somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, 'কেয়ারগিভার' _ হুমায়ুন আহমেদ (পর্ব-২)

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ অসুস্থ হবার পর থেকে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে যে সকল লেখা লিখেছেন সেগুলো আমি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা শুরু করলাম । এই লেখা গুলোতে হুমায়ুন আহমেদের আমেরিকায় চিকিৎসা গ্রহনকালীন সময় এর বিভিন্ন ঘটনা ও লেখকের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। অন্য কোন ব্লগার ভাই লেখাগুলো সংগ্রহ ও প্রকাশ করে থাকলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি লেখাগুলো আবার সবার সামনে তুলে ধরলাম। আজ থাকছে পর্ব-২ ।




কেয়ারগিভার


‘কেয়ারগিভার’ শব্দটির বাংলা—যে সেবা দান করে। স্লোয়ান-কেটারিংয়ে চিকিৎসা নিতে এসে কেয়ারগিভার শব্দের অর্থ নতুন করে জানলাম। হাসপাতালের কাছে রোগী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার কেয়ারগিভার সে রকমই গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারগিভারের নাম হাসপাতালে তালিকাভুক্ত করা হলো—মেহের আফরোজ শাওন। রোগীর স্ত্রী। চিকিৎসকেরা কেয়ারগিভার ছাড়া আর কারও সঙ্গেই রোগ নিয়ে বা চিকিৎসা নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।

রোগীর রক্ত নেওয়া হচ্ছে বা কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে, তখনো শুধু কেয়ারগিভারের উপস্থিতি থাকবে। আর কেউ থাকবে না।
কেমো দেওয়ার পদ্ধতিটাও সুন্দর। প্রথম একজন নার্স প্যাকেট ভর্তি করে কয়েক ব্যাগ ওষুধ নিয়ে আসবে। কেয়ারগিভার ও রোগীকে প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। তারপর সে বিদায় নেবে। আসবে দ্বিতীয় নার্স। সেও একই কাজ করবে। প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। ডাবল চেকিং। যাতে কখনো কোনো ভুল না হয়। ঠিক রোগীকে ঠিক কেমো দেওয়া হচ্ছে কি না, নাকি ভুল অন্য কাউকে দেওয়া হচ্ছে, তার পরীক্ষাও আছে। দুজন নার্সই আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করবে—

তোমার নামের শেষ অংশ কী?
আহমেদ।
প্রথম অংশ কী?
হুমায়ূন।
জন্মতারিখ বলো।
জন্মতারিখ বলতে গিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। ১৩ নভেম্বর আমার জন্ম, পাসপোর্টে লেখা এপ্রিলের ১০ তারিখ। হাসপাতালে পাসপোর্টের জন্মতারিখ লেখা হয়ে আছে। কাজেই যতবার আসল জন্মদিন বলেছি, হইচই শুরু হয়েছে। এই রোগী কি সেই রোগী, নাকি অন্য কেউ? পাত্তা লাগাও, পাত্তা লাগাও। তাড়াতাড়ি করো।

