এটা আমার খুব প্রিয় একটি সায়েন্স ফিকশন গল্প । লেখক শেখর বসুর একটি অন্যতম বিখ্যাত গল্প.। ভালো লেগেছে।আশাকরি আপনাদেরও ভাল লাগবে'
আর্টলিট মেশিন
শেখর বসু
২১ ডিসেমর,২০৮৫ এই তারিখটি মানুষের ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকবে।এই দিন, অর্থাত আজ থেকেই সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ পণ্ডশ্রমের হাত থেকে বেঁচে যাবে।এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আর্টলিট মেশিন আজ থেকেই আমরা বাজারে ছাড়লাম। একদল বিশেষজ্ঞ নানাভাবে পরীক্ষা করে র্য দিয়েছেন শিল্প সাহিত্য যারা ভালোবাসেন মেশিনটি তাদের সবরকমের খোরাক মেটাবে।
বই কেনার জন্য কাউকে দোকানে যেতে হবে না। এই মেশিনটির সাহায্যে ঘরে বসেই আপনার সব প্রয়োজন মিটে যাবে।
মেশিনটির একটা রিকয়ারমেন্ট বক্স আছে। সেই বক্সে আপনি শুধু আপনার প্রয়োজনটুকু জানিয়ে দিবেন। ধরুন আপনার একটা হাসির গল্প শোনার ইচ্ছা হয়েছে আপনি সেই কথা রিকয়ারমেন্ট বক্সকে জানিয়ে দিবেন। বক্স অমনি আপনাকে একটা হাসির গল্প শুনিয়ে দেবে।গল্পটি কারোর লেখা নয়, আর্টলিট মেশিনের বানানো। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, সে গল্প শুনে আপনার পেটে খিল ধরে যাবে।
হাসির গল্পের বদলে আপনি যদি একটা দুঃখের গল্প শোনার ইচ্ছে হয় তবে আর্টলিট মেশিন সেই গল্পও আপনাকে শোনাবে। এমন দুঃখের গল্প যে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে আপনার বুক ভেসে যাবে।শুধু এই দুই ধরণের নয় যেকোনো গল্পই মেশিন আপনাকে শুনিয়ে দেবে।ডিতেক্টিভ, অ্যাডভেঞ্চার, কল্প কাহিণি এমন কি ক্লাসিক ধাঁচের গল্পও। ছড়া কাটা বা কবিতা শোনানো মেশিনের কাছে কোনো সমস্যাই না।
সুন্দর সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী মেশিন এমনভাবে বলে যাবে যে আপনার মনে হবে, আপনি নিজেই সে সব জায়গা ঘুরে দেখেছেন।এই মেশিনে আপনি সব পাবেন। যে জিনিস সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই তাও পাবেন।
মেশিনকে শুধু বলতে হবে অকল্পনীয় কিছু শোনান। ব্যস জীবনে আপনি যা কোনোদিন শুনেননি তাই আপনাকে শুনিয়ে দেবে মেশিন। শুনতে শুনতে বারবার চমকে উঠবেন আপনি।
যদি আপনি ছবির ভক্ত হন, মেশিন আপনাকে গাদাগাদা ছবিও দেখাবে। সব ছবি ভেসে উঠবে মেশিনের স্ক্রীনে। রিকয়ারমেন্ট বক্সকে শুধু জানাতে হবে কি ধরণের ছবি আঁকতে চান আন্রিয়েলিস্টিক নাকি অ্যাবসার্ড।আর্টলিট মেশিনের স্ক্রিন এমনভাবে তৈরী যে ছবি দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে আপনি কোনো গ্যালারির মধ্যে ঘোরাফেরা করছেন।যেসব ছবি সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই সেসব ছবিও মেশিন আপনাকে দেখাতে পারবে।
আর্টলিট মেশিনের মূল পরিকল্পনা ড.জুলিয়েট ড্রেকের।তাঁর কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই । এই মেশিনটি তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফল।
তিনি জানিয়েছেন গত শতাব্দীর দুটি ঘটনা তাকে এই মেশিনটি উদ্ভাবন করতে প্রেরণা দিয়েছে। ঘটনা দুটি আমরা উল্লেখ করতে পারি।
১৯৬৩ সালের শীতের নিউইয়র্কের মর্ডান আর্ট মিউজিয়মে একটি ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল।প্রদর্শনীতে হেনরী মাতিসের একটি ছবি ছিল।প্রদর্শনী চলেছিল প্রায় দুই মাস। এই দুমাসে দর্শক এসেছিলেন প্রায় দুই লক্ষ।তাঁদের মধ্যে ছিলেন অনেক নামজাদা শিল্পরসিক , বাঘাবাঘা শিল্পসমালোচক আর বেশ কয়েকজন দুঁদে আর্টডিলার।সবাই হৈ হৈ করে মাতিসের আর্টের বিস্তর প্রশংসা করছিলেন। শেষে একটা ছোট্ট ভুল ধরা পড়লো। ভুলটা ধরেছিলেন মাতিসের ছেলে। প্রদর্শনী শেষ হবার মুখে তিনি জানালেন, ছবিটা উলটো করে টাঙানো হয়েছে !
