(একটি অখাদ্য রচনা)
আমি হই একজন মূর্খ লোক।
তো মূর্খ একটা লোক হওয়ার কারণে আমার কিন্তু কোনও খেদ নাই। আফসোস নাই কোনও। লোকেরা আমার শিক্ষা সনদ খোঁজে। আমি যে বলি, সনদ নাই- তারা বিশ্বাস করতে অপারগ তাহা। তারা আমার নামের বানান দিয়া খোঁজাখুঁজি করে হেথা-হোথা-শিক্ষা বোর্ড-ইন্টারনেট আর যত্রতত্র। আমার শিক্ষা সনদ খোঁজে তারা। অতঃপর ব্যর্থ হয়ে চুপ মারে তারা। সফল হইলে অবশ্য বলে দিত, পাইছি। বলে না। আমি তখন নামের বানান নিয়া ঘাপটি মারি।
কেননা মূর্খ আমি। বিরাট মূর্খতা নিয়া আমি বুঝতে পারি না, লোকেরা কখন আমার কোন্ কথায় রাগেরে ধরে ফেলে। বুঝি না আমার মতো অকাট মূর্খ অভাজনের অর্থহীন বাক্য তাদের ঠোঁটেরে কেমনে করে ফুলায়ে দেয় অভিমানে। তাদের কইলজারে মারে চিপ। আমার ক্ষুদ্র একটা সরল বাক্যর তারা দশ রকম অর্থ করে।কিন্তু যেই কথাটা সরাসরি বলে দিছি, সেইটাই নাই তাদের আপন অনুবাদ অভিধানে।
না থাকার কারণ অবশ্য আমি ধরে ফেলছি। মূর্খ লোকের কথাবার্তা শিক্ষা করা লোকেদের অভিধানে থাকতে থাকবে, সেইটা কোনও কাজের কথা হবে না।
দেখলেন! মূর্খ হলেও বুদ্ধি আমার খারাপ না। কি বলেন?
কিন্তু আমারে মূর্খ রাখতে চান নাই আমার আপনজনেরা। ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া সমাপ্ত করা আমার ভগ্নী হুজুর সায়েদাবাদীরে দিয়ে কলমের গায়ে ফুঁ দেওয়ায়ে পরম ভক্তিতে রুমাল দিয়ে পেচায়ে এনে দিতেন আমারে। আমিও পরম ভক্তিতে সেই কলম বুক পকেটে গুছায়ে রাখতাম। কেননা সাধারণ এই কলমরে হুজুর সায়েদাবাদীর মাত্র একটা ফুঁ অসাধারণ বানায়ে দিছিল। আর দিছিল আমারে পাঠের যন্ত্রণা হতে মুক্তি। ফুঁ-অলা কলম তো নিজেই লেখতে লেখতে কাগজের প্রান্তে আগায়ে যাবে, তাইলে হুদাই পাঠ করতে যাব- আমি কি এরম বোকা!?
কিঞ্চিৎ পূর্বে আপনেদের কি আমার শাণিত বুদ্ধির উদাহরণ দেই নাই?
কিন্তু ছাত্র যতই মেধাবী আর নিরীহ হোক, লাভ নাই; যদি শিক্ষক হয় দুর্জন। দুর্জন শিক্ষকেরা আমারে পাটিগণিতের বাঁশ বাওয়া ভদ্রলোক বলে খালি যে সন্দেহ করলেন, তা না, জনসম্মুখে প্রকাশও করে দিলেন। আমার অপরাধ, পাটিগণিতের ভদ্রলোকেরে বাঁশে মাখবার তেল কি শিক্ষকগণেরাই সরবরাহ করছিলেন? - এই জিজ্ঞাসা আমার কৌতুহলে আবৃত সহজ সরল মন প্রকাশ করে ফেলছিল।
অথচ শিক্ষকগণ একটাবারও ভাবনা করলেন না, আমি যদি সত্যই পাটিগণিতের বাঁশ বাওয়া ভদ্রলোক হইতাম, তাহলে তো তেল সরবরাহ কে করছে সেইটা জানতে চেয়ে আমার কৌতুহলী মন জিজ্ঞাসু হইত না। সরবরাহকারীর লগে আমার দহরম মহরম খাতির থাকতে থাকত। আমি এমনেই জেনে থাকতে থাকতাম। চিন্তা করেন কি বুদ্ধি! এই বুদ্ধি নিয়া আমার মতো লোকের শিক্ষক হয়ে বসছেন তারা!
