somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফোর্ট বায়ার্ড

০৪ ঠা মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৬৬৬ সালে কলবার্ট (লুই চতুর্দশ অধীনে ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী) সামরিক জাহাজ নির্মাণ জন্য একটি শীপইয়ার্ড নির্মাণ করার চিন্তা করেন যা রোচফোর্ট শহরের কাছাকাছি চেরেনেট নদীর মুখে অবস্থিত। কিন্তু শীপইয়ার্ডটি শত্রু জাহাজ আক্রমণ থেকে অরক্ষিত ছিল। চেরেনেট এর মুখটি ছিল দ্বীপের চতুর্দিকে থাকা দূর্গের বন্দুকের নলের সম্মুখে, যা খুব কঠিন ছিল না। উপরন্তু সে সময়ে অনেক যুদ্ধের নেতৃত্ব ফ্রান্সের হাতে ছিল এবং প্রতিরক্ষা বাতুলতা ছাড়া শত্রুর জন্য এই সুস্বাদু খাবার ছেড়ে দেয়া ছিল বোকামী। সে সময়ে ফরাসিদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সবচেয়ে শক্তিশালী দ্রুতগামী মালিকানাধীন ইংল্যান্ড। সুতরাং ফ্রান্সের রাজা এবং তার মন্ত্রীপরিষদের জন্য শীপইয়ার্ডটি রক্ষা করা একটা সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়।

চেরেনেট নদীর একসম ও ওলেরন মুখের কাছাকাছি অবস্থিত মেজহ্‌দু নামক দুটি দ্বীপ যার তীর ছিল সম্পূর্ণ বালির। যেহেতু আপনি জানেন বালির উপর একটি কঠিন ঘর গড়া অসম্ভব সেখানে আমরা দুর্গ সমপর্কে কি বলতে পারি! যাইহোক, নেতৃস্থানীয় প্রকৌশলী ক্লিরভিল দুর্গ নির্মাণের একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ফ্রান্সের মার্শাল সেবাস্টিয়ান লে প্রেটরে ডি ভাউবান যিনি একজন সামরিক প্রকৌশলীও ছিলেন, এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করেন এবং রাজার কাছে তার মতামত প্রকাশ করেন “মহামান্য, এই স্থানে দূর্গ নির্মাণ করার চেয়ে দাঁত দিয়ে চাঁদ আয়ত্ত্ব করা সহজ।" ফলে নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়নি এবং তা পরিত্যক্ত হয়।

১৭৬৩ সালে, সপ্তবর্ষের মহাযুদ্ধের (লুই ষোড়শ রাজত্বের সময়) শেষে ব্রিটিশরা আবার এই অঞ্চলের দুর্বলতা দেখে তা আয়ত্ত করার চেষ্টা চালায়। দুর্গ নির্মাণ প্রশ্ন আবার উত্থাপিত হয়। খসড়া ছিল, কিন্তু খুব ব্যয়বহুল হওয়ায় তা আবার প্রত্যাখ্যাত হয়।


পরবর্তী শতকের ১৮০১ সালে এই প্রকল্প আবার ফিরে আসে। এই বছরের জুন মাসে, সামরিক যৌথ কমিশন এবং বেসামরিক নির্মাণ কমিশন এ প্রকল্পে হাত দেয়। ফেব্রুয়ারী ৭, ১৮০৩ সালে প্রকল্প রাষ্ট্রপ্রধান নোপেলিয়ন বোনাপার্ট দ্বারা অনুমোদিত হয়। বালুর সৈকতের উপর নির্মাণ কাজ করা সত্যিই দুষ্কর ছিল তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পাথরের ঢিপি নির্মাণের। কাজ ১৮০৪ সালে শুরু হয়। এর নির্মাণ জটিলতা কল্পনা করা অসম্ভব। স্থানীয় পাথরের স্তুপ থেকে পাথরের ব্লক নিষ্কাশিত উন্মুক্ত সমুদ্র মধ্যে আনা এবং বালির বিছানায় ডামপ করা হয়। প্রযোজনা কাজ শুধুমাত্র ভাটা এবং শুধুমাত্র বছরের যে সময় উপকূলীয় এলাকা খেয়ালী প্রকৃতি থাকে সে সময় করা হয়। নির্মাণাধীন তৃতীয় বছরের সময় দেখা যায় যে নিজস্ব ওজনের ভারে পাথর ব্লক বালির মধ্যে আরও গভীরভাবে ঢেবে যায়।

এই কাজ সমন্ধে কি ভাল আলোচনা করা হয়েছে? ১৮০৭-১৮০৮ এর শীতকালে এক হিংস্র ঝড় যা প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস ও কষ্ট বয়ে আনে উপকূল বাসিন্দাদের জন্য। পাথরের ঢিপির প্রায় প্রথম দুটি স্তর শেষ হয়ে যায়। একদিকে প্রকৃতি আর অন্যদিকে দীর্ঘকালের স্থায়ী শত্রু ইংল্যান্ড এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তারা আশাহীন উন্মাদের মত হয়ে যায়।