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপের একটি দেশে। শিল্পের এক পৃষ্ঠপোষকের মাথায় নিত্যনতুন মতলব ঘুরতো। তিনি একটি ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এই প্রদর্শনী সবার কাছেই এক আশ্চর্য অভুজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
বিজ্ঞাপনের জোরে ছবির প্রদর্শনী দেখতে দর্শক ভেঙে পড়ল। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগ্ল নতুন প্রতিভাকে। অসাধারণ সব ছবি। এমন ছবি আগে দেখা যায় নি। কিন্তু শিল্পী কোথায়?
পৃষ্ঠপোষক জানালেন শিল্পী দেখা দেবেন প্রদর্শণীর শেষ দিনে।সেদিনের ভিড় দেখার মত। নতুন প্রতিভার সাক্ষাতকার নেবার জন্য শিল্পসমালোচকদের লাইন পড়ে গিয়েছিল।
যথাসুময়ে দেখা দিলেন শিল্পী, কিন্তু তাকে দেখে সবার মাথা ঘুরে গেল। শিল্পী মানুষ নন । শিক্ষিত শিম্পাঞ্জী।প্রদর্শনীর ছবিগুলো তারই আঁকা।
গত শতাব্দীর এই দুটি ঘটনার দিকে তাকিয়ে জুলিয়েট ড্রেকের মাথায় নতুন করে একটা তরঙ খেলে গিয়েছিল।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পের সমঝদারি করা মানুষের একটি প্রাচীন অভ্যাস।এই অভ্যাস চলে আসছে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের আমল থেকে। বহু যুগ ধরে এই অভ্যাস চলে আসার ফলে মানুষ অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ছে। এটি যদি নিছক অভ্যাস না হত তাহলে যে কেউ মাতিসের উলটো ছবিটিকে ধরে ফেলতো।
এবং মানুষ ছাড়াও যে আরো কারোর পক্ষে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব তার প্রমাণ অই শিম্পাঞ্জির আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ি এমন কিছু ছিল যা ঠিক মানুষের আঁকার মত।
এই তত্ত্বের উপর নির্ভর করে ড.ড্রেক তাঁর গবেষণার কাজ চালাতে লাগলেন। শিক্ষিত শিম্পাঞ্জি যদি ছবি আঁক্তে পারে তবে শিক্ষিত রোবোটও ছবি আঁকতে পারবে।শুধু আঁকা নয় তার পক্ষে সাহিত্য সৃষ্টি করাও সম্ভব।
ড.ড্রেক শেষ বয়সে এসে দীর্ঘ গবেষণা শেষে সফল হয়েছেন।
আর্টলিট মেশিনের ক্ষতিকর কোনো দিক নেই।এই মেশিনটি আবিষ্কারে ফলে মানুষ নিম্নমানের কোনো বই পড়া কিংবা ছবি দেখা থেকে বেঁচে যাবে।
সবচেয়ে বড় লাভ হবে শিল্পী সাহিত্যিক গোষ্ঠীর, শিল্পসাহিত্য করার নামে পৃথিবীর কয়েককোটি লোক যে পাগলামো করতো ।পণ্ডশ্রম করতো তারা আর পাগলামো করবে না।বিশাল এই জনসমষ্টিকে ভাল কাজে ব্যবহার করা যাবে। তাদের শরীর মন ভাল থাকবে। তারা আর আকাশের চাঁদ তারার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে না, খ্যাপারমত কাগজ কলম বা ক্যানভাসের উপর উপর হ্যে পড়বে না।
তবে আর্টলিট মেশিনের গ্রাহকদের সামান্য একটু সতর্কতা নেবার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।আমাদে অবশ্য দৃঢ় বিশ্বাস, সতর্ক্তামূলক ব্যবস্থা আপনাদের বেশি দিন নিতে হবে না। এই অবস্থা শিল্পী সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে।
আর্টলিট মেশিন চলাকালে আপনি যদি দেখেন কোনো উল্টোপাল্টা জামাকপড় পড়া উষ্কখুষ্ক চুলের কোনো লোক মেশিনের দিকে তেড়ে আসছেন আপনারা তাকে থামাবেন।এই লোকটি হয় শিল্পী না হয় কবিসাহিত্যিক।অনধিকারচর্চার অভিযোগ তুলে লোকটি যন্ত্রটিকে অকেজো করে দিতে পারে।
আমাদের অনুরোধ আপনারা তাকে মারবেন না। না মেরে মেশিনের কার্যকারিতা বোঝাবেন, আর্টলিট মেশিন মানুষের চেয়ে কত ভাল শিল্প সাহিত্য রচনা করে। সম্ভব হলে তার পছন্দের দু একটি উদাহরণ শোনানো হলে বা দেখা হলে ওই শিল্পী বা সাহিত্যিকটি আর্টলিট মেশিনের বশ হয়ে যাবে।তখন সে আর মেশিনের সাথে শত্রুতা করবে না।অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে নিজেই হয়ে উঠবে ওই মেশিনের ভক্ত গ্রাহক।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৪