দুঃখ।
এদিকে বিদ্যাশিক্ষা করছি শিক্ষক কর্তৃক সেই প্রমাণ না পেয়ে আমার জৈষ্ঠ ভগ্নী-ভ্রাতা আর বাড়ির সকল জৈষ্ঠগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন- আমার মস্তক আসলে সারবস্তু দ্বারা পূর্ণ। এই সংবাদ যে আসলে আমার তরে সুসংবাদ, সেইটা তখন বুঝি নাই। আজকে বুঝে ফেলছি। খবরের কাগজে দেখি, ইন্ডিয়ার একটা মাইক্রো বায়োলজিস্ট লোকে গোবর দিয়ে সাবান, শ্যাম্পু, কফি- এগ্লা বানায়ে বানায়ে বেচাবিক্রি করে আড়াইশ' কোটি রুপির মালিক হয়ে গেছেন।
ইন্ডিয়ার নাগরিকত্ব আইন বিরোধীদের আমার অনেক অনেক শুভকামনা। তাদের আন্দোলন সফল হলে ইন্ডিয়া যাইতে হবে। গেলে পরে আমার মস্তকের মূল্যায়ন ইন্ডিয়ার লোকেরা নিশ্চয়ই করবে।
যা বলতেছিলাম, তো প্রবল বিদ্যাধরী আমার জৈষ্ঠ ভ্রাতা মোটে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজার। আমার তো বিদ্যা নাই। কোম্পানির মাল্টি ন্যাশনালেরা মূর্খ লোকেদের ম্যানেজার হতে দিতে রাজি না। কিন্তু বিদ্যান লোকেদের বাঙালি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের হইতে হয় বলে তারা ভাবে না, হোক আম্রিকার, চাকরি তো। আসলে মধ্যবিত্তদের মজ্জাগত দ্রব্য হইল, ‘সব হারানোর বেদনা।’
এই সব হারানোর বেদনায় তাদেরে উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে দিতে রাজি না। এরা যেথায় যেথায় যায়, হেথায় হেথায় খালি নিরাপত্তা খোঁজে। এই নিরাপত্তার নাম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তা ব্যবহারে এরা নিজেদের পুঁজিবাদী কামনা বাসনা পূরণ করবার প্রয়াস পায়। ফলে মধ্যবিত্তর কাছে 'সব হারানোর বেদনা' খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা জীবনের সকলই হারায়ে ফেলবে। জীবনরেও হারায়ে ফেলবে। কিন্তু 'সব হারানোর বেদনা' কোনও দিনও হারাবে না।
সেই কারণেই এই জগতের সকল ব্যবসা- মুদি দোকান হইতে মাল্টিন্যাশনালদের বাণিজ্য, সকলই নিয়ন্ত্রণ করে খালি নিম্নবিত্তরা আর উচ্চবিত্তরা। মধ্যবিত্তরা দুনিয়ার তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কামাই করা ডিগ্রিদের নিয়া ‘কাজের বেটি রহিমা’ হয়ে তাদের সেসব বাণিজ্য স্রামাজ্য সামাল দেয়।
আমাদের জৈষ্ঠ এখন অবশ্য ন্যাশনালিস্ট হইছেন। চাকরি আর তার ভাল্লাগে না তাই ছেড়ে দিছেন।ছোটকাল থেকে জৈষ্ঠ ভ্রাতার মতো হইতে হবে শুনতে শুনতে শ্রবণ আমার দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে, জালের ন্যায় ছেঁদা ছেঁদা হইছে,
আমাদের পাড়ায় কান পরিষ্কার করতে আসত যারা, তারা সাক্ষী।
অবশেষে আমিও এইবারে, এই এতগুলা বছর পরে, আমিও তার ন্যায় হইতে হইছি। আমিও মাল্টি ন্যাশনালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ন্যাশনালিস্ট হইছি। কিন্তু হায়! শিক্ষিত হওয়া আমার আর হইল না...
