somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাহাদুরশাহ পার্ক: এখানে অস্তের উদয় আছে

২০ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাহাদুরশাহ পার্ক: এখানে অস্তের উদয় আছে

মুহিব ইমতিয়াজ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক বাঙালি

জাতির এক দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছে।

আঠার শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড

ক্লাব ছিল, যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্ডাঘর। বিলিয়ার্ড বলের

আকৃতি অনেকা সাদা ডিমের মত ছিল বলে বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা

আন্ডা (ডিম) নামে অভিহিত করত। সেখান থেকেই এসেছে "আন্ডাঘর"

কথাটি। ক্লাব ঘরের সাথেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা আন্ডাঘর

ময়দান নামে পরিচিত ছিল।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য

অস্তমিত হওয়ার একশ বছর পর ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া

ভারতবর্ষের শাসন ভার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘোষনা‌ দেন। রানীর

এই ঘোষনাপত্র পড়ে শোনানো হয়এই ময়দানে। আর তারপর থেকেই

আন্ডাঘর ময়দানের না‌ম হয়ে যায়ভিক্টোরিয়া পার্ক।

সিপাহী বিদ্রোহ এবং পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকদের বর্বরোচিত

ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন

উপলক্ষে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডিআইটি) এর উদ্যোগে এখানে

একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজ

শাসনের পতন ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের শাসন পুনরায়

চালুকরার চেষ্টা করা হয়। তাই তার নামানুসারে পার্কের নাম পরিবর্তন

করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে শেষ হলেও এ যুদ্ধ শুরুহয়েছিলো ১৭৫৭

সাল থেকেই। পলাশিতে স্বাধিনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর এখান

তেকেই আমরা প্রেরণা পেয়েছি ৭১ এর বিজয় সূর্যোদয়ের। এ যুদ্ধে

জীবন দিয়েছেন অনেক বীর।আর আমাদের বুকে জাগরুক করে গেছেন

বিজয় ছিনিয়ে আনার সম্ভাবনা। ১৮৫৭ সালে সম্রাট বাহাদুর শাহকে

ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহের সেই অসম যুদ্ধে

যারা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েছিলো তাদের ফাঁসি দেয়া হয় বর্তমানের

সদরঘাটে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্কে। ফাঁসির পরে শহীদদের গাছে গাছে

ঝুলিয়ে রেখে প্রদর্শনী করা হয়েছিল। শহীদগণের সেই বেদনা বিধুর স্মৃতি

বহন করছে এই পার্কটি।

১৮৫৭ সালে এই পার্কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহে

অন্তত ১১ জন সিপাহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বিদ্রোহের সূত্রপাত ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ সময়

সিপাহীদের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক ধরনের অস্ত্র সরবরাহ

করা হয়। এই রাইফেলের কার্তুজ গরুও শূকরের চামড়া বা চর্বি দিয়ে

তৈরি হয়েছে বলে গুজব ছাড়িয়ে পড়লে হিন্দুও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের

সিপাহীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুসলমানদের কাছে শূকর

অপবিত্র, হিন্দুদের কাছে গরুনিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত। দেশীয় সৈন্যদের

হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজরা এভাবে কার্তুজ তৈরি করেছে বলে

সিপাহীরা ঐকমত্য পোষণ করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

করে। দিল্লিতে আক্রমণ চালিয়ে দিল্লি দখল করে নেয় এবং বাহাদুর শাহ

জাফরকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে ঘোষণা করে।

এদিকে ইংরেজরা বিপুল শক্তি সন্নিবেশিত করে সিপাহীদের নির্মূল ও বন্দী

করে একে একে ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য এলাকা পুনরুদ্ধার করে।

পূর্ববঙ্গে সিপাহীদের মূল ঘাঁটি ছিল ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। ১৮৫৭

সালের ২৬ নভেম্বর ভোরে ইংরেজ বাহিনী লে. লুইসের নেতৃত্বে অতর্কিত

লালবাগ কেল্লা আক্রমণ করে। এর জবাবে সিপাহীরাও পাল্টা আক্রমণ

চালায়। এই যুদ্ধে ৩১ জন সিপাহী নিহত হন। ইংরেজদের পক্ষে নিহত হয় ৫

জন এবং আহত হয় ১৪ জন। তারা ২০ জন সিপাহীকে গ্রেফতার করে। ৩০

নভেম্বর ভিক্টোরিয়া পার্কে ৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। এর আগে

আরও ৮ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

শুধুফাঁসীই নয় মৃত্যুর পর কয়েকদিন পর্যন্ত তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা

