somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যঃ খালি কলসি বাজে বেশি

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




‘অ্যান এম্পটি ভ্যাসেল সাউন্ডস্ মাচ্’- এইটা একটা ইংরাজি প্রবাদ। আমরা এরে বাংলায় করে দিছি। বাংলায় রূপান্তর করে দিয়ে আমরা বলতেছি-

‘খালি কলসি বাজে বেশি।’

এইরূপে এরে করে দেওয়ার পরে আমাদের বাঙালি মুলুকে এই বাণী ধ্যারধ্যারায়া জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছে। বাঙালির ঘরে ঘরে এই বাণীর বিপুল কদর চলতেছে।

এর কারণ কি?

বাঙালির ঘরে ঘরে খালি কলসির মজুদ কি একটা কারণ? অনুসন্ধিৎসু হওয়ার আগে চলেন আমরা একটু কলসিদের প্রকারভেদ পর্যবেক্ষণ করি।

কলসিরা হয় চার প্রকার। ছোটকালে বাসায় তিন রকমের কলসি দেখছি আমরা- মাটির কলসি, সিলভারের কলসি আর পিতলের কলসি। যেই প্রকার কলসি আমাদের বাসায় বিদ্যমান ছিল না- সেইটা কাঁসার কলসি।



১ মাটির কলসি
রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র- সকল প্রকার শাসনতন্ত্রে মাটির কলসিরা হয় প্রজা।

জন্মের পরেপরেই মাটির কলসিরা কুমারের বাড়ি হইতে ফেরিঅলার টুকরিতে করে বাইর হয় কর্মর সন্ধানে। যিনি কলসিরে কর্ম দিবেন তার কাছে গছাইতে ফেরিঅলায় কলসির ঘেটি উঁচা করে ধরে ঘাড়ে গর্দানে থাবড়া মারে। তখন মাটির কলসি বাদ্য বাজনার ন্যায় সুরেলা টুং টাং ঠ্যাং ঠুং ইত্যাদি আওয়াজ তোলে। এইটাই কি খালি কলসির সেই কাঙ্ক্ষীত বাদ্য বাজনা?

না, এইটা হইল বিক্রেতা তথা মালিক পক্ষর গরিব মারা বিজ্ঞাপন। মাটির কলসিরে মাইর ধইর করে মাটির কলসির সুরেলা এই চিল্লাচিল্লি শোনায়ে বিক্রেতা আসলে বোঝায়- কলসির কোত্থাও কোনও ফাটাফুটা নাই। তাহলে গরিব প্রজা মাটির কলসির সুরেলা এই চিল্লাচিল্লি এইখানে বাদ্য বাজনা না, তার অসহায়ত্ব। এই চিল্লাচিল্লি আসলে কলসির আর্তনাদ।

ফলে মাটির কলসিদের সবসময়ই কর্ম কইরা খাইতে হয়। খাওয়ার পানিরে ঠান্ডা রাখার ব্যাপারে মাটির কলসির খুব নাম ডাক আছিল। মাটির কলসিরে কলের নিচে খুব সাবধানে থুইয়া পানি দ্বারা ভরতে হইত। ভরা হইয়া গেলে অধিক সাবধানে কাঙ্খে লইতে হইত। তারপরে ঘরে-রান্নাঘরে নিয়া ছায়াময় জায়গায় জলকান্দায় রাখতে হইত। সাবধানতার এই চেইনেরে অনুসরণ না করলে মাটির কলসি ফুটা হইয়া হিসুর ন্যায় পানিদের বাইর কইরা দিবে। অনেকক্ষেত্রে ভাইঙ্গাও যাবে। তখন কলসির মিত্যু ঘটবে।

তাইলে আমরা দেখতে পাইতেছি, জন্ম হইতে মাটির কলসি বাদ্য বাজনার মতো বাজতে পারলেও পরবর্তীতে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান তারে বাজতে দেয় না। কেননা মাটির কলসির খালি থাকনের সুযোগ খুব কম। তারা থাকে ভরা। আর ভরা কলসি বাজে না। ভরা কলসির বাজবার নিয়ম নাই।