জ্বি!? 'কিন্তু হায়!' বলাবলিতে খেদ প্রকাশ পাইছে!? হায় হায়! বলেন কি! আচ্ছা ঠিক আছে, ‘কিন্তু’-রে বাদ।
'ধুরো, শিক্ষিত হওয়া হইল না তো বয়েই গেল।'
-এইবার ঠিক আছে না?
তো সমস্যা এখন ভিন্ন জায়গায়- ন্যাশনালিস্ট হওয়ার পড়ে জৈষ্ঠ ভ্রাতা এখন রাত জেগে জেগে পরহেজগার মূলক কর্মকান্ড করেন। তখন নীরব নিরালা নিজ্ঝুম বাড়িতে তিনি বিভিন্ন লোকজনের অস্তিত্ব টের পান। তারা নাকি এই দুনিয়ার না। আগে ছিলেন। এখন নাই। তারা নীরবে নিভৃতে হাঁটাচলা করেন। তিনি তাদের হাঁটাচলার আওয়াজ পান, তাদের ফিসফিসানি শ্রবণ করেন। কিন্তু তিনি অবাক হন না। সাহসী লোক তিনি। যৌক্তিকও।
সকালে আমাদেরে যুক্তি দিয়া গল্পে গল্পে বলেন, এরা নাকি হয় অশরীরী।
তখন মূর্খ আমি বলে ফেলি, হাঁটতে গেলে তো শরীল লাগবে, পাও লাগবে, শরীলের ওজন পায়ের উপ্রে ভর দিলে তবেই হাঁটাচলায় শব্দ হবে। অ-শরীলী যারা, তাদের হাঁটবার ঠেকা কি! মানে শরীলবিহীন লোকেরা যারা যারা, তারা তারা হাঁটাচলা করবে কেমনে! তারা বড়জোর হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে পারে। আর কথাবার্তা বলতে গেলেও তো জিবলা লাগবে, কন্ঠনালী লাগবে, লাগবে ফুসফুস। বুকের গহীনে ফুসফুস হাপড়ের মতো জাতা না দিলে তো কথাবার্তা গলা দিয়া বাইর হবে না!
তখন বাড়ির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আমার পানে একযোগে চায়। তাদের সে চাউনি করুণা দ্বারা পরিবেষ্টিত, মায়া দ্বারা টইটুম্বুর। বাড়ির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী পরিবেষ্টিত করুণা আর টইটুম্বুর মায়া দ্বারা- অভ্যন্তরে আমার মূর্খতা বিষয়ক খেদ নির্মাণ করতে চায়। তাদের সে দৃষ্টিতে তাদের মতো আমার যে উচিত শিক্ষা নাই, সেই না থাকার দুঃখ বিদ্যমান হয়ে বিরাজ করতে থাকতে থাকে।
কিন্তু তবুও অভ্যন্তরে আমার মূর্খতা বিষয়ক খেদ নির্মাণ হয় না। ফুঁ দেওয়া কলমে একলা একলা কাগজে ঘষাঘষি খেলা খেলবে, কাগজে-কলম ঘষাঘষি খেলাধুলার যে নির্মল আনন্দ, আমারে সেই আনন্দ পাইতে দিবে না- এইটা আমার কৌতূহল আবৃত সহজ সরল মন মেনে নিতে রাজি না। শরীর স্বাস্থ্য হাত পাও না থাকা লোকেরা আন্ধার ঘরে হাঁটাচলা করবে, ফুসফুস গলা জিবলা ঠোঁট না থাকা লোকেদের ফিসফিসানি শুনতে আমার শ্রবণ প্রস্তুত হইতে চায় না।
শূন্য পাকস্থলী নিয়া কারও বাড়িতে বেড়াতে গিয়া প্রমিত ভাষায় ‘খেয়ে এসেছি’ বলতে আমি পারব না। কুঁচকুঁচা কালা জাকিরে চোখে ধান্ধা লাগা কমলা রঙ পোশাক পরে যখন জিগাবে, ‘দেখো তো কেমন দেখাচ্ছি? রঙটা মানিয়েছে?’