হয় ময়দানের গাছের সাথে, যাতে করে লোকের মনে ভয় ধরে যায়। কেউ

যাতে আর বিপ্লবের নাম নেবার সাহস না পায়। ভয় ধরেছিল লোকের

মনে ঠিকই, তবে সেটা বিপ্লবের ভয় নয়, ভূতের ভয়। আন্টাঘরের ময়দান

নিয়ে ঢাকায় নানান ভৌতিক গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল তখন। বাংলাবাজার,

শাখারিবাজার এবং কলতাবাজারের লোকজন সন্ধ্যার পর এই ময়দানের

ধারে কাছে ঘেষতো না।

তবে এই পার্কের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে আরো একটা কষ্টের ব্যাপার

ধরা পড়ে; শোষন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ইষ্ট ইন্ডিয়া

কোম্পানী প্রহসনের বিচার বসিয়ে ফাঁসীর শাস্তি দেয় বিপ্লবী

সিপাহীদের। বিচারের সেই পুরো প্রক্রিয়াটা যাতে নিরঙ্কুশ ভাবে

তাদের পক্ষে নেয়া যায় সেজন্য তারা এর নাম দেয় “সিপয় মিউটিনি”

যার মানে হল সিপাহী বিদ্রোহ। আর্শ্চযের বিষয় আমরাও কথাটা

মেনে নিয়ে দিব্যি বসে আছি। ইতিহাসে এই মহান বিপ্লবকে প্রায়

সবাই নাম করন করছেন সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে। আমাদের দেশে

এতো জ্ঞানী গুনী ইতিহাস বেত্তা বুদ্ধিজিবী আছেন, তারা একবারও

ভাবলেন না যে বিপ্লব আর বিদ্রোহ কখনই এক জিনিস হতে পারে

না। স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবানলে যারা প্রথম স্ফুলিঙ্গ, সবচেয়ে

প্রিয় জীবনকে যারা হাসি মুখে বিলিয়ে দিয়ে গেলেন মানুষের মুক্তির

জন্য, এ মাটির সেইসব শহীদদের বিদ্রোহী নাম দিয়ে আমরা কি তাদের

অপমান করছি না?

এ পার্কের উন্নয়নে নওয়াব আব্দুল গণির ব্যক্তিগত অবদান ছিল। তার

নাতি খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ইংরেজ বন্ধুরা হাফিজুল্লাহর

স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদা তুলে ১৮৮৪ সালে এখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন

করে। শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতিরক্ষার্থে উত্তর দিকে একটি সুউচ্চ

স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। উঁচুবেদির ওপর নির্মিত চার স্তম্ভের

গোলাকার আচ্ছাদনে ঘেরা সৌধটি।



পার্কটিকে ঘিরে ৭টি রাস্তার মিলনস্থান। এর চারপাশে সরকারি

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বেশ কিছুস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকার

কারণে এটি পুরান ঢাকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে

বিবেচিত। পার্কের উত্তরপাশে রয়েছে সেন্ট থমাস চার্চ, একই পাশেই

অবস্থিত ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি পানির ট্যাংক।

উত্তর-পূর্ব কোণে আছে ঢাকার অন্যতম কলেজ কবি নজরুল সরকারি

কলেজ এবং ইসলামিয়া হাইস্কুল, পূর্ব পাশে রয়েছে ঢাকার অন্যতম

প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারি মুসলিম হাইস্কুল, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে

রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। পার্কের ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশেই

রয়েছে ঢাকার জজকোর্ট। এছাড়া, বাংলা বাজার, ইসলামপুর, শাঁখারী

বাজার থেকে বর্তমান ঢাকার নতুন এলাকায় আসতে এ পার্ক এলাকার

রাস্তাটি প্রধান সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাহাদুর শাহ পার্কে দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে রয়েছে নবাবজাদা

খাজা হাফিজুল্লাহ স্মরণে তৈরী স্মৃতিস্তম্ভটি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন

কর্তৃক নির্মিত ফোয়ারা। বাহাদুর শাহ পার্কের গাছপালা বেষ্টিত

ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এই পার্কটি বর্তমানে ঢাকা সিটি

কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় একটি ক্লাবের

উদ্যোগেও এটি এখন বেশ সাজানো গোছানো।

বাহাদুর শাহ পার্কের ইতিহাস আজো আমাদের মনে করিয়ে দেয়-

প্রত্যেক অস্তেরই উদয় আছে।অতএব হিসাবের খাতা নিয়ে আজো

আমরা দেখতে পারি আমরা কতটুকু স্বাধীন আর কতটা অধীন।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×