২.সিলভারের কলসি
এখন আমরা যাব সিলভারের কলসির কাছে। কলসি সমাজে সিলভারের কলসি হয় মধ্যবিত্ত। নতুন থাকতে সিলভারের কলসি বড়ই দৃষ্টিনন্দন। রূপার ন্যায় ঝকঝকা। সিলভারের কলসি হয় কেরাণী টাইপ। মধ্যবিত্তরা লোকেরা যেমন নতুন চাকরিতে যোগ দেয় চাকচিক্যময় পোশাকে। তারপরে যতই দিন যায় ততই তার পোশাক জীর্ণ হইতে থাকে। সিলভারের কলসিও শ্রেণীবিভাজনের টানে কিছুদিনের মধ্যে তার রূপ বরণ লাবণ্য হারায়ে ফেলে। এরপরে এইখানে ট্যামা ওইখানে ট্যামা খাইতে খাইতে তার চেহারা সুরতের নকশা আমূল বদলায়া যায়। কয়দিন পরে সে যে একসময় গোলাকৃতির আছিল সেইটা সে নিজেও বিস্মৃত হইয়া যায়।

বাসা বাড়িতে পানির প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে শীতলতাও গুরুত্ব পায়। ফলে মাটির কলসির যে আলাদা কদর, সেই কদর সিলভারের কলসির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। কিন্তু সিলভারের কলসির ব্যবহার বাণিজ্যিক ব্যবহার পর্যন্ত বিস্তৃত। আর বাসা বাড়ি হইতে ভাতের হোটেল- সর্বত্রই সিলভারের কলসি ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য- অর্থনৈতিক সাশ্রয়। মাটির কলসি হালকা বাড়িবুড়ি খাইলেই ফাইট্টা যাবে, ফুটা হবে কিংবা ভাইঙ্গা যাবে। সিলভারের কলসি ভাইঙ্গা যাবে না। বড়জোর ট্যামাটুমা খাবে।

সিলভারের কলসির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হইল, গরু খাটা মধ্যবিত্ত লোকেদের ন্যায় সে খালি পানি আনা-নেওয়ার কর্ম করে। নিজেরা পানি মজুদ রাখায় কোনও ভূমিকা রাখে না। ফলে কর্মহীন ও খালি থাকবার প্রচুর অবকাশ সিলভারের কলসির আছে। মধ্যবিত্ত লোকেরা নিরীহ হইলেও তাদের ছেলেপেলেরা যেমন নিরীহ হয় না, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে কিছু নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক এলাকার সিলভারের কলসিও এই অবকাশের পর্যাপ্ত ব্যবহার করে। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে বাড়ি খায় আর ড্যাং ডুং ঠ্যাং ঠুং আওয়াজে লোকেদের লগে চাপাবাজি করতে থাকে, ‘আমারে চিনস্? আমি অমুকের নাতি, তমুকের ভাইগ্না।

তারপরে ট্যামা খায়। তবে চাপাবাজ লোকেদের লজ্জা শরম না থাকার নিয়মের ফলে সিলভারের কলসি থামে না। বাজতেই থাকে এবং ধীরে ধীরে তার গোলাকার আকৃতি বদলায়ে গিয়া মূল আকৃতি বিস্মৃত হয় সকলে।