প্রত্যুত্তরে, ‘বাহ্! দারুণ দেখাচ্ছ তো!’ বলে উত্তর দেওয়ার ঠেকা আমার মুখের নাই।
আবার কারও সৌন্দর্য দেখলে যদি মনে হয়, ‘ইনি আরেকটু কম সুন্দর হইলে এই দুনিয়ার তেমন ক্ষতি বৃদ্ধি ছিল না। ইনি হুদাই একলা একলা এত্তগুলা সৌন্দর্য নিয়া পৃথিবী হয়ে বসে আছেন। নিশ্চয়ই তার এতগুলা সৌন্দর্য হওয়া অপরাধ।’ -এই মনে হওয়া কথাবার্তাও তারে আমি বইলা দিব।
কিন্তু আমি ভুলে যাই এই দুনিয়া আমার ন্যায় সহজ সরল দুনিয়া না। মূর্খতা বিষয়ক কোনও খেদ নাই বলে আমার মনে থাকে না,আমি হই একটা মূর্খ লোক। বস্তুত এই মনে না থাকাই হয় খেদ, যিনি আমার অভ্যন্তরে নাই। আমার শিক্ষা সনদ খোঁজাখুজি করা লোকেরা বস্তুত সনদের নামে এই খেদেরেই খোঁজাখুঁজি করতেছেন। লোকেদের আসলে এই খেদেরেই দরকার।
এখন এই খেদেরে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলতে হবে। খুঁজে পাওয়া গেলে তখনই কালা জাকিরের পরিহিত ক্যাটক্যাটা কমলা রঙে দেখে মুগ্ধ হওয়া যাবে। তখন তারে বলে দেওয়া যাবে, ‘জার্মানের ধলা ধলা মেয়েগুলা তোমারে খুঁজে।’
সৌন্দর্যর পৃথিবী হয়ে থাকা নারীরে প্রমিত ভাষায় বলে দিতে হবে, 'শোনো, বাহ্যিক সৌন্দর্য কিছু অর্থ বহন করে না। ট্রয় আসলে ক্লিওপেট্রার রূপের কারণে নয়, তার কবিতার মতো মনের কারণেই ধ্বংস হয়েছিল। ক্লিওপেট্রার বাহ্যিক সৌন্দর্য আসলে কোনও ঘটনা না। বস্তুত তোমার শরীর আর মুখমণ্ডল আমাকে আকর্ষণ করে না। আকর্ষণ করে তোমার হৃদয়'
এসব কথাবার্তা আমি এমনে এমনে বলতে পারব না। বলতে হলে খেদেরে খুঁজে পাওয়া লাগবে। খেদ আমারে প্রশ্ন শিক্ষা করবে, 'হোয়াই আই মূর্খ?' প্রশ্নর উত্তর পাওয়া গেলে তখন অশরীরী লোকেদের হাঁটাচলা শ্রবণ করব। ফুসফুস গলা জিবলা ছাড়া তাদের ফিসফিসানিও শুনে ফেলব।
আচ্ছা, হুজুর সায়েদাবাদীর কাছে গিয়া দুই চক্ষে ফুঁ দেওয়ায়ে আসি যদি, তাইলে কি বিদ্যুতের বেগে খেদেরে খুঁজে পাওয়া যাবে?
নাকি বাঁশ পড়া দিব?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৪৪