রোগীর সেবা ছাড়াও কেয়ারগিভারকে আরও কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ক্যানসারে আক্রান্তদের অনেক ধরনের সমিতি আছে। তাদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাদের সামলাতে হয়। বেশির ভাগ সমিতিই হলো রোগীর ডিপ্রেশন কাটানোবিষয়ক।
একটি সমিতি দেখলাম, বেঁচে থাকার অর্থ এবং আনন্দ বোঝানোর সমিতি। এক ঘণ্টা বাড়তি বেঁচে থাকাও বিশাল ব্যাপার, এ জাতীয় বিষয়। এর সঙ্গে আছে প্রেয়ার গ্রুপ অর্থাৎ দোয়া পার্টি বা স্পিরিচুয়াল কাউন্সেলিং। সব ধর্মের রোগীদের জন্যই দোয়ার ব্যবস্থা আছে।
আমার কেয়ারগিভার সব ঝামেলা হাসিমুখে সহ্য করে আমার সঙ্গেও সার্বক্ষণিক হাস্যমুখী থাকার চেষ্টা করে। মনে হয়, তাকে হাসপাতাল হাসি হাসি মুখে রোগীর সঙ্গে থাকতে বলে দেওয়া হয়েছে।
একদিন লক্ষ করলাম, সে ঝিম ধরে কম্পিউটারের ফেসবুকের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু।
আমি বললাম, সমস্যা কী?
কেয়ারগিভার বলল, কোনো সমস্যা না। সামান্য মন খারাপ। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
আমি বললাম, আমাকে বলো, দেখি, মন খারাপ কাটানোর চেষ্টা করতে পারি কি না।
তোমাকে বলব না। তোমার মন খারাপ হবে।
আমি বললাম, সহজে মন খারাপ হবে, এমন মানুষ আমি না। বুঝতে পারছি, ফেসবুকে পাঠানো কারও কমেন্ট পড়ে তুমি আপসেট হয়েছ। কী লিখেছে?
শাওন পড়ে শোনাল। কেউ একজন লিখেছে, তোমার উচিত শিক্ষা হয়েছে। আমি খুশি যে তোমার স্বামীকে ক্যানসার দিয়ে আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিলেন। এই শিক্ষা তোমার আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
শাওনের মেয়ে লীলাবতী যখন মারা গেল, তখনো সে এ ধরনের চিঠিপত্র পেত। লেখা থাকত, তোমার কঠিন শাস্তি হওয়ায় আমরা খুশি। আরও শাস্তি হবে। এই ধরনের কথা।
আমি শাওনকে বললাম, পৃথিবীতে মানসিক অসুস্থ অনেক মানুষ। তাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা ভাবব সুস্থ মানুষদের কথা। তোমার ফেসবুকে শত শত মানুষ কত চমৎকার সব কথা লিখছে। লিখছে না?
হ্যাঁ।
এর মধ্যে একজনের কথা চিন্তা করো। সে চলে গেছে মক্কায়, কাবা শরিফে। সেখান থেকে তোমাকে জানিয়েছে, আমি স্যারের জন্য দোয়া করতে এসেছি। শাওন আপু, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। এর পরও কি মন খারাপ করা তোমার উচিত?
শাওন বলল, না, উচিত না।
তাহলে মিষ্টি করে একটু হাসো।
হাসতে পারব না।
বলেও সে হাসল।

আমাদের আশপাশে বিকৃত মানসিকতার মানুষের সংখ্যা কি বাড়ছে? মনে হয় বাড়ছে। একজনের কথা বলি, সে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য হাস্যকর কাণ্ডকারখানা শুরু করল। একটা পর্যায়ে গেটের সামনে স্ট্রাইক করার মতো অবস্থা। মহা বিরক্ত হয়ে তাকে আসতে বললাম। ২৩-২৪ বছরের যুবক। কঠিন চোখমুখ। আমি বললাম, এখন বলো, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? বিশেষ কিছু কি বলতে চাও?
চাই।
তাহলে বলে ফেলো।
আপনার লেখা আমার জঘন্য লাগে।
এই কথাটা বলার জন্য এত ঝামেলা করেছ?
হ্যাঁ! কারণ সরাসরি এই কথা আপনাকে বলার কারোর সাহস নাই। সবাই আপনার চামচা।
আমি বললাম, আরও কিছু কি বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেলো।

সে ইংরেজিতে বলল, আই ওয়ান্ট ইউ টু ডাই সুন।

আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম (ইংরেজিতে), আই হোপ অ্যান্ড প্রে ইউ হ্যাভ আ লং অ্যান্ড মিনিংফুল লাইফ।


.....................................................................................................


নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ_ হুমায়ুন আহমেদ (পর্ব-১)

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, 'বন্ধুবিদায়' _ হুমায়ুন আহমেদ (পর্ব-৩)

চলবে . . .
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৩০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×