৩ পিতলের কলসি
পিতলের কলসি উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী পর্যায়ভূক্ত। পিতলের কলসিরও খাওয়ার পানিরে শীতল রাখা বিষয়ক একই রকম নাম ডাক আছিল। কিন্তু পিতলের কলসির পরিচিতিতে বলা থাকত তারা হয় একটু সম্ভ্রান্ত পরিবারের। এই কারণে পিতলের কলসি বিশ্বাস করত উৎপাদনে খালি গরিব লোকেরাই ভূমিকা রাখবে। আমার মধ্যবিত্ত আম্মা পিতলের কলসিদের এই ভাবনারে মূল্যায়ন করতেন। পিতলের কলসিরা তাই দেয়ালে ফিট করা কার্নিশে উইঠা ভাব লইয়া উপ্তা হইয়া বইসা থাকত। এই ভাব আপনেরা সিনেমায় জমিদার বাড়ির দোতলার বারান্দায় আরাম কেদারায় বইসা থাকতে থাকা জমিদারের চোখেমুখে দেখতে পাইয়া থাকবেন। আমাদের বাসার কার্নিশে ভাবে বইসা থাকা পিতলের কলসিরাও খাওয়ার পানিরে ঠান্ডা রাখতে কোনও ভূমিকা রাখত না। খালি মাঝে মাঝে নামত গোসল করতে। আমার আম্মা পানিতে তেঁতুল গোলায়া সেই পানি দিয়া পিতলের কলসির সারা গাও ঘষাঘষি করতেন। কখনও কখনও আমার আপাদেরকে ঘষাঘষির দায়িত্ব দিয়া আম্মা সেই ঘষাঘষি তদারকি করতেন। এই তদারকি পিতলের কলসির অর্থনৈতিক অবস্থান জানান দিত। তো দেওয়ালে ফিট করা কার্নিশ থেকে ওঠানামা হইতে ঘষাঘষি পর্যন্ত পিতলের কলসি শোষক জমিদারদের হুংকারের ন্যায় বাজতেই থাকত।

৪ কাঁসার কলসি
কাঁসার কলসির সামাজিক অবস্থান আরও উপ্রে। বিরাট ওজনদার। একেবারে পিতলের কলসির দ্বিগুণ ওজন। আমরা ছোটবেলায় কাঁসার কলসিদের জমিদার আর নবাবদের আসবাবপত্রর সঙ্গে জাদুঘরে দেখছিলাম। তখন দেখতে তারা মলিন আছিল। আর পিতলের কলসির সঙ্গে তাদের বিশেষ কোনও ফারাক আমাদের চর্ম চক্ষে ধরা পড়ে নাই। তবে কাঁসার কলসির সম্ভ্রান্ত ইতিহাস আছে। আমরা বইপত্রে পাইছি, আগেকার দিনে বনেদী পরিবারের লোকেদের সকল তৈজসপত্র কাঁসা দিয়া নির্মিত হইত। কাঁসার তৈজসপত্র ব্যবহার তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য বাড়ায়ে দিত। তাছাড়া প্রাচীন লোকেরা বলতেন, কাঁসার তৈজসপত্র ব্যবহারের সহিত সুস্বাস্থ্যর বিরাট যোগাযোগ আছে।

কিন্তু ইংরাজি বাণী হইতে খালি কলসির বাজনা বাদ্যর জন্মগ্রহণ করছে বিধায় আমারে একটু অনিসন্ধিৎসু হইতে হইল। আমি তখন গেলাম অভিধানের কাছে। অভিধান বলল, ভ্যাসেল হয় বদনা!

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ও! মাজেজা তাহলে এই!

জাদুঘরে গেলে আমরা অবশ্য পুরানা আমলের রাজা বাদশাদের ঘরকন্নার যাবতীয় দ্রব্যর সঙ্গে বদনাও দেখছি। সেইসব বদনা পিতল দিয়া বানানো। কাঁসার বদনাও থাইকা থাকবে। আর আছে নকশা। ওরে নকশা! সে কি বাহারি নকশা! এই নকশা কোনকিছু ছুপাছুপি না কইরা ঘোষণা দিয়া জানায়ে দিতেছে যে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হওয়ার সময়টায় রাজা বাদশা লোকেরা তাদের সঙ্গে সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতেন। তাছাড়া বদনার সঙ্গে তো বাঙালির নাড়ীর বন্ধন...

এই রচনায় বদনার আশেপাশে আমারে ঘোরাঘুরি করতে দেইখা আমার এক সুহৃদ আমারে মায়া দিলেন। মায়া দেওয়া হইলে তিনি আমারে জানাইলেন, ভ্যাসেল হইল জলের পাত্র।

হায়! সহজ সরল পাইয়া অভিধানেও আমার সহিত মজা নিতেছে! তাইলে এখন কার কাছে যাব?! কুতায় যাব?!

পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে, কলসি আসলে খালি হইলেই বাজে না। বাজতে পারাটা কলসির শ্রেণীগত অবস্থান, শ্রেণীগত চরিত্র আর নির্মাতার উপ্রে নির্ভর করে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৫৭
৪টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×