ে এক চিলতে আলো পাবার অধিকার কি নেই ঐ মানুষগুলোর? বিনা দোষে জীবন গ্রহণের অধিকার কি শুধু যার গায়ে জোর আছে তার?
ইসরাইলের মোড়লগিরি আজও চলছে। হয়ত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মত চলতে থাকবে একটা ফিলিস্তিনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত। রক্ত যাবে যাবে জীবনও। মাঝে পড়ে আমরা দেখে যাব, এটাই দুনিয়ার রীতি।
###বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে অসংখ্য তথ্য নিয়ে এই লেখাটা। কোন ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। কোন তথ্যে কোনপ্রকার ভুল থাকলে জানাতে ভুলবেননা। ধন্যবাদ।
তথ্যসংগ্রহঃ রেডিতেহরান, উইকিপিডিয়া, জুইস ভার্চুয়াল লাইব্রেরী, রিটার্ন অফ ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, গুগল ও লস্ট ইসলামিক হিস্টরি
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০২