এর মধ্যে অত্যধিক নির্মাণ খরচ রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ায়। সম্রাট নেপোলিয়ন দূর্গের মাপ হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮০৯ সালে সদ্য অনুমোদিত প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু করা হয়। এক বছর পার হতে না হতে নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। ব্রিটিশ স্কোয়াড্রন রোচফোর্ট এবং অনেক আর্থিক অসুবিধা এর কারণ। ঢিপি নির্মাণে ৩.৫ হাজার কিউবিক মিটার পাথর ব্যয় হয় যার মূল্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দাড়ায় ৩.৫ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক।
রাজা লুই ফিলিপ অধীনে ১৮৪০ সালে প্রকল্পটি পুণরায় নবজন্ম লাভ করে। সম্পূর্ণ নতুনভাবে এই পরিকল্পনা করা হয়। বালুর উপর এর স্থপনা করার জন্য কংক্রিট, সিমেন্ট এবং জলবাহী নির্গত চুন এর চিন্তা করা হয়। এছাড়া ভারী পাথর দ্বীপ থেকে স্থানান্তরেরও প্রয়োজন ছিল।এ উপলক্ষ্যে ১৮৪৭ এবং ১৮৪৮ সালে নির্মাণ খরচ জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এর অনুভব হয়।


তহবিলের কাজ ১৮৪৮ সালে সম্পন্ন হয় এবং ১৮৫২ সালের শেষ নাগাদ বেসমেন্ট নির্মাণ সমপন্ন করা হয়। এতে একটি গোলাবারুদ রাখার ওয়্যারহাউস, পানির ট্যাংক, রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, একটি গার্ডরুম এবং একটি টয়লেট ছিল। ১৮৫৪ এর শেষের দিকে প্রথম মেঝে নির্মাণ সমপন্ন হয় এবং ১৮৫৭ সালে উপরের প্ল্যাটফর্ম এবং কেল্লার ওয়াচ টাওয়ারের কাজ হয়। এরপর ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। দূর্গ নির্মাণের এই কাজ ষাট বছরেরও অধিক সময় ধরে চলে। আর তা ছিল শুধুমাত্র একটি ছোট অংশের কাজ। সম্পন্ন দূর্গের উচ্চতা ছিল ২০ মিটার, দৈর্ঘ্যে ৬৮ মিটার এবং প্রস্থে ৩৯ মিটার। এতে ৭৪ কামান বন্দুক ধরানো যায়। দূর্গে সর্বোচ্চ ২৬০ জনের ধারনক্ষমতা ছিল। যার মধ্যে ছিল ক্যান্টিন রক্ষক, ধোপা, মুচি। আর অবরোধের ক্ষেত্রে খাদ্য এবং পানি ব্যবহার করে এই লোকগুলোর দুমাসের বেশি অবস্থান করা কষ্টসাধ্য ছিল।


ফোর্ট বায়ার্ড দস্যুদের জন্য একটি বড় লক্ষবস্তু ছিল। বিশেষকরে কামান বন্দুক, ডিনামাইট। এছাড়াও লৌহঘটিত কিছু স্ক্রাপ ছিল। যাহোক, কর্তৃপক্ষ ১৯৩৯ সালে বছরে ৩০০ ফ্রাঙ্ক এর বিনিময়ে এটা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দূর্গটি সহ পুরো ফ্রান্স জার্মান সৈন্য দ্বারা দখল ছিল। জার্মান সৈন্যরা দূর্গটিকে তাদের প্রশিক্ষণের স্থান বানায়। যার ফলে বাইরের বস্তুর মোকাবিলায় এর দেয়াল সহ অনেক কিছু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে দূর্গের ভেতরের চত্বর পাথরের ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে যায়।

যুদ্ধ বিগ্রহ আর প্রকৃতির কারণে শুধুমাত্র ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই ছিল না ফোর্ট বিয়ার্ডের। তখন এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান আর আগাছার জঙ্গল। ফ্রান্স এটি নিলাম করার সিদ্ধান্ত নেয় আর সর্বনিম্ন দাম হাকা হয় ৭৫০০ ফ্রাঙ্ক। একজন বেলজিয়াম ডেন্টিস্ট এর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু এর দাম ২৫,০০০ ফ্রাঙ্ক এর উপরে কেউ বলতে নারাজ। যার ফলে ঐ ডেন্টিস্টের হাকা ২৮,০০০ ফ্রাঙ্ক এর বিনময়ে দূর্গটি তার হয়ে যায়।


এই নতুন মালিকের কোন ধারণা ছিল না এই দূর্গ সম্মন্ধে। তিনি সঠিক কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেন তিনি এটা ক্রয় করলেন? ক্যাসিনো, হোটেল, ছুটির দিনে ভ্রমন! ফলে ফোর্ট বায়ার্ড জনমানবহীন হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে রবার্ট এনরিকো নামক এক চলচিত্র নির্মাতা ”এডভেঞ্চার’ নামক এক চলচিত্র নির্মাণ করেন যাতে এই ফোর্ট বায়ার্ডের চিত্র ফুটে উঠে। ফ্রান্সের দুটি হলে এটি প্রকাশ পায়। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৮০ সালে ফোর্ট বায়ার্ড আবার সেলুলয়েডে বন্দী হয়। 'ট্রেজার হান্ট’ নামক এই চলচিত্র ফ্রান্সের টেলিভিশনেও প্রচার করা হয়। আর এই নির্মাতা এটিকে চলচিত্রের শুটিংয়ের জন্য বরাদ্দ করার পরামর্শ দেন। বর্তমানে এ নিয়ে অনেক জনপ্রিয় গেম তৈরী হয়েছে। অনেক টিভি শো নির্মাণ হয়েছে।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৪
